ভারতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ তাদের ঝাড়খন্ড কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে আনার যে চিন্তা করছে তার ফল খুব সুখকর হবে না। এতে করে তারা তাদের নিজের ক্ষতিকেও ডেকে আনতে পারে। পাওনা আদায়ে সুবিধা করতে না পারায় আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে এবং বন্ধ করে দেয়ার হুমকিও দিয়েছে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিলে তাতে বাংলাদেশ কেবল বিদ্যুতের ঘাটতিতে পড়বে না বরং তার শিল্পেরও ক্ষতি হতে পারে। এসব বিষয় আদানির উচিত পর্যবেক্ষণ করা।
কারণ আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদার ১০ শতাংশেরও কম অবদান রাখে। ভারতীয় অনলাইন মিডিয়া দ্য প্রিন্টের বিশ্লেষণে এমনটিই বলা হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশ তাদের নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লা ও প্রাকৃতিক গ্যাস জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিলে যে ঘাটতি হবে তা মেটাতে প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বা পিডিবির হিসাবে ২০২২-২৩ সালে বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ ক্ষমতার ৬ শতাংশ আমদানি করা হয়েছে আদানি থেকে। এখন তা সামান্য বেড়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দক্ষিণ অঞ্চলের তুলনায় আদানি শক্তির ওপর বেশি নির্ভরশীল এবং সেখানে কিছুটা বিঘœ ঘটতে পারে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন প্রকৌশল বিভাগের ডিন এবং দেশের একজন বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেনের মতে, আদানি পাওয়ারের পদক্ষেপগুলো অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জন্য কোনো সমস্যা হতো না। তবে, এটি হয়নি। সমস্যা হলো, যদি আমরা এই ধরনের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন না করি, এমনকি যদি আপনি বিকল্প সরবরাহের পরিকল্পনা না করেন তবে বিদ্যুতের সরবরাহে ৫ শতাংশ হ্রাস পুরো বিদ্যুৎব্যবস্থাকে প্রভাবিত করবে। কারণ বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, কিন্তু পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় আমরা কয়লা আমদানি করতে পারছি না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪.৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে যা দুই বছর আগের ৩৫.৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। ইজাজ হোসেন বলেন, আদানি থেকে ঘাটতি মেটানোর জন্য আমরা আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখিনি। এখন তারা কয়লা অর্ডার করছে, যা মাসের শেষের দিকে আসবে, তবে এটি এখনো তিন সপ্তাহ দূরে।
বাংলাদেশী মিডিয়ায় ৪ নভেম্বরের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে, যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় অর্ধেক উৎপাদন করছে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতির মধ্যে, বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবেলায় বেশ কয়েকটি গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। কিন্তু ইজাজ হোসেন মনে করেন, আদানি পাওয়ারের সিদ্ধান্তের ফলে সৃষ্ট ঘাটতি কাটাতে এই প্ল্যান্টগুলো কোনো কাজে আসবে না। তবে কম বিদ্যুতের চাহিদার কারণে শীতকাল আসার সাথে সাথে বিঘœগুলো তুলনামূলকভাবে কম হবে। আগামী গ্রীষ্মে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল ২০২৫ এ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ নিয়ে ‘ভয়াবহ সঙ্কটে’ পড়তে পারে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব শিল্প এবং রফতানিকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতি করতে পারে। তাই আদানির ঋণ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ ১৭০ মিলিয়ন ডলারের জন্য যে একটি লাইন অফ ক্রেডিট ইস্যু করেছে তা ব্যর্থ হলে আদানি বাংলাদেশকে আরো চাপে ফেলতে চাইবে।
কিন্তু আদানি যদি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তাহলে কোম্পানিটিও বিপদে পড়বে। কারণ বর্তমানে তার গোড্ডা প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ বিক্রি করার আর কোনো জায়গা নেই। বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করে, যার মধ্যে গোড্ডায় আদানি গ্রুপের ঝাড়খন্ড প্ল্যান্ট থেকে বেশির ভাগ বিদ্যুৎ রফতানি হয়। এই অতি-সমালোচনামূলক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটিও ভারতে একমাত্র যেখানে এর ক্ষমতার ১০০ শতাংশ চুক্তিবদ্ধভাবে সরাসরি রফতানির সাথে যুক্ত। চুক্তি অনুসারে গোড্ডা প্ল্যান্ট থেকে ২৫ বছরের জন্য ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ সরবরাহ করার কথা।
ইজাজ হোসেন বলেন, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করা যায় কি না তাও গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ ১২,০০০ মেগাওয়াট গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেক ব্যবহার করা যাচ্ছে না পর্যাপ্ত গ্যাস নেই বলে। যে প্ল্যান্টগুলো উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে তার উৎপাদন ও অন্যান্য চলমান খরচ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরো সমস্যা সৃষ্টি করবে। বিদ্যুৎ সেক্টরের জন্য কিছুটা স্বস্তির খবর হচ্ছে দু’টি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কেন্দ্রের মধ্যে একটি, সামিট এলএনজি টার্মিনাল এই বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পর অবশেষে সেপ্টেম্বরে কার্যক্রমে ফিরে এসেছে। এখন জাতীয় গ্রিডে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) এলএনজি পাঠানোর জন্য জাহাজ থেকে জাহজে স্থানান্তর এবং এলএনজি আবার গ্যাসে রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু এখানেও ডলারের ঘাটতি সমস্যা তৈরি করবে। বাংলাদেশের সামিট এলএনজি টার্মিনালসহ প্রায় ১,১০০ এমএমসিএফডি-র মোট পুনঃগ্যাসেফিকেশন ক্ষমতা থাকলেও মাত্র ৬৫০ এমএমসিএফডি এলএনজি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে।
ইজাজ বলেন, শীতে চাহিদা কমে যায় বলে বিদ্যুৎচাহিদা সামাল দেয়া যাবে কিন্তু এর জন্য কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আগামী গ্রীষ্মে, মার্চ-এপ্রিলের পর আমাদের সম্পূর্ণ ১০০ শতাংশ আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন পড়বে। অন্যথায়, আমরা ভয়াবহ সঙ্কটে পড়ব। যত গ্যাস বিদ্যুৎ খাতে যাবে ততই শিল্পে এর ঘাটতি হবে। তাই কয়লা ব্যবহার বাড়াতে হবে, গ্যাস বাঁচিয়ে শিল্পে সরবরাহ ধরে রাখতে হবে।
বাংলাদেশকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করবে না আদানি : এই বছরের আগস্টে, ভারত সরকার তার বিদ্যুৎ রফতানি নিয়ম সংশোধন করে বিদ্যুৎ রফতানিকারকদের বিশেষ ক্ষেত্রে দেশের মধ্যে বিক্রি করার অনুমতি দেয়। তবে আদানি পাওয়ার এখনো তার গোড্ডা প্ল্যান্টকে ভারতীয় গ্রিডে সংযোগ করতে পারেনি কারণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপনের জন্য এটি সময় নিচ্ছে। এর মানে হলো, আদানি পাওয়ার যদি বাংলাদেশে তার সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়, তাহলে গোড্ডা প্ল্যান্টের উৎপাদিত বিদ্যুৎ কোথাও বিক্রি হবে না। বিদ্যুৎ খাতের ভারতীয় এক বিশ্লেষক প্রিন্টকে বলেন, অবশ্যই, আদানিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও বকেয়া পরিশোধের জন্য চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।