ঘটনাটা আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা। সমপ্রতি সিঙ্গাপুরে ওর যে অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল, সেটাই ও আমার সাথে শেয়ার করেছিল। গল্পটা বা ওর অভিজ্ঞতাটা ও ইংরেজিতে আমাকে জানিয়েছিল। আমি সেটাকে সবার বোধগম্যতার জন্যে বাংলায় করলাম।
‘সেদিন আমাকে একটা অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। যে প্রতিষ্ঠানটি অনুষ্ঠানটির আয়োজক তারা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের সহায়তা করে থাকে। আমাদের বলা হলো, কিছু দৃষ্ঠিপ্রতিবন্ধীর সাথে আমাদের রাতের খাবার খেতে হবে। প্রথমে আমার মনে হলো এ ধরণের অনুষ্ঠান হয়তো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কিছু সাথারণ শুকনো বক্তব্য করা হবে, সেই সাথে থাকবে নানা প্রকার তথ্য-উপাত্তের কচাকচি। তারপর হয়তো নিরানন্দ খাবার। একবার মনে হলো এ রকম একটা অনুষ্ঠানে না গিয়ে বরং অন্য বিনোদনমূলক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি।’
‘একা মানুষ, তেমন বন্ধুও নেই এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে আর বিকেল, সন্ধে আর রাতের এই দীর্ঘ সময়টা কাটানো আমার পক্ষে দূরুহ হবে। তাই আমি বাধ্য হয়ে আমন্ত্রণটা গ্রহণ করলাম আর অনলাইনে আমি আমার নাম তালিকাভুক্ত করলাম। আর একটা কারণে আমি এখানে যেতে রাাজি হলাম সেটা হলো, অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য আমাকে কোন প্রবেশমূল্য দিতে হলো না। আসলে ঐ দিন আমি আমার নিঃসঙ্গ সময়টা কোন এক জটলার মাঝে কাটাতে চাইছিলাম। কিছু লোকের সাথে কথা তো বলা যাবে, এই আর কি।’
‘আমি ওখানে পৌঁছে দেখি বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন পেশার নানা রকম প্রায় ৪০ জন লোক ওখানে আমন্ত্রিত হয়েছে। ওখানে দুই-একজন প্রতিবেশী দেশের নাগরিককেও দেখতে পেলাম, আর ওদের সাথে সৌজন্য আলাপে জড়িয়ে পড়লাম।’
‘অনুষ্ঠানের শুরুতে আমাদের একটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কেন্দ্রের কার্যক্রমের ওপর ভিডিও দেখানো হলো। কিভাবে কেন্দ্রটি পরিচালিত হয়, কিভাবে সিঙ্গাপুরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনধারায় সম্পৃক্ত করতে সাহায্য করা হচ্ছে, এই সব। প্রায় পনেরো মিনিটের এই ভিডিওটি দেখতে খুব ভাল লাগলো। আরও ভাল লাগলো এই দেখে যে সমাজের বিভিন্ন মানুষ কিভাবে এই সকল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করতে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। অথচ এর বিনিময়ে ওরা কোন কিছুই আশা করছে না সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে। ওদের কাজই ওদের প্রেরণা আর ওদের কাজের ফলাফলই ওদের পুরষ্কার।’
‘ভিডিওটি শেষ হয়ে গেলে আমাদেরকে এই বড় হলঘরে নিয়ে যাওয়া হলো এবং পরবর্তী অনুষ্ঠানের বিষয়ে অবহিত করানো হলো।
অনুষ্ঠানটির পরবর্তী অংশের নাম ‘ডাইনিং ইন দি ডার্ক’ অর্থাৎ “অন্ধকারে খাদ্য গ্রহণ”। আর অনুষ্ঠানের এই অংশটিই সবচেয়ে উদ্বুদ্ধকারী ও প্রকৃতই আনন্দময় শিক্ষামূলক। পরে আমার মনে হয়েছে আমাদের উচিৎ জীবনে একবার আমাদের সকলেরই এমন একটি অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন।’
‘আমরা যে চল্লিশ জন মানুষ সেদিন ওখানে ছিলাম, আমাদের সবাইকে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আমাদের খাবার খেতে হবে। পরবর্তী দেড় ঘণ্টার সকল কার্যক্রম সঠিক ও সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পিত, নিয়ন্ত্রিত, পরিচালিত আর সম্পাদিত হলো তিনজন অন্ধ ছেলেমেয়ের দ্বারা।
এর ভেতর একজন মেয়ে, যে এদের দলনেত্রী আর বাকী দুইজন ছেলে ওকে সহায়তা করছিল। দলনেত্রী মেয়েটি আমাদেরকে বলে দিল কিভাবে এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আমরা আমাদের খাদ্য গ্রহণ করবো। এই নিয়মেই ওরা প্রতিদিন ওদের খাবার খায়, যাতে ওদের জীবনধারণ আরও সহজ হয়ে ওঠে।’
মেয়েটি যে কথাগুলি বলে গেল, সেগুলি আমি ওর জবানীতেই বলছি:’
“১। যখন তুমি টেবিলে তোমার চেয়ারে বসবে তখন তোমার সামনে একটা প্লেট রাখা হবে। তুমি ওটাকে একটা ঘড়ি মনে করে তার ৩-টা যে জায়গায় হবে সেখানে একটা চামচ পাবে, ৯-টার জায়গায় থাকবে একটা কাঁটাচামচ। ১২-টা জায়গায় আর একটা চামচ থাকবে। ২-টার জায়গায় থাকবে একটা খালি গ্লাস। প্লেটের তলায় ৬-টার জায়গায় থাকবে একটা ন্যাপকিন।”
“২। দুটো বড় জগ তোমাদের সামনে আনা হবে, যে জগের বাইরের দেয়াল মসৃণ সেটাতে থাকবে পানি আর অমসৃণ দেয়ালের জগে থাকবে কমলার রস।”
“৩। তোমাদের সামনে যখন জগ আসবে তোমাদেরর পছন্দের পানীয় তোমরা নিজেদের গ্লাসে ঢেলে নেবে। গ্লাসে হাতের একটা আঙুল ডুবিয়ে পানীয় ঢালবে তোমরা, যাতে তোমরা বুঝতে পারো কতটুকু পানীয় গ্লাসটিতে ঢালা হয়েছে। যখন পানীয় তোমার আঙুল স্পর্শ করবে তখন তোমাকে তরল ঢালা বন্ধ করতে হবে।”
‘মেয়েটি আমাদের জিজ্ঞেস করলো আমরা তার সব নির্দেশনা বুঝতে পেরেছি কি না। আমরা সকলে সম্মতি জানালাম।
আমাদের মনে মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল আর মনে মনে বার বার মেয়েটির দেওয়া তথ্যগুলো ঝালাই করতে চেষ্টা করলাম।’
‘পরের দেড় ঘন্টা আমরা অসম্ভব আনন্দে আর ঠেকে ঠেকে শিখে আমাদের খাবার খেতে থাকলাম। খাবার ঘরটা এমন গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত যে আমরা যে অসাধারণ মুখরোচক খাবার খাচ্ছিলাম তার কিছুই আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম না।’
‘আমাদের চল্লিশ জনকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে এক এক জন অন্ধ আমাদেরকে এক একটা চেয়ারে নিয়ে গেলো আর চেয়ারে বসতে সাহায্য করলো (সাধারণত আমরাই অন্ধদের ঘরে নিয়ে চেয়ারে বসতে সহায়তা করি)।’
‘আমাদেরকে পাঁচ কোর্সের ডিনার সার্ভ করলো এই তিনজন অন্ধ ছেলে আর মেয়ে- ওয়েলকাম ড্রিংকস্, এপেটাইজার্স, স্টারটারস, তারপর প্রধান কোর্স এবং সব শেখে ডেসার্টস্। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের মধ্যে যারা নিরামিষভোজি, তাদেরকে সঠিকভাবে নিরামিষ ডিশ আর যাদের আমিষ পছন্দ, তাদেরকে সঠিকভাবে আমিষ ডিস সরবরাহ করছিল ঐ অন্ধ তিন যুবক-যুবতী। যদিও আমরা দুই দল ছাড়া ছাড়া ভাবে ঘরের বিভিন্ন অংশে বসেছিলাম।’
‘যখন অনলাইনে আমরা আমাদের নাম নিবন্ধন করেছিলাম, তখনই ফর্মের ‘ভেজিটারিয়ান’ আর ‘নন-ভেজিটারিয়ান’ স্থানে নিজেদের মতো টিক দিয়েছিলাম। আমি নিজে নিরামিষভোজি হিসেবে টিক দিয়েছিলাম। আর আমাদেরকে যখন খাবার পরিবেশন করা হচ্ছিল, একটা পদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে পরবর্তী পদ আমাদের সামনে হাজির করা হচ্ছিল। পরবর্তী পদের জন্য আমাদেকে একটুও অপেক্ষা করতে হচ্ছিল না।’
‘প্রায় দেড় ঘন্টা পর যখন আমাদের খাবার শেষ হয়ে গেল, তখন আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা আমাদের খাবার তৃপ্তিসহ গ্রহণ করেছি কি না। আমরা আমাদের সানন্দ সম্মতি জানানোর পর ঘরের আলো জ্বেলে দেয়া হলে। আমরা সকলে অশ্রুসজল চোখে ডাইনিং রুম থেকে বের হয়ে এলাম।’
‘আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করলাম, ঈশ্বর আমাদের এই দুটো অপূর্ব সুন্দর চোখদুটি উপহার দিয়ে আমাদের ওপর কত বড় করুণা করেছেন, আমরা এখন এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ দুই চোখ ভরে অবলোকন করতে পারছি। আমাদের আরও মনে হলো, একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ অথবা যে কোন প্রতিবন্ধী মানুষের জীবন কতটা কষ্টকর! আর কি কষ্টে তারা তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করছে। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধারণ সম্পদগুলির প্রকৃত মূল্যায়ন করি না।’
‘আমাদের উচিৎ এই সব সম্পদের জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া। (কখনও উচ্চকণ্ঠে এবং অধিকাংশ সময়ে আমাদের অন্তরে) এ জন্য কৃতজ্ঞতার অশ্রু যেন আমাদের হৃদয় ও অন্তর প্লাবিত করে। আর সকল সময় আমাদের আনন্দে থাকা উচিৎ। আর আমাদের সকলেরই উচিৎ নিজে আমাদের জীবনে এমন একটি অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়া।’
আমাদের সকলের উচিৎ হবে সকল হিংসা, লোভ, বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে পরষ্পরকে সহায়তা করা। সকল রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে রাখা।