বিগত কয়েক দশকের সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে সুদানের আপাদকালীন সরকার এবং কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। চলমান সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারায় এবং দেশব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।
শনিবার দক্ষিণ সুদানের রাজধানী যুবায় একটি অনুষ্ঠানে সরকারের প্রতিনিধি এবং সুদানী বিপ্লবী ফ্রন্ট (এসআরএফ) নামে সশস্ত্র দলগুলির একটি জোট এই চুক্তি স্বাক্ষর করার সাথে সাথে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার এক বছর পর এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হল।
চুক্তির সমর্থনে অনুষ্ঠানটিতে চাদ, কাতার, মিশর, আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ থেকে আঞ্চলিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদগণ উপস্থিত ছিলেন।
“আজ আমরা একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছেছি । আমরা খুশি, আমাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে।”-দক্ষিণ সুদানী মধ্যস্থতাকারী দলের প্রধান টুট গাটলুয়াক চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কিছু সময় আগে বলেন।
অনুষ্ঠানে দক্ষিণ সুদান এবং সুদানের শিল্পীরা অতিথিদের জন্য বিনোদন পরিবেশন করেন । অন্যদিকে দারফুর, দক্ষিণ কর্ডোফান এবং ব্লু নাইলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা মিছিল করেছিল, আনন্দ গান গেয়েছিল এবং তাদের দলের নেতাদের ছবি সম্বলিত ব্যানার বহন করেছিল।
তবে দুটি শক্তিশালী বিদ্রোহী দল-আবদুলওয়াহিদ মোহাম্মদ আল-নুরের নেতৃত্বে দারফুর-ভিত্তিক সুদান মুক্তি আন্দোলন (এসএলএম) এবং আবদেল আজিজ আল-হিলুর নেতৃত্বে সুদান জনগণের মুক্তি আন্দোলন-উত্তর (এসপিএলএম-এন) চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। যা এখনো শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য বাধার দেয়াল হয়ে রয়েছে।
আল জাজিরার হিবা মরগান সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে জানিয়েছেন যে, যদিও যুবাতে স্বাক্ষরিত নথিকে “চূড়ান্ত চুক্তি” বলা হচ্ছে, দুটি মূল গোষ্ঠীর অনুপস্থিতি চুক্তিটির অসম্পূর্ণতা প্রকাশ পায়।
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক প্রবীণ সুদানী বিশ্লেষক জোনাস হর্নার আল জাজিরাকে বলেন, এসএলএম এবং এসপিএলএম-এন হলো সুদানের একমাত্র সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা অর্থবহ সামরিক ক্ষমতা সম্পন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী অঞ্চলগুলির প্রতিনিধিত্ব করে।
গত মাসে আল-হিলুর দল সরকারের সাথে আলাদা চুক্তিতে পৌঁছেছিল। যেখানে তারা সুদানের গঠনতন্ত্রকে পৃথক ধর্ম ও সরকার হিসাবে পরিবর্তন না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিল।
আল-হিলু আইন প্রণয়নে ধর্মের কোনও ভূমিকা না রেখে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এছাড়াও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ওমর আল-বশিরের মিলিশিয়াগুলি ভেঙে দেওয়ার এবং দেশের সামরিক বাহিনীকে নতুন করে সংস্কার করার আহ্বানও জানিয়েছে তারা। গ্রুপটি বলছে তাদের দাবিগুলি মানা না হলে, এটি দক্ষিণ কর্ডোফান এবং ব্লু নাইল প্রদেশগুলিতে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে।
প্রতিকূলতা এবং বিপদ
সুদানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অবসান করা ক্ষমতাসীন বড় সরকারটির শীর্ষস্থানীয় অগ্রাধিকার হবে। যেটি গত বছরের একটি উল্লেখযোগ্য গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহের মাধ্যমে আল-বশিরের সামরিক উত্থানের পর থেকে কার্যকর হয়।
এই চুক্তিতে বিদ্রোহীদের সুরক্ষা বাহিনীতে একীভূত করার, রাজনৈতিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করার এবং অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার থাকার শর্তাবলী রয়েছে। একটি নতুন তহবিল অনু’যায়ী দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের দরিদ্র গোষ্ঠীগুলি ১০ বছরের জন্য প্রতি বছরে ৭৫০ মিলিয়ন ডলার করে পাবে। এছাড়া বাস্তুচ্যুত লোকদের ফিরে আসার সুযোগের বিষয়েও অঙ্গীকার নেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লা হামদোক এবং অন্তর্বর্তী সার্বভৌম কাউন্সিলের প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান সহ সুদানের নেতারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন।
”শান্তিচুক্তিটি উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য বিস্তৃত দিগন্ত উন্মুক্ত করবে।”- তার আগমনের পরে এক বিবৃতিতে হামডোক এ কথা বলেছিলেন।
তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে ভবিষ্যতে সবকিছু সহজ হবে না।
”শান্তি-আনয়ন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিকূলতা এবং বিপদের মুখোমুখি হতে হয় যা আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং যৌথ পদক্ষেপের মাধ্যমে কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।”
আল-বশিরের নেতৃত্বাধীন তিন দশক সময়কালের আরব-অধ্যুষিত সরকার এবং এর প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনারব নৃগোষ্ঠী বিদ্রোহীদের মধ্যকার একাধিক দ্বন্দ্বে সুদান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
সুদানের বিস্তীর্ণ গ্রামীণ অঞ্চলে, স্থায়ী সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী কৃষকরা প্রায়শই আরব পশুপালকদের সাথে দুর্লভ সম্পদের জন্য টক্কর দেয়। পশুপালকরা প্রায়শই খার্তুমের সমর্থন পেয়ে থাকে।
অর্থনৈতিক জটিলতার ফলে সুদানে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। বিশেষত ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। বিচ্ছিন্নতার দরুন উত্তরাঞ্চল তাদের মজুদ করা তেলের তিন-চতুর্থাংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
১৯৫৬ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই দেশাটতে একাধিক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তন্মধ্যে ১৯৮৩-২০০৫ সালের চলমান যুদ্ধ দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী ।
জাতিসংঘ অনুসারে, দারফুরে ২০০৩ সাল থেকে চলমান বিধ্বংসী যুদ্ধে প্রথমদিকে কমপক্ষে ৩,০০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল এবং আড়াই মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।