র্যাবের হাতে মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তার হলেও খোঁজ মিলছে না আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের আরও বড় মাফিয়া ডন ঢাকা উত্তর সিটির ৪৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শফিকুল ওরফে সোনা শফির। উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের এ সহসভাপতির হাতেই স্বর্ণ চোরাচালানের হাতেখড়ি হয় মনিরের; এ জনপ্রতিনিধির মাধ্যমেই মনিরও জড়িয়ে পড়েন আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রে। অপরাধ জগতের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তার হওয়ায় ঘাবড়ে গেছেন সোনা শফি। তাই পর্দার আড়ালে চলে গেছেন, বলা ভালো গা ঢাকা দিয়েছেন। সূত্রমতে, সোনা শফির নানা অপরাধ ও অপকর্মের অনুসন্ধানে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
এদিকে মনিরকে আইনি জালে বাঁধতে চতুর্দিক থেকে শুরু হয়েছে তোড়জোড়। অর্থপাচার ও অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কী পরিমাণ স্বর্ণ দেশে চালান করেছেন তা অনুসন্ধানে শুরু হয়ে গেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৎপরতা। অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি ও সাংসদদের শুল্কমুক্ত গাড়ি অবৈধভাবে বিক্রির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ
রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। আর জালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য ভূমি ও প্লট দখল করার বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে জানিয়েছেন, গোল্ডেন মনিরের নানা অপরাধের বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে র্যাব।
অন্যদিকে গোল্ডেন মনিরের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় যারা অবৈধ সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, তার হয়ে বিভিন্নভাবে তদবির করেছেন, তাদেরও একটি তালিকা তৈরি করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এ তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নানা ধাপের জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী রাজনীতিকের নামও উঠে আসছে। তাই তার সঙ্গে যাদের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল, তারা ভুগছেন অজানা আতঙ্কে। তাদেরই কেউ কেউ গা বাঁচাতে সোনা শফির মতো পর্দার আড়ালে অর্থাৎ এক রকম আত্মগোপনে চলে গেছেন।
এদিকে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া গোল্ডেন মনির তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের হওয়া তিনটি মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন বাড্ডা থানা পুলিশের হেফাজতে। পুলিশ জানায়, অস্ত্র ও মাদকের মামলা গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। গোল্ডেন মনিরের ফৌজদারি অপরাধের বিষয়টি পুলিশি তদন্তে গুরুত্ব পাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের অর্থপাচার এবং অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল সম্পদের বিষয়টি তদন্তের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধপথে চোরাচালানির মাধ্যমে কী পরিমাণ স্বর্ণ দেশে এনেছিলেন সে বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অনুসন্ধান করবে। আর অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং জালিয়াতি করে ভূমি দখল করার বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অনুসন্ধান চালাবে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে। অনুসন্ধানের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থা র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।
শুল্ক ফাঁকি দেওয়াসহ বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহার ও বিকিকিনির কারবারি বলে গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গতকাল র্যাব সদর দপ্তরে যান। অটো কার সিলেকশন নামে মনিরের গাড়ি বিক্রির যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও নানা ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। সংসদ সদস্যদের ব্যবহারের উদ্দেশে আমদানিকৃত শুল্কমুক্ত গাড়ি বিক্রির বেআইনি কা-ই শুধু নয়, এ প্রতিষ্ঠানে চোরাই গাড়ি বিক্রি হয় বলেও খবর একাধিক সূত্রের।
মনিরের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে শুরু করেছেন স্বর্ণের এ চোরাকারবারি। এসব তথ্যাদি যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের হওয়া মামলা দুটির তদন্ত কর্মকর্তা এবং বাড্ডা থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) ইয়াসিন গাজী গতকাল সোমবার আমাদের সময়কে জানান, গোল্ডেন মনিরকে চলমান রিমান্ডে দ্বিতীয় দিনের মতো জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।
সোনা শফির দেখা নেই : বন্ধ মোবাইল ফোন
অপকর্মের দোসর মনিরের বেগতিক অবস্থা দেখে হঠাৎ করেই আত্মগোপনে চলে গেছেন ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সোনা শফি। একাধিক সূত্রের খবর, হাজার কোটি টাকার মালিক সোনা শফি এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। কলেজে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তারে ব্যর্থ হয়ে গত ২০১৬ সালে কাঁচকুড়া কলেজের অধ্যক্ষ মো. জামাল উদ্দিনের ওপর হামলা চালায় সোনা শফি ও তার ক্যাডাররা। এ ঘটনায় শফির বিচার চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করেছিলেন অধ্যক্ষ মো. জামাল উদ্দিন। এলাকার আরও অনেকেই সোনা শফির ক্যাডার বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হয়। এতদিন তার দাপটে কেউ টুঁ শব্দটি করতে সাহস পাননি। এখন শঙ্কা-উদ্বেগ না কাটলেও কেউ কেউ মুখ খুলতে শুরু করেছেন তিনি পর্দার আড়ালে চলে যাওয়ায়। আমাদের সময়ের তরফে যোগাযোগের জন্য সোনা শফির ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাই এ বিষয়ে এ জনপ্রতিনিধির বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত গোল্ডেন মনিরের বাড্ডার বিলাসবহুল বাড়িতে সাড়ে ১২ ঘণ্টার অভিযান চালায় র্যাব, আটক করে গোল্ডেন মনিরকে। ছয় তলা ওই বাড়িতে নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা, ৯ লাখ টাকা মূল্যমানের ১০টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা, ৪ লিটার মদ, ৮ কেজি স্বর্ণ, একটি বিদেশি পিস্তল এবং কয়েক রাউন্ড গুলি জব্দ করে র্যাব। এ সময় র্যাব জানায়, নগদ এক হাজার কোটি টাকার মালিক গোল্ডেন মনির। এ ছাড়া ২০০১ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং গণপূর্ত ও রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভূমি জালিয়াতি শুরু করেন তিনি। এমনকি রাজউক থেকে প্লট সংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র চুরি করে; রাজউকের বিভিন্ন কর্মকর্তার দাপ্তরিক পদ-পদবির সিল ব্যবহার করে প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন। পূর্বাচল, বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে গোল্ডেন মনিরের রয়েছে ২০২টি প্লট। কাজ বাগিয়ে নিতে মন্ত্রীদের বিলাসবহুল গাড়িসহ নানা ধরনের উপঢৌকন দিতেও কার্পণ্য করতেন না স্বর্ণ চোরাচালানের কারণে নামের আগে ‘গোল্ডেন’ যুক্ত শঠ মনির।