বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
قُل لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الإِنسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَن يَأْتُواْ بِمِثْلِ هَـذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
অর্থঃ বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয়, এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না।
(সুরা বনী ইসরাইলঃ আয়াত নং-৮৮)
ঘটনাটি ঘটেছিল একটি আন্তঃধর্মীয় সম্মেলনে। আয়োজকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, সম্মেলন শেষ হবে বড় ধর্ম গুলোর ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে, আর পাঠ করবেন ভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা। তখন একজন আরব খৃস্টান কুরআনুল কারীম থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত করেন। তিনি একজন ভালো ক্বারী ছিলেন। মনে হচ্ছিল, তার হৃদয় ছোয়া তেলাওয়াত তাকে সহ উপস্থিত সবাইকে নাড়া দিচ্ছিল। এর পর পরই প্রসিদ্ধ ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক মাওলানা ওয়াহীদ উদ্দীন খান, যিনি এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করেনঃ “ আপনি কি বিশ্বাস করেন, কুরআন আল্লাহর বাণী?” খানিক সত্যের ঝলকানিতে তিনি বলে ফেলেন, “ হ্যাঁ।” কিন্তু পরক্ষণই তিনি দ্বিতীয় বার চিন্তা করেন এবং যোগ করেনঃ “কিন্তু তা শুধু মাত্র আরবদের জন্য।” (এভাবে সত্য থেকে পালাতে চাইলেও তিনি তা পারেননি, কেননা তিনি নিজেই একজন আরব ছিলেন)
ডঃ আবু আম্মার ইয়াসির কাজী তার এক লেকচারে বলেন, একবার একজন যুবক কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনছিলেন এবং সাথে সাথে তেলাওয়াত করছিলেন। এটা দেখে একজন অ- মুসলিম যুবক তাকে জিজ্ঞাসা করে এটা কি? তিনি তখন ওয়াকম্যানের হেডফোন যুবকটির কানে লাগিয়ে দেন এবং তাকে শুনতে দেন। তিনি দেখতে পান, আরবী ভাষার সাথে অপরিচিত যুবকটির চোখ দুটো সম্পুর্ণ জলে ভেজা।
প্রকৃতপক্ষে কুরআনের বার্তা শুধুমাত্র সারা বিশ্বের মানুষকে আকর্ষনই করেনা, এর শব্দের ঝংকারও মানুষকে নাড়া দেয়, যদিও বা সে আরবী ভাষা নাও জানে। বর্ণিত আছে, একবার সোভিয়েত নেতাদের সাথে মিটিং এ প্রখ্যাত মিশরীয় ক্বারী আব্দুল বাসেত তখনকার মিশরীয় রাস্ট্রপতি জামাল আব্দুল নাসের এর সঙ্গী ছিলেন। মিটিং এর এক বিরতিতে, নাসের তাকে শির্ষস্থানীয় সোভিয়েত নেতাদের সামনে আল- কুরআন থেকে তেলাওয়াত করতে অনুরোধ করেন। যখন তিনি তেলাওয়াত শেষ করেন, ক্বারী আব্দুল বাসেত দেখেন, তাদের মধ্যে চারজনের চোখে অশ্রু। “ এটা কি ছিল, আমরা তা জানিনা” পরে তারা ব্যাখ্যা করেন, “কিন্তু এর মধ্যে মর্মস্পর্শী কিছু ছিল! কিন্তু এটি একটি পরিহাস ছিল যে, সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে কুরআন মুসলমানের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। কুরআন তেলাওয়াত করা, স্পর্শ করা এমন কি শুধু কাছে রাখা ছিল নির্মম শাস্তি যোগ্য অপরাধ। ‘কে জি বি’ সব সময় নজর রাখত, যদি তারা সন্দেহ করত যে, কেউ কুরআন তেলাওয়াত করছে বা সালাত আদায় করছে, তাদের এজেন্ট সেই ব্যক্তির বাড়ীর ভেতরে যখন-তখন ঢুকে যেত। ধর্মীয় নেতাদের বাধ্যতামূলক ভাবে শ্রমিক বানানো হয়েছিল। মাসজিদ এবং ইসলামিক বিদ্যালয় গুলোকে বন্ধ করে সিনেমা হল, কারখানা বা অফিস বানানো হয়েছিল। কুরআনের একটি কপি কেউ খুঁজে পেতনা। কুরআন এবং ইসলামের শিখা তাদের সম্রাজ্য থেকে নিভিয়ে ফেলার জন্য নিষ্ঠুর রাস্ট্র যন্ত্র তাদের ক্ষমতার সবটুকু ব্যাবহার করেছিল। তবুও সেই অন্ধকার সত্তরটি বছর মুসলমানেরা সেই শিখা জ্বালিয়ে রেখেছিল। তারা গোপণে গোপণে এমন পন্থা উদ্ভাবন করেছিল, যাতে করে তারা চুড়ান্ত ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের কুরআন শিক্ষা দিত। ছোট বাচ্চাদের মাসের পর মাস তাদের পিতা-মাতা থেকে দুরে সরে গিয়ে গোপণ কুঠুরীতে থাকতে হত। সেখানে তারা কোন ছাপানো পাতার দিকে না তাকিয়ে কুরআন মুখস্ত করত এবং ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করত। আমাদের নিকট ইতিহাসের খুবই উজ্জ্বল এই সব কাহিনী অবহেলিত থেকেছে।
আল্লাহ বলেনঃ
يُرِيدُونَ أَن يُطْفِؤُواْ نُورَ اللّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَيَأْبَى اللّهُ إِلاَّ أَن يُتِمَّ نُورَهُ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
অর্থঃ তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে। ( সুরা তওবাঃ আয়াত নং-৩২)
কেমন গ্রন্থ হলে এ ধরনের সর্বোচ্চ নিবেদন ও ত্যাগের জন্য মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে? শুধু মাত্র সেই গ্রন্থ-ই যা শুরু হয় এই কথা বলেঃ
ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ | |
অর্থঃ এ সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শনকারী পরহেযগারদের জন্য (সুরা বাকারাঃ আয়াত নং-২) এবং পরবর্তী সকল আয়াত এই কথারই সত্যায়ন করে। এই গ্রন্থ ঘোষনা দেয়ঃ لرَّحْمَنُ অর্থঃ করুনাময় আল্লাহ। عَلَّمَ الْقُرْآنَ অর্থঃ শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। (সুরা আর-রহমানঃ আয়াত নং ১-২) এই গ্রন্থ চ্যালেঞ্জ জানায়ঃ قُل لَّئِنِ اجْتَمَعَتِ الإِنسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَن يَأْتُواْ بِمِثْلِ هَـذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا অর্থঃ বলুনঃ যদি মানব ও জ্বিন এই কোরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্যে জড়ো হয়, এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনও এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না। (সুরা বনী ইসরাইলঃ আয়াত নং-৮৮) এই গ্রন্থ দাবী করেঃ إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ অর্থঃ আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক। (সুরা হিজরঃ আয়াত নং-৯) আল-কুরানুল কারীম হলো আরবী ভাষায় লিখিত প্রথম দলীল। পৃথিবীতে আর কোনো ভাষা নেই, যা চৌদ্দ শতাব্দী টিকে আছে। শতাব্দী পেরোতে নদী তার গতিপথ বদল করে, সভ্যতার উত্থান ও পতন হয়, এবং ভাষা হারিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, নতুন ভাষার উৎপত্তি ঘটে। খৃস্টীয় ৯ম শতাব্দীর ইংরেজী বাইবেলে মথি লিখিত সু-সমাচার সমূহের ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে প্রভুর প্রার্থনা থেকে এই বাক্যটির প্রতি লক্ষ্য করুন, “faeder ure on heofonum”। আমাদের বলা হয়েছে, এর অর্থ হলো ‘স্বর্গে অবস্থান কারী আমাদের পিতা’ এর অর্থও হতে পারে, ‘ এমন কোনো ইংরেজী লেখা, যা বর্তমান কালের কোনো ইংরেজী ভাষী মানুষ পড়তে জানেনা’। কিন্তু যে কোনো অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন আরবী ভাষী মানুষ কুরআন মজীদের যে কোনো একটি পাতা খুলে পড়ে তা বুঝতে পারবে। আর মধ্যবর্তী সময় গুলোতেও এই অবস্থার কোনো ব্যত্যয় হয়নি! বিশিষ্ট স্কলার ডঃ হামিদুল্লাহ আমাদের জানান, জার্মানীতে একবার খৃস্টান স্কলারগণ কর্তৃক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় যে, বাইবেলের সকল মূল গ্রীক ( প্রকৃত পক্ষে কোইনি গ্রীক) পান্ডুলিপি সংগ্রহ করা হবে, যেহেতু বাইবেলের মূল আরামায়িক পান্ডুলিপির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তারা পৃথিবীর সকল পান্ডুলিপি একত্রিত করেন এবং পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার ফলাফলে বলা হয়, “ সেখানে প্রায় ২ লক্ষ পারস্পরিক বিরোধ মূলক বর্ণনা রয়েছে এর মধ্যে পঁচিশ হাজার বিরোধ হলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতির। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর কিছু ব্যাক্তি মিউনিখে আল-কুরানুল কারীমকে একই উপায়ে পরীক্ষা করার জন্য একটি ইন্সটিটিউট স্থাপন করেন, যার নাম ছিল, ‘Institute for Qur’anic Research in Munich’। দানবীয় এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং তা সম্পন্ন হতে প্রায় তিন পুরুষ সময় ব্যায়িত হয়। ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত কুরআনের প্রায় ৪৩০০০ হাজার পান্ডুলিপি সংগ্রহ করা হয়। ২য় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কিছুদিন আগে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা হয় কিছু ক্ষুদ্র ক্যালিগ্রাফী জনিত ত্রুটি নজরে আসে, কিন্তু ভাষা বা বর্ণনায় নুন্যতম একটি ত্রুটি বা বিরোধ দৃষ্টিগোচর হয়নি! অবশ্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, যে ভালোবাসা, নিষ্ঠা এবং যত্ন মুসলিমরা কুরআনের প্রতি প্রদর্শন করেছে, তা আপাতদৃষ্টিতে আল-কুরআনের এই অলৌকিক সংরক্ষণের প্রাথমিক কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। উকবা ইবনে আমের (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলেন। তখন আমরা সুফফা বা মাসজিদের চত্বরে অবস্থান করছিলাম। তিনি বললেনঃ তোমরা কি কেউ চাও যে প্রতিদিন ‘বুতহান’ বা আকীকের বাজারে যাবে এবং সেখান থেকে কোনো গুণাহ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ছাড়াই বড় কুঁজ বা চঁট বিশিষ্ট দুটি উটনি নিয়ে আসবে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, আমরা চাই। তিনি বললেন, তাহলে কি তোমরা কেউ মাসজিদে গিয়ে আল্লাহর কিতাবের দুটি আয়াত শিক্ষা দেবেনা বা পাঠ করবেনা? এটা তার জন্য ঐরূপ দুটি উটনির চেয়ে উত্তম। এরূপ তিনটি আয়াত তিনটি উটনির চেয়ে উত্তম এবং চারটি আয়াত চারটি উটনির চেয়ে উত্তম। আর অনুরূপ সম সংখ্যক উটনির চেয়ে সম-সংখ্যক আয়াত উত্তম। ( সহীহ মুসলিমঃ হাদীস নং-১৭৫০, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা) সেই সময় উট ছিল মূল্যবান পণ্য, উটনির গুরুত্ব আরো অনেক বেশী ছিল। তুলনায় অনেকটা বলা যায় আধুনিক কালে একটি নতুন বিলাস বহুল মোটর গাড়ির সমান। আর এ কারণেই শতাব্দীর পর শতাব্দী এই উম্মত আল্লাহর কিতাবের প্রতি যে নিষ্ঠা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে তা সত্যিই অনন্য। তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষা শুরু করে কুরআনুল কারীম পড়তে শেখানোর মধ্য দিয়ে। তারা তাদের দিন শুরু করে কুরআন তেলাওয়াত দিয়ে। কুরআনকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, একে মঞ্জিল বলে। সুতরাং একে প্রতি সপ্তাহে একবার করে পড়ে সম্পন্ন করা যায়। এটাকে ত্রিশ ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রত্যেক ভাগকে পারা বলে। সুতরাং একে একমাসে পড়ে সম্পন্ন করা যায়। কুরআন হলো পৃথিবীতে সর্বোচ্চ পঠিত ও মুখস্ত করা গ্রন্থ! যদিও আজ পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে । ‘ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং টেলিভিশন’ এই দুই যুগলকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হয়, আজ দেখি লক্ষ-কোটি মুসলিম শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কুরআন শিক্ষা অনুপস্থিত। আমরা লক্ষ লক্ষ মুসলিম ঘর দেখি, যেখানে কুরআন পাঠ করা হয় শুধুমাত্র বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানে, যেমন কারো মৃত্যুতে। যদিও বা আজ প্রায় সমগ্র বিশ্বে এটি সত্য যে, কুরআন পাঠ উচ্চ ঝুঁকির কিছু নয়, যেমন ছিল গত দিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে। সেই ব্যাক্তি কতই না দুর্ভাগা যে হাতে করে ধরে রাখে পান পাত্র ভর্তি পানি, কিন্তু সে মারা যাচ্ছে তৃষ্ণার্ত অবস্থায়! সে ব্যাক্তি কতই না দুর্ভাগা, যে মারা যায় কোনো অসুখে, কিন্তু সেই অসুখের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ঔষধ সে তার হাতের মধ্যে ধরে রেখেছে ! অবশ্যই আমাদের তা পাঠ করতে হবে, বুঝতে হবে এবং জীবনে চর্চা করতে হবে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, সম্পুর্ন পৃথকভাবে পুরোপুরি আদব রক্ষা করে পাঠ করা হলো এই গ্রন্থ বোঝার পুর্ব শর্ত, যেমন চর্চার জন্য বোঝা পুর্ব শর্ত। আমাদের জীবনে একে ধারণ করতে হবে, তাহলেই আমাদের সত্যিকারের বেঁচে থাকা হবে, নতুবা আমরা শুধু বেঁচে থাকার ভান করব। |