আসসালামু আলাইকুম
আল্লাহর মা‘রেফত লাভের সঠিক উপায় ও তার আবশ্যকতা
মা‘রেফত শব্দটি আমাদের দেশে খুবই প্রসিদ্ধ শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে পরিচিতি লাভ করা, চেনা বা যথার্থভাবে কোনো কিছুকে আয়ত্ব করা। আল্লাহ তা‘আলাকে যথার্থভাবে আয়ত্ব করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেবল ততটুকুই কেউ লাভ করতে পারে যতটুকু তিনি দয়া পরবশ হয়ে প্রদান করবেন।
বস্তুবাদী নয় তথা আস্তিক মাত্রই তার স্রষ্টার মা‘রেফত লাভ করতে উদগ্রীব থাকে। সে জানতে চায় সে সত্তা সম্পর্কে যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে নিয়ামত দিয়ে অবগাহন করে চলেছেন। তার যাবতীয় প্রয়োজন নির্বাহ করে যাচ্ছেন। এ সত্তাকে জানার প্রয়োজনীয়তা সে সর্বদা অনুভব করে। এ পথে চলতে চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যায়। দীন ও ধর্মে বিশ্বাসী তথা ভাববাদী সকলেই এ অংশটুকুতে একমত। কিন্তু তাঁর মা‘রেফত বা পরিচয় কীভাবে লাভ করবে এ বিষয়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতি দেখা যায়।
· কারও কারও মতে, মা‘রেফত লাভের জন্য ভক্তিই যথেষ্ট। পূর্ণ ভক্তির মাধ্যমে পরিচর্যা করা হলেই কেবল স্রষ্টার মা‘রেফত হাসিল হবে। এ পথেই চলছে হিন্দু ধর্মের ভক্তিবাদী ও মুসলিম মরমী সুফী বলে পরিচিত বিশেষ ফকীররা। এরা ভক্তিমার্গে বিশ্বাসী।
ইসলাম এ জাতীয় ভক্তিবাদে বিশ্বাসী নয়। কারণ ভক্তিবাদ মানুষকে অন্ধ বানায়। ভক্তিবাদের পরিণতি হচ্ছে বৈরাগ্যপনা। যারাই এমন কোনো কিছু করতে চেয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরই লাগাম টেনে ধরেছেন। কুরআনে খৃষ্টানদের ভক্তিবাদকে সমর্থন জানানো হয়নি। হাদীসেও ভক্তিবাদকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কোনো কোনো সাহাবী ভক্তির আতিশয্যে বিয়ে না করার চিন্তা করলে, কোনো কোনো সাহাবী খোঁজা হতে চাইলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা থেকে তাদেরকে বিরত করেন।
· কারও কারও মতে, মা‘রেফত লাভের জন্য কর্মই যথেষ্ট। তারা মনে করে কর্মের মাধ্যমেই কেবল কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। সে কর্মটি হতে পারে, আপন অভিজ্ঞতা লব্ধ কাজ, অথবা পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া কোনো প্রক্রিয়া। এরা কর্মমার্গে বিশ্বাসী।
ইসলাম শুধু কর্মের মাধ্যমে মা‘রিফাত লাভ হবে কোথাও বলেনি। কোনো কোনো সাহাবী সুন্দর জায়গায় ইবাদতে লেগে যেতে চাইলে রাসূল তাকে তা করা থেকে কঠিনভাবে তিরষ্কার করেন।
· কারও কারও মতে, মা‘রেফত লাভের জন্য জ্ঞান সাধনাই করতে হবে। এরা জ্ঞানমার্গের অনুসারী। সে জ্ঞানের উৎস নির্ধারণে তারা কয়েক ভাগে বিভক্ত:
এক. জ্ঞান বলতে বুঝাবে, যা অভিজ্ঞতা লব্ধ কিংবা পূর্বসূরীদের থেকে প্রাপ্ত, এ পথেই চলছেন হিন্দু, বৌদ্ধ ও এ রকম জাগতিক ধর্মের অনুসারীরা।
দুই. জ্ঞান বলতে বুঝাবে, বিবেকপ্রসূত যুক্তি। তবে সে বিবেক অবশ্যই হতে হবে বিবেকবান বলে পরিচিত এমন লোকদের বিবেক। এ পথেই চলেছে তথাকথিত দার্শনিক ও কালাম শাস্ত্রবিদরা। এরা জ্ঞান মার্গের দাবীদার।
· অপর কারও মতে, মা‘রেফত লাভের জন্য দরকার জ্ঞান, কর্ম উভয়টিই জরুরী। তারা আবার দু’ভাগে বিভক্ত:
এক. তাদের কারও কারও মতে, জ্ঞানের উৎস হবে এমন কোনো গুরু কিংবা পীর; যার কথায় ভুল থাকতে পারে না। যার কথার বাইরে সত্য থাকতে পারে না। আর তার কর্মের উৎস হবে, গুরুর বক্তব্য ও নির্দেশনা। তিনি তাকে যেভাবে যা শিখাবেন তা বিনা বাক্যব্যয়ে প্রতিপালন করলেই শুধু তা পাবেন। এটি সাধারণত পীরপন্থী ও তাসাউফপন্থী লোকদের ভাষ্য।
কোনো সন্দেহ নাই যে, জ্ঞান ও কর্মের যথাযথ আল্লাহর মা‘রেফতের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু নিছক তাসাউফের উস্তাদের জ্ঞান ও তার তপস্যা বা সাধনার মাধ্যমে তা অর্জিত হওয়ার জিনিস নয়। যতটুকু তারা বিশুদ্ধ উৎস থেকে নিবেন আর যতটুকু বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে করবেন ততটুকুই শুদ্ধ হতে পারে। যদি কর্মসাধনা ভুলের ওপর হয় তবে তা কখনো কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনবে না। আল্লাহর মা‘রিফত হাসিল হবে না।
দুই. তাদের কারও কারও নিকট জ্ঞানের উৎস, হতে পারে বিবেকের যুক্তি, হতে পারে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রাপ্ত। কিন্তু কর্মের উৎস হতে পারে সত্যবাদীর দেয়া সত্য সংবাদ, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রাপ্ত, অথবা বিবেকের যুক্তি দ্বারা সমর্থিত। এ পথেই চলেছে পরবর্তী কালাম আশ‘আরী ও মাতুরিদী সম্প্রদায়ের শাস্ত্রবিদগণ।
এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, জ্ঞান ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর মারিফত লাভ ও তার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জ্ঞানের উৎস ও কর্মের বিশুদ্ধতা জরুরী। সেটা না হলে কখনও আল্লাহর মারেফত ও তার সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না।
· আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বক্তব্য হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার মা‘রেফাত লাভ অবশ্যই জরুরী বিষয়। জিন্ন ও মানব সকলের জন্যই তা অত্যাবশ্যক বিধায়, সেটা লাভ করা যেহেতু সকলের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়, সেহেতু আল্লাহ তা‘আলা সেটা লাভ করার উপায়সমূহও সহজ করে দিয়েছেন। তা পেতে হলে অবশ্যই তাকে নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে এগিয়ে যেতে হবে:
ক. আল্লাহর নাম ও গুণ জানার মাধ্যমেই তা জানতে হবে। আল্লাহর নাম ও গুণ ব্যতীত আল্লাহকে জানার সকল মাধ্যম কর্তিত। এ পদ্ধতি ব্যতীত কেউ আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে সামর্থ্য হবে না। যদি কেউ অন্য প্রকার চেষ্টা করে তবে সেটা ব্যর্থতার দিকেই নিয়ে যাবে। কোনো স্বচ্ছ ফল দিবে না। অন্ধকারে হাঁতড়ে মরতে হবে।
খ. আল্লাহর নাম ও গুণ জানার বিষয়টিও কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্য থেকেই নিতে হবে। কারণ জ্ঞানের মাধ্যম তিনটি.
এক. ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান। যা আল্লাহর জন্য প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। তাঁকে কোনো ইন্দ্রিয় পূর্ণভাবে আয়ত্ব করতে সক্ষম নয়।
দুই. নিছক বিবেকপ্রসূত যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। যা আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। যদি কোথাও সেটা প্রযোজ্য করা হয় তবে সেটা কোনো পূর্ণ জ্ঞান দিতে পারবে না। কারণ বিবেকের যুক্তি কেবল তখনই কার্যকর হয় যখন কোনো কিছু দেখা যায় বা তার মত কিছু দেখা যায় এ দু’টির কোনোটিই আল্লাহর জন্য দুনিয়াতে কারও অর্জিত হয়নি। বাকী থাকলো, বিবেকের যুক্তি দিয়ে কোনো কিছুর অস্তিত্ব সাব্যস্ত করা, সেটা বিবেকপ্রসূত যুক্তি দিয়ে সাব্যস্ত করা হলেও সে জ্ঞান অসম্পূর্ণই থেকে যাবে, পূর্ণতা লাভ করার সেখানে সুযোগ কোথায়?
তিন. বাকী থাকলো, সংবাদের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। সে সংবাদ যদি সত্যবাদীর হয় তাহলে তা আরও বেশি জ্ঞান প্রদান করে। আর যদি সত্যবাদীর কাছে সেটার প্রমাণাদি বিদ্যমান থাকে, সত্যবাদী সেটার পক্ষে সারাজীবন ব্যয় করে থাকেন তবে তার দেয়া প্রমাণ ও তার দেয়া বক্তব্য সেখানে অবশ্যই সঠিক জ্ঞান প্রদান করবে। আর সে প্রমাণাদিই হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্য।
গ. আল্লাহর নাম ও গুণের অর্থ ও মাহাত্ম্য যে যত বেশি জানবে তত বেশি সে আল্লাহর সম্পর্কে অবগত হতে পারবে। এ জন্য নবী-রাসূলগণ আল্লাহ সম্পর্কে বেশি জানতেন। এর বিপরীতে যারা যত বেশি যুক্তির অনুসরণ করেছে ততই বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে। যদি না সে যুক্তিকে আল্লাহর নাম ও গুণ বুঝার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে।
এ জন্য দেখা যায় পূর্বকালের আলেমগণ, যাহেদগণ, নেককার বান্দাগণ আল্লাহর পরিচয় লাভের জন্য সর্বদা আল্লাহর নাম ও গুণ নিয়ে আলোচনা করতেন। তাঁরা আল্লাহর নাম ও গুণকে সাব্যস্ত করতেন, নাম ও গুণের অর্থ নিয়ে চিন্তা করতেন। তাঁরা আল্লাহর নাম ও গুণ দ্বারা যেভাবে লাভবান হতেন তন্মধ্যে রয়েছে,
- এ নাম ও গুণ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার মা‘রেফাত বা পরিচয় লাভ করতেন। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে ও রাসূলের হাদীসে তাঁর নিজের পরিচয় তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ আয়াতুল কুরসী, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
- এ নাম ও গুণ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করতেন, তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করতেন। তাঁর যিকির করতেন, সর্বদা স্মরণ করতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা আল্লাহকে বেশি স্মরণ করো’। [সূরা আল-আহযাব: ৪১]
- এ নাম ও গুণ দিয়ে দো‘আ করতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম, তোমরা তাকে তা দিয়েই ডাক।’ [সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮০] অনুরূপ এক সাহাবী আল্লাহর নাম নিয়ে দো‘আ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন সে তো আল্লাহকে তাঁর মহা নাম দিয়ে ডেকেছে, যা দিয়ে কিছু চাওয়া হলে তিনি সাড়া দেন।
- এ নাম ও গুণের মাধ্যমে তাদের ঈমান বর্ধিত হতো। কারণ যখনই আল্লাহ তা‘আলার কোনো নাম ও গুণ জানবে তখনই তার কাছে মনে হবে যে, এর প্রভাব তার জীবনে রয়েছে।
- এ নাম ও গুণের মাধ্যমে একজন মানুষ তার জীবনে শক্তি ও দৃঢ়তা লাভ করতে পারে। যখনই সমস্যায় পড়বে তখনই আল্লাহর কোনো নাম বা গুণকে স্মরণ করে নিজেকে সুদৃঢ় ও আস্থাশীল করতে পারে।
- এ নাম ও গুণগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার অন্তর অধিক সম্পৃক্ত হয়। যখন সে জানবে যে রিযিক আল্লাহর কাছে তখনই সে আল্লাহর কাছেই রিযিক চাইবে, অন্য কারও কাছে নয়। যখনই সে জানবে আল্লাহ মহাদাপুটে তখন অন্য কারও দাপট তার কাছে হীন হয়ে যাবে। যখনই সে জানবে আল্লাহ তার সম্পর্কে জানেন, তাকে দেখছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন তখনি সে সাবধান হয়ে যাবে, এভাবে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে।
- এ নাম ও গুণগুলো জানার মাধ্যমে সে মহা সাওয়াব জান্নাতের অধিকারী হবে, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসে জানানো হয়েছে, “যে কেউ তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তাই যদি আল্লাহর মা‘রেফাত চান, আল্লাহকে রব হিসাবে মানতে চান, আল্লাহর ইবাদত সুন্দর করে করতে চান, আল্লাহর সন্তুষ্টি চান, আল্লাহর কাছে সাওয়াব চান, আল্লাহর দরবারে নাজাত চান তবে অবশ্যই আপনার উচিত আল্লাহর নাম ও গুণগুলোর যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান, সেগুলোর ওপর ঈমান আনয়ন। এর বাইরে মা‘রিফতের যত পদ্ধতিই মানুষ গ্রহণ করুক না কেন সবই ভুল ও মানুষের বানানো পদ্ধতি। আল্লাহর শেখানো পদ্ধতি থেকে তা অনেক দূরে।
আল্লাহর কাছে তাঁর সকল নাম ও সকল গুণের ওসিলা দিয়ে দো‘আ করছি, তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর মা‘রেফত দিয়ে ধন্য করেন। আমীন।