Saturday, December 7, 2024
No menu items!

আমাদের মুসলিমউম্মাহ ডট নিউজে পরিবেশিত সংবাদ মূলত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সমাহার। পরিবেশিত সংবাদের সত্যায়ন এই স্বল্প সময়ে পরিসরে সম্ভব নয় বিধায় আমরা সৌজন্যতার সাথে আহরিত সংবাদ সহ পত্রিকার নাম লিপিবদ্ধ করেছি। পরবর্তীতে যদি উক্ত সংবাদ সংশ্লিষ্ট কোন সংশোধন আমরা পাই তবে সত্যতার নিরিখে সংশোধনটা প্রকাশ করবো। সম্পাদক

হোমদৈনন্দিন খবরআওরঙ্গজেবের প্রতি বিদ্বেষ

আওরঙ্গজেবের প্রতি বিদ্বেষ

বানারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের বিরুদ্ধে যেভাবে গুজবের বাজার সরগরম হচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও উগ্রতার ঝড়ের বেগও বাড়ছে। আওরঙ্গজেবকে খলনায়ক প্রমাণ করার জন্য এমন ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলা হচ্ছে, বাস্তবতার সাথে যার দূরতমও সম্পর্ক নেই। ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতেও তার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা বিদ্বেষের এই ঝড়ের কারণেই মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে অবস্থিত তার কবরে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। কেননা, কিছু উগ্রবাদী এই কবর ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছে। নতুন দিল্লিতে অবস্থিত আওরঙ্গজেব লেনের সাইনবোর্ড মুছে ফেলে সেটিকে বাবা বিশ্বনাথ লেন বানানোর চেষ্টা করা হয়। আওরঙ্গজেব রোডকে আগেই সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালামের নামে নামকরণ করা হয়েছে। আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একজন জালিম শাসক ছিলেন। তিনি তার ভাইকে হত্যা করেছেন এবং নিজের পিতা শাহজাহানকে কারাগারে পাঠান। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তিনি বহু মন্দির ভেঙে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন।

বানারসের জ্ঞানবাপী মসজিদের ব্যাপারেও এ প্রোপাগান্ডা বেশ জোরেশোরে চালানো হচ্ছে যে, আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙে এই মসজিদ নির্মাণ করিয়েছেন। অথচ জ্ঞানবাপী মসজিদ আওরঙ্গজেবের আগেই নির্মিত হয়েছে এবং সেখানে বাবরি মসজিদের মতো কোনো মন্দির ভাঙার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই প্রোপাগান্ডার বিপরীতে যদি আপনি নিরপেক্ষ ইতিহাস অধ্যয়ন করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, আওরঙ্গজেব তার শাসনামলে মন্দিরগুলোকে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি এবং তাদের স্বনির্ভর করে দেন। অথচ সঙ্ঘ পরিবার আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে এতটাই বিদ্বেষ ছড়িয়েছে যে, বেশির ভাগ মানুষ তার নাম শুনতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে।

বিজেপি যখন থেকে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসে, তখন থেকেই ওই সব স্মৃতিচিহ্নহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা শীর্ষে রয়েছে, যেগুলোকে আমরা এ দেশে জাতীয় ঐক্য বা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নিদর্শন বলে অভিহিত করি। এ কারণেই তাজমহল, কুতুবমিনার, শাহী ঈদগাহ ও জামে মসজিদের নিচেও মন্দির অনুসন্ধানের চেষ্টা শীর্ষে রয়েছে। মুসলিম শাসনামলের কিছু সুন্দর কবরস্থানকেও মন্দিরে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেগুলোর সাইনবোর্ড গায়েব করে দেয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে, দেশে ওইসব স্থাপনা ও নিদর্শন হুমকির মধ্যে রয়েছে, যেগুলো মুসলিম বাদশাহরা বানিয়েছিলেন এবং যেগুলোর কারণে বিশ্বমানচিত্রে সম্মানের সাথে ভারতের নাম নেয়া হয়। এটি বলার প্রয়োজন নেই যে, মোগল আমলের সবচেয়ে সুন্দর স্থাপনা তাজমহলকে আজো সারা বিশ্বে ভারতের তাজ অর্থাৎ মুকুট ভাবা হয়। সবচেয়ে বেশি পর্যটক এটাকেই দেখতে আসেন এবং এর দ্বারা সরকার কোটি কোটি রুপি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে।

আওরঙ্গজেব সম্পর্কে এই সময় যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে, এর বাস্তবতা জানতে আসুন, আমরা বিএন পাণ্ডের কাছে যাই, যিনি এক সময় উড়িষ্যার গভর্নর ছিলেন। তাকে ভারতের নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিতদের মধ্যে গণ্য করা হয়। তিনি আওরঙ্গজেব সম্পর্কে যা কিছু লিখেছেন, তা অবশ্যই অধ্যয়ন ও মনে রাখার মতো। আবুল মুজাফ্ফর মহিউদ্দীন মুহাম্মদ, যিনি সাধারণের মাঝে ‘আওরঙ্গজেব আলমগীর’ নামে পরিচিত। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ শাসক ছিলেন। তিনি ১৬১৮ সালের ৩ নভেম্বর দাহোদে জন্মগ্রহণ করেন। ১৬৫৮ সালে তার শাসনকাল শুরু হয় এবং ১৭০৭ সাল তার মৃত্যু পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এভাবে তিনি অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত ভারত শাসন করেন। তার জীবনের ইচ্ছা ছিল, ভারতের বেশির ভাগ অংশকে নিজের সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করা। এ কারণে তিনি যুদ্ধের পথ বেছে নেন। ২০ বছর পর্যন্ত তিনি দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোকে তার সাম্রাজ্যে যুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করেন। ৩ মার্চ, ১৭০৭ সালে তিনি আহমদনগরে (মহারাষ্ট্র) ইন্তেকাল করেন, তাকে খুলদাবাদে দাফন করা হয় যার নাম পরিবর্তন করে এখন শম্ভাজিনগর করার চেষ্টা চ‚ড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে।

এই মুহূর্তে বিএন পাণ্ডে রচিত ‘ভারতে জাতীয় ঐক্যের চিরায়তরূপ’ পুস্তিকা সামনে রয়েছে। এই পুস্তিকাটি ১৯৮৮ সালে পাটনার খোদাবখশ লাইব্রেরি প্রকাশ করেছে, যা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ জন্য এ পুস্তিকাটির গুরুত্ব বেড়ে যায়। এই পুস্তিকাটির একটি চুম্বকাংশ আপনাদের সামনে নজরানা হিসেবে পেশ করছি, যাতে আপনাদের কাছে আওরঙ্গজেবের সত্যটা স্পষ্ট হয়।

তিনি লিখেছেন- ‘যেভাবে শিবাজি সম্পর্কে ইংরেজ ইতিহাসবিদরা ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করেছেন, ঠিক ওইভাবেই আওরঙ্গজেব সম্পর্কেও করা হয়েছে। এক উর্দু কবি বেশ ব্যথা নিয়ে বলেছেন- পুরো কাহিনীর মধ্যে তোমাদের শুধু এতটুকুই মনে আছে, আলমগীর হিন্দু হত্যাকারী ছিলেন, জালিম ছিলেন, অত্যাচারী ছিলেন। শৈশবে আমিও স্কুলে-কলেজে এ ধরনের ইতিহাস পড়েছি। আমার মনের ভেতরও এ ধরনের মন্দ ধারণা ছিল। কিন্তু একটি ঘটনা ঘটে, যা আমার সিদ্ধান্তকে একেবারেই বদলে দেয়। আমি তখন এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। ত্রিবেণী সঙ্গমের কাছে সোমেশ্বর নাথ মহাদেবের মন্দির। সেখানকার পূজারীর মৃত্যুর পর মন্দির ও মন্দিরের সম্পত্তির দু’জন দাবিদার দাঁড়িয়ে যায়।

উভয়েই মিউনিসিপ্যালিটিতে খারিজে তাদের নাম দাখিলের আবেদন করে। তাদের একটি পক্ষ কিছু দস্তাবেজও দাখিল করেছিল। অপরপক্ষের কাছে কোনো দস্তাবেজ ছিল না। যখন আমি দস্তাবেজে চোখ বুলালাম, দেখতে পেলাম এটা আওরঙ্গজেবের ফরমান। ওই ফরমানে মন্দিরের পূজারীকে ঠাকুরজির ভোগ ও পূজার জন্য জায়গির হিসেবে দু’টি গ্রাম দেয়া হয়েছে। আমার সন্দেহ হলো, এ দস্তাবেজ বোধহয় নকল। আওরঙ্গজেব তো মূর্তি ভাঙার মানুষ। তিনি মূর্তিপূজার সাথে কীভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন? আমি সন্দেহ দূর করার জন্য আমার চেম্বার থেকে উঠে সোজা স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রুর কাছে গেলাম। সাপ্রু সাহেব ফার্সির পণ্ডিত ছিলেন।

তিনি ফরমান পাঠ করে বললেন, এ ফরমান আসল। আমি বললাম, ডক্টর সাহেব, আলমগীর তো মন্দির ভাঙতেন, মূর্তি ভাঙতেন। তিনি ঠাকুরজির ভোগ ও পূজার জন্য কীভাবে সম্পদ দিতে পারেন? সাপ্রু সাহেব মুনশীকে ডাক দিয়ে বললেন, মুনশীজী, বানারসের জঙ্গম বাড়ি শিবমন্দিরের আপিলের অনুলিপিটা একটু নিয়ে আসুন। মুনশীজী অনুলিপি নিয়ে এলে ডক্টর সাপ্রু দেখালেন, সেখানে আওরঙ্গজেবের চারটি ফরমান রয়েছে। সেখানে জঙ্গমদের করমুক্ত ভ‚মি দেয়া হয়েছে। ডক্টর সাপ্রু ভারতীয় কালচার সোসাইটির প্রধান ছিলেন যার পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর ভগবান দাস, সায়্যিদ সুলাইমান নদভী, পণ্ডিত সুন্দরলাল, ডক্টর তারাচান্দ প্রমুখ। আমিও তার একজন সদস্য ছিলাম।

ডক্টর সাপ্রুর পরামর্শে আমি ভারতের বিশেষ বিশেষ মন্দিরের তালিকা তৈরি করলাম। ওই সব মন্দিরের নামে পত্র লিখলাম, যদি আপনাদের মন্দিরকে আওরঙ্গজেব বা মোগল বাদশাহদের কেউ কোনো জায়গির দিয়ে থাকেন (বিশেষ করে আওরঙ্গজেব), তাহলে তার ফটোকপি দয়া করে পাঠাবেন। দুই-তিন মাস অপেক্ষা করার পর আমরা উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির, চিত্রক‚টের বালাজি মন্দির, গুয়াহাটির কামাক্ষ্যা মন্দির, গিরনারের জৈন মন্দির, আবু পর্বতের দিলওয়ারা মন্দির, দেরাদুনের রাম রায় গুরুদুয়ারা প্রভৃতি থেকে খবর এলো, আওরঙ্গজেব তাদের জায়গিরসমূহ দিয়েছেন। ইতিহাসের এক নতুন আওরঙ্গজেব আমাদের সামনে আবিভর্‚ত হলো।’ (বিএন পাণ্ডে, ভারতে জাতীয় ঐক্যের চিরায়তরূপ, পৃষ্ঠা : ১৭-১৮, খোদাবখশ ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি, পাটনা, কর্তৃক ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত)

এটা সামান্য একটি চুম্বকাংশমাত্র। আরো নানা গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় উদারতার ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে সঙ্ঘ পরিবারের প্রোপাগান্ডা কার্যক্রম এতটাই চাঙ্গা যে, মানুষ অন্য কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। মনে হচ্ছে, মানুষের বিবেকের ওপর প্রলেপ পড়ে গেছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

three + twelve =

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য