আলহামদুলিল্লাহ!
আমার বয়স যখন কুড়ি, তখন একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। আমি একটা মাসজিদের ভেতর বসে আছি। ছোট্ট এক মেয়ে কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল!
“আচ্ছা বলো তো, মানুষ কেন একজন আরেকজনকে ছেড়ে যায়?” প্রশ্নটা শুনে ভাবলাম, আরেহ! এটা তো আমারই প্রশ্ন; আমাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে! পরে বুঝতে পেরেছিলাম প্রশ্নটা কেন আমাকে করা হয়েছিল।
ছোট্ট সেই মেয়েটির প্রশ্ন আসলে আমারই প্রশ্ন…আমি নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছি।
প্রশ্নটা আসলে এই দুনিয়ার বাস্তবতা নিয়ে। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী কিছু মুহূর্ত আর ক্ষণিকের কিছু সম্পর্ক নিয়ে। এই দুনিয়াতে আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো আজ আছে তো কাল নেই। হয় দূরে কোথাও চলে যায়। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের কষ্ট দেয়, কারণ এটা আমাদের স্বভাব বিরুদ্ধ। মানুষ হিসেবে আমাদের স্বভাবই হলো এমন, যা কিছু নিখুঁত ও দীর্ঘস্থায়ী সেগুলোকে চাওয়া, সেগুলোকে ভালোবাসা কিংবা সেগুলো পাওয়ার জন্য চেষ্টা করা। চিরস্থায়ী কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরাই আমাদের স্বভাব। আমরা চিরস্থায়ী কিছু খুঁজে ফিরি কারণ, দুনিয়ার জীবনের জন্য তো আমাদের সৃষ্টি করা হয়নি, আমাদের প্রথম ও প্রকৃত বাড়ি তো জান্নাতে: ওটা যেমন নিখুঁত তেমনি চিরস্থায়ী। কাজেই এমন জীবনের স্বাদ খোঁজা আসলে আমাদের মানব প্রকৃতিরই একটি অংশ। সমস্যা হচ্ছে আমরা সেটা এই দুনিয়াতে খুঁজি। আর তাই বুঝি আমরা বয়সকে ধরে রাখার জন্য চামড়ায় যেন বলিরেখা না-পড়ে সেজন্য ক্রিম কিনি। কসমেটিক সার্জারি করি। আমরা দুনিয়াকে জান্নাত বানাতে চাই, সেটা কি হয় কখনো?
মনকে যখনই দুনিয়ার মায়ায় বেশি জড়িয়ে ফেলি তখন সেটা ভেঙে যায়। দুনিয়া আমাদের কষ্ট দেয়। কারণ, দুনিয়া মানেই হলো যেটা ক্ষণস্থায়ী, ত্রুটিপূর্ণ। আমাদের মনের মাঝে যে-আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ পুরে দিয়েছেন সেটা কেবল কোনো চিরস্থায়ী নিখুঁত জিনিস দিয়েই পরিপূর্ণ হতে পারে। ক্ষণিকের কোনো কিছু দিয়ে সেটা পূরণ করতে যাওয়ার মানে হলো মরিচীকার পানি দিয়ে তেষ্টা মেটানো। খালি হাতে দালান ভাঙা।
প্রকৃতিগতভাবে যেটা ক্ষণস্থায়ী সেটাকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়ার চেষ্টা অনেকটা আগুন থেকে পানি বের করার মতো। আগুনের ধর্মই জ্বালিয়ে দেওয়া। ওটা থেকে কি তৃষ্ণা মেটানো যায়! যখনই দুনিয়ার আশা আমরা ছেড়ে দেব একমাত্র তখনই আমরা এই পার্থিব জীবনে মন ভাঙার মতো কঠিন যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হতে পারব। দুনিয়া জান্নাত নয়, সেটা কখনো হবেও না।
.
আমাদের বুঝতে হবে, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু হয় না। কিছুই না। মন ভাঙার পেছনে কারণ আছে। কষ্ট পাওয়ার পেছনেও কারণ আছে। এই ভাঙা হৃদয় আর কষ্টের মধ্যেই আমাদের জন্য শিক্ষা ও আল্লাহর প্রজ্ঞার নিদর্শন আছে। কিছু একটা যে ভুল হচ্ছে, আমাদের যে বদলাতে হবে এগুলো তারই সতর্কবার্তা। আগুনে হাত পুড়ে যেতে থাকলে আমরা তো এই সতর্কবার্তাই পাই যে, আমাদের হাত সরাতে হবে। তেমনি মানসিক দুঃখ কষ্ট গুলোও আমাদের এই কথাই বলে যে, আমাদের ভেতরটাকে বদলাতে হবে। কিছু একটা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। যন্ত্রণা আমাদের বাধ্য করে বিচ্ছিন্ন হতে। ভালোবাসার কোনো মানুষ যখন বারবার আমাদের কষ্ট দেয় তখন যেমন আমরা তার থেকে দূরে সরে যাই, ঠিক তেমনি এই দুনিয়া যত বেশি আমাদের কষ্ট দেয় তত বেশি আমরা অনিবার্যভাবে দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।