Monday, September 16, 2024
No menu items!

আমাদের মুসলিমউম্মাহ ডট নিউজে পরিবেশিত সংবাদ মূলত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সমাহার। পরিবেশিত সংবাদের সত্যায়ন এই স্বল্প সময়ে পরিসরে সম্ভব নয় বিধায় আমরা সৌজন্যতার সাথে আহরিত সংবাদ সহ পত্রিকার নাম লিপিবদ্ধ করেছি। পরবর্তীতে যদি উক্ত সংবাদ সংশ্লিষ্ট কোন সংশোধন আমরা পাই তবে সত্যতার নিরিখে সংশোধনটা প্রকাশ করবো। সম্পাদক

হোমদাওয়াআল কুরআনুল কারীম অনুধাবন-প্রথম পর্ব

আল কুরআনুল কারীম অনুধাবন-প্রথম পর্ব

শায়খ আনওয়ার আল আওলাকি

মহান আল্লাহ কুরআনের একটি আয়াতে আহলুল কিতাবদের সম্পর্কে বলেছেনঃ

“আর তাদের (ইয়াহুদিদের) মধ্যে রয়েছে নিরক্ষর লোক,যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া তাদের কিতাব সম্পর্কে জানে না,আর সেগুলো তো তাদের অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়।” (সূরাহ আল বাকারাহ,২ : ৭৮)

এই আয়াতে বলা হয়েছে, আহলুল কিতাবদের মধ্যে এমন অনেক নিরক্ষর (এখানে নিরক্ষর বলতে বুঝানো হয়েছে যে তারা আল্লাহর কিতাব অনুধাবন করতো না) লোক ছিল,যাদের সাথে কিতাব থাকার পরও তাদের কাছে কোন দলীল ছিল না যে তাদের কিতাব আসলে কোন বিষয়ে আলোচনা করছে। তারা তাদের কিতাব থেকে সেগুলোই শিখতো, যেগুলো তাদের পার্থিব বিষয় সম্পর্কে মানানসই হতো। তারা সেখান থেকে যা কিছুই শিখতো, সেগুলো তারা বেছে বেছে গ্রহন করতো। যদি সেগুলোর মধ্যে কোনোটি তাদের পার্থিব জীবনের জন্য উপকারী হতো তবে তারা সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহন করতো, আর তা না হলে তারা সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতো।

তো এই আয়াত আসলে কি অর্থ প্রকাশ করে ? ইবন তাইমিয়াহ বলেছেন,“ইবন আব্বাস (রাঃ) ও কাতাদাহ (রাঃ) এই আয়াতের “উম্মিইয়্যুন” (নিরক্ষর) শব্দের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটি হল এমন – “তারা কিতাবের অর্থ বুঝতো না। তারা কিতাব শিখতো,তা মুখস্ত করতো আর না বুঝেই তাদের কিতাব তিলাওয়াত করতো। এই আয়াতে উল্লেখকৃত ‘নিরক্ষর’ শব্দটি দিয়ে এটি বুঝানো হচ্ছে না যে, তারা পড়তে বা লিখতে পারতো না। বরং তারা তাদের কিতাব পড়তো,মুখস্ত করতো আর সে কিতাব শিক্ষাও দিতো, যদিও তারা কিতাবের আলোচ্য বিষয় বুঝতো না। তারা কেবলমাত্র কিতাব তিলাওয়াত করেই সন্তুষ্ট হতো।”

আমাদের এই বর্তমান সময়ে আপনি দেখতে পাবেন যে, টেলিভিশন স্টেশন আর রেডিও স্টেশনগুলো কুরআন সম্প্রচার করছে। তারা এটি করে কারন তারা জানে যে লোকেরা কুরআনের অনুসরণ করবে না, বরং তারা কুরআনের অর্থ না বুঝে কেবলই তা শুনে যেতে থাকবে। এমনকি ইসরাইলেও তারা কুরআন সম্প্রচার করে! এই সমস্যাটা আজ আমাদের মধ্যে বিরাজ করছে। সুবহান-আল্লাহ! কুরআনের এই আয়াত যে অর্থটি নির্দেশ করছে ঠিক তেমন অবস্থাই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি।

ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন যে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছু একটা বললেন, এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“যখন ইলম হারিয়ে যাবে তখন এমনটি ঘটবে।” সাহাবীদের মধ্যে একজন [ইবন লুবাইদ (রাঃ)] বললেন, “ইয়া রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম), ইলম কিভাবে হারিয়ে যেতে পারে যখন কিনা আমরা কুরআন অধ্যয়ন করছি, এটি আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দিচ্ছি আর আমাদের সন্তানেরা অন্যদের শিক্ষা দিবে ?” রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“দুর্ভোগ তোমার জন্য! আমি ভেবেছিলাম তুমি মদিনার সবচেয়ে শিক্ষিত লোকদের একজন। তুমি কি দেখছো না, ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে তাদের কিতাব (তাওরাত ও ইঞ্জিল) থাকার পরও সেখান থেকে তারা কোন উপকার পাচ্ছে না ?”

কুরআন তো সেলফে কাপড় দিয়ে ঢেকে সাজিয়ে রাখার মতো কিছু না। আবু দারদা (রাঃ) বলেন,“যখন শেষ যুগ আসবে, তখন তোমরা তোমাদের মসজিদগুলো আর মুসহাফগুলো (কুরআনের সংকলিত কপি যা আমরা একটি কিতাব হিসেবে দেখি) সাজিয়ে রাখবে,এটিই হল সেই সময় যখন তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে, কারন এটি একটি ইঙ্গিত যে তোমরা (কুরআনের) বিষয়বস্তুর তুলনায় এর প্রতীকের (কুরআন সাজিয়ে রাখার) পক্ষে অবস্থান গ্রহন করছো।”

আবু দারদা (রাঃ) এর সময়ে কুরআন লিখে রাখা হতো হাড়,পাতা আর চামড়ার টুকরোতে। আর বর্তমানে কুরআন এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয় যে, লোকেরা এমনকি সেটি ছুঁতে আর পড়তে চায় না, কারন এটি তো দেখতে খুবই সুন্দর লাগে! যদি লোকেরা দেখতো যে, কুরআনকে হাড় বা কোন টুকরোতে লিখে রাখা হয়েছে তবে তারা সাথে সাথেই বলতো যে, এমন কাজ করার মাধ্যমে কুরআনকে অসম্মান করা হয়েছে। এরপরও লোকেরা এটি চিন্তা করে দেখে না যে কুরআন অনুসরণ না করাই হল কুরআনকে অসম্মান করা। কুরআন আমাদের জন্য কি করতে পারে, আর আমাদের কিভাবে আল্লাহর এই কিতাব অধ্যয়ন করা দরকার – সে পথ থেকে আজ আমরা হারিয়ে গিয়েছি। আল্লাহ বলেনঃ

“(এটি) একটি কিতাব (কুরআন),আমরা এটি তোমার উপর নাযিল করেছি (যা আল্লাহর) রহমতে পরিপূর্ণ,যাতে করে তারা এর নিদর্শনগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে আর জ্ঞানবান লোকেরা তা থেকে উপদেশ গ্রহন করে।” (সূরাহ সোয়াদ,৩৮ : ২৯)

“তবে কি তারা কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে না, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে আছে (কুরআন অনুধাবনের ব্যাপারে) ?” (সূরাহ মুহাম্মাদ,৪৭ : ২৪)

আল্লাহ আমাদেরকে কেবলমাত্র কুরআন তিলাওয়াতের জন্য আহবান করছেন না বরং তিনি আমাদেরকে আহবান করছেন কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য। আমাদেরকে “তাদাব্বুর” (গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করা) করতে হবে।

সাহাবীরা কিভাবে কুরআন অধ্যয়ন করতেন ? আমরা এর একটি উদাহারন হিসেবে আবদুল্লাহ ইবন উমার (রাঃ) এর দিকে তাকাই। তিনি বলেছেন,“সুরা বাকারাহ হিফয করা শেষ করতে আমার ১৪ টি বছর সময় লেগেছে।” তিনি এটি করার পর খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন,তিনি বলেছেন,“আর এরপর আমি একটি উট জবাই করে লোকদের আমন্ত্রন করলাম।” এটি তার জন্য এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল যে, তিনি সেদিন এ কারনে লোকদের দাওয়াত করে রীতিমত উৎসবের দিন করে ফেলেছিলেন। আমরা এখন কুরআন এক বছরের মধ্যেই মুখস্ত করতে পারি, আবদুল্লাহ ইবন উমার (রাঃ) এর ক্ষেত্রে কিভাবে দীর্ঘ ১৪ বছর সময় লাগলো ?

এর কারন হল সেটিই,যা একজন তাবিঈন বর্ণনা করেছেন এভাবে – “আমি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কয়েকজন সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেছিলাম, তারা আমাকে বললেন যে, তারা যেভাবে কুরআন অধ্যয়ন করতেন সে পদ্ধতি ছিল এমন – তারা দশটি আয়াত গ্রহন করতেন, এরপর সেই দশটি আয়াত অধ্যয়ন করতেন, তারা সেসব আয়াতে ঈমান,ইলম,হালাল ও হারাম সম্পর্কে অধ্যয়ন করতেন, এরপর পরবর্তী দশ আয়াতে চলে যেতেন। তারা সেই দশ আয়াত তাদের জীবনে প্রয়োগ করার আগ পর্যন্ত পরবর্তী আয়াতে যেতেন না,এটি তাদের জীবনে প্রানবন্ত ও দ্বিতীয় স্বভাব না হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা এমনটি করতেন। এটি শুধু একজন সাহাবী নয়, বরং অনেক সাহাবী কতৃক বর্ণিত হয়েছে।”

ইমাম আহমাদ আল গাযালি (রহ.) বলেন,“দশ বছর বয়সে আমি কুরআন হিফয করেছিলাম। আমি কুরআন হিফযের সেই পদ্ধতির (অনুধাবন না করে আর অর্থ না বুঝে শুদুমাত্র তিলাওয়াত করে হিফয করার পদ্ধতি) কারনে বড় হওয়ার পর যখন আল্লাহর কিতাব অনুধাবনের চেষ্টা করি, তখন আমার কাছে এই ব্যাপারটি খুবই কঠিন মনে হল কারন আমাকে শুধুমাত্র আয়াতের পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমেই কুরআন হিফয করা শিখানো হয়েছিলো। এই চক্রটি ভেঙ্গে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আর আল্লাহর কালাম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করার আগ পর্যন্ত আমাকে প্রচুর চেষ্টা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিলো।”

তিনি এমন একটি সমস্যার কথা বলেছিলেন যেটা বর্তমানে এই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায়ও বিদ্যমান রয়েছে। তিনি বলেছেন শিশুদের মধ্যে না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করে কুরআন হিফযের এক সাধারণ পদ্ধতির ব্যাপারে। আল্লাহর কিতাব বুঝার জন্য আমাদেরকে প্রচণ্ড রকম প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। মূল ব্যাপার তো হল এই যে,আল্লাহ আমাদের উপর কুরআনের মণি-মুক্তো এমনিতেই বর্ষিত করবেন না। যদি আমরা এই কিতাব শেখার জন্য আর এটি থেকে হিদায়াত পাওয়ার জন্য আগ্রহী না হই, তবে এই কিতাব আমাদের কোন উপকার করবে না। এটি হল কুরআনের একটি আকর্ষণীয় দিক। আল্লাহ বলেনঃ

“আমি কুরআনে যা নাযিল করেছি তা হল মুমিনদের জন্য (তাদের রোগের) উপশমকারী ও রহমত, কিন্তু এ সত্ত্বেও তা যালিমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না।”(সূরাহ আল-ইসরা,১৭ : ৮২)

কুরআন কিছু লোককে কাছে টেনে নিয়ে আসে আর কিছু লোককে দূরে সরিয়ে দেয়। যদি আপনি কুরআন থেকে উপকার পেতে চান তবে আপনি এটি থেকে সেটিই পাবেন, আর যদি তা না চান, এরপরও আল্লাহ তার কিতাবকে সম্মানিত করবেন। এটি হল মহান আল্লাহ’র স্বতন্ত্রতার অংশ।

এখানে আলোচ্য বিষয় এটি না যে সুরা বাকারা শিখার জন্য আমরা ৪০ বছর সময় ব্যয় করব বরং ব্যাপারটা হল এমন যে, আমরা যা শিখছি তা বাস্তবে প্রয়োগ করছি কিনা সেটি সুনিশ্চিত হওয়া। রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,“এ পৃথিবীর শেষ যুগে বোকামিপূর্ণ চিন্তা আর ধারনা বিশিষ্ট যুবকদের দেখা যাবে। তারা ভাল কথা বলবে কিন্তু ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে ঠিক সেভাবে, যেভাবে তীর একটি ধনুক থেকে বের হয়ে যায়,তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না …” (বুখারি)

এ যুগে কুরআন তিলাওয়াত করা হয় কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে বা শেষে। লোকেরা তাদের পুরো জীবন অতিক্রম করে কুরআনকে সেলফে বসিয়ে রাখার মাধ্যমে, আর যখন তারা মারা যায় তখন লোকেরা এটি সেলফ থেকে বের করে আনে আর সেখান থেকে কিছু অংশ তিলাওয়াত করে, এরপর এই কুরআনকে আবারো সেই সেলফে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কোন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা হয় আর কেউ মারা গেলে সুরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করা হয় – কুরআনের হক আদায়ের জন্য লোকেরা এসব করে! সুবহান-আল্লাহ! প্রথম যুগের মুসলিমদের (সাহাবীদের) জন্য আল্লাহ’র কিতাব ছিল একটি প্রবাহমান শক্তি। সাহাবীদের সেরকম ভিন্ন হওয়ার কারন কি ছিল ? কারনটি ছিল কুরআন,আর কিছুই না। এই কুরআনই সাহাবীদের পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিয়েছিলো তাদেরকে নিন্মস্তর থেকে উচ্চস্তরের মনুষ্যত্বে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে। আমাদের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটবে যদি আমরা কুরআনের উপর তাতাব্বুর (গভীরভাবে চিন্তাভাবনা) করি।

মুজাহিদ (রহ.) ছিলেন কুরআনের মুফাসসিরদের মধ্যে একজন। তিনি ইবন আব্বাস (রাঃ) এর কাছে কুরআন শিখতেন। তার নাম তাফসিরের কিতাবগুলোতে উল্লেখ করা হয়। তিনি ছিলেন ইবন আব্বাস (রাঃ) এর একজন ছাত্র। বলা হয়ে থাকে, তিনি ইবন আব্বাস (রাঃ) এর সাথে তিনবার পুরো কুরআন তিলাওয়াত করেন,প্রত্যেক আয়াতে এসে পৌঁছানোর পর তিনি ইবন আব্বাস (রাঃ) কে সেই প্রতিটি আয়াত সম্পর্কেই জিজ্ঞেস করতেন। মুজাহিদ (রহ.) বলেন,“প্রত্যেক আয়াত তিলাওয়াতের পর আমি থেমে গিয়ে ইবন আব্বাস (রাঃ) কে সেই আয়াতের অর্থ সম্পরলে জিজ্ঞেস করতাম।”

আল্লাহর কিতাবকে সাথে নিয়ে জীবন পরিচালনা করা আর একে খুব সিরিয়াসলি গ্রহন করা এটি দাবী করে যে, আমরা আল্লাহর কিতাবকে ভালবাসবো। কুরআনের সাথে নিজেদের সংযুক্ত না রেখেই যদি আমরা তা তিলাওয়াত করি, তবে আমরা তা থেকে উপকার পাব না। এটি বুঝা যায় উসমান ইবন আফফান (রাঃ) এর এই উক্তি থেকে – “যদি অন্তরগুলো বিশুদ্ধ হয়, তবে সেগুলো আল্লাহর কিতাবের তৃষ্ণায় কখনও পরিতৃপ্ত হবে না।” আমরা যদি আল্লাহর কিতাবকে ভালবাসি, তবে আমরা কখনোই যথেষ্ট পরিতৃপ্ত হবো না।

যখন তাবিঈনদের একজন ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবন উমার এর জীবনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে চাচ্ছিলেন, তখন তিনি আবদুল্লাহ ইবন উমারের দাসের কাছে তার ইবাদাতের ব্যাপারে জানতে চাইলে সে বললঃ “তিনি সালাত আদায় করতে যেতেন আর মধ্যবর্তী সময়টাতে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।” এটি ছিল এমনই এক সাধারণ ব্যাপার। যদি তিনি ব্যাবসা বা অন্য কিছুর সাথে জড়িত না থাকতেন, তবে বাসায় থাকার সময়টাতে তিনি এটি করতেন। আমাদের জীবনের সাথে এর কি তুলনা হতে পারে যেখানে আমাদের মাসের পর মাস অতিক্রান্ত হয় আর আমরা আল্লাহর কিতাব খুলেও দেখি না! আবদুল্লাহ ইবন উমারের জীবনটা কুরআনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।

উসমান ইবন আফফান (রাঃ) কিয়ামুল লাইল (রাত্রিকালীন সালাত) শুরু করার পর দুই রাকআতে যে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করতেন তাতে তার রাত অতিবাহিত হয়ে যেতো,এরপরও তার সেই দুই রাকআত সালাত শেষ হতো না। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা সালাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর আমরা নিশ্চিত যে তিনি এতে কোন রকম বিরক্তি বা যন্ত্রণা অনুভব করতেন না, কারন এটি ছিল আল্লাহর কিতাবের সাথে তার সম্পৃক্ততা। আল্লাহ তার জন্য এটি সহজ করে দিয়েছিলেন।

রসুলুল্লাহ (সালাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কিয়ামুল লাইলের ব্যাপারে আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ “রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার পায়ের চামড়া ফেটে যেতো। আমি তাকে (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করলাম,“আপনি কেন এমনটি করছেন, যখন কিনা আপনার আগে-পরের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে ?” তিনি (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,“আমি কি আল্লাহর শোকরকারী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হবো না ?” (বুখারি ও মুসলিম)

রসুলুল্লাহ (সাল্লালাহু ) আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে সালাতে লিপ্ত হতেন যে, এর দীর্ঘতার কারনে তার (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন বিরক্তি আসতো না। অপর একটি হাদিসে রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাত সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হল সালাত।”

আমাদের যেটা করা দরকার, সেটি হল আল্লাহর কিতাবের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা আর কুরআন অধ্যয়ন থেকে সরে না যাওয়া। অন্যান্য ইসলামিক জ্ঞান বিজ্ঞানও অধ্যয়ন করা ভালো তবে সেগুলো কুরআন অধ্যয়নের উপায়ে হতে দেওয়া যাবে না। অনেক সময় আমরা কুরআন বাদ দিয়ে সব কিছুই অধ্যয়ন করি, আর মনে করি যে আমরা অনেক কিছুই জেনে ফেলেছি। আমরা যদি কুরআন অধ্যয়ন না করি, তবে এটি চিন্তা করাটা সন্দেহযুক্ত হয়ে পড়বে যে, আমরা যা জানি তা আসলেই পর্যাপ্ত কিনা। কুরআন নিয়ে আমাদের একটি ব্যাপক বুঝ থাকা দরকার – সেটি কেবলমাত্র কোন একক ধাপে নয় বরং যে উপায়ে আমরা পৃথিবী দেখি আর বুঝি সে উপায়েও এটি করা দরকার।

এর একটি উদাহারন হল – সাহাবীরা কুরআন তিলাওয়াত করতেন আর এটি ছিল তাদের জন্য জ্ঞানের একমাত্র উৎস। ইসলামপূর্ব সময়ে তারা ছিলেন জ্ঞানহীন নিরক্ষর লোক। কোন এক ঘটনায় কয়েকজন সাহাবী দেখতে পেলেন যে, উমার ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) প্রথমে হাসলেন, আর এরপর তিনি কাঁদতে লাগলেন। সাহাবীরা তার কাছে জানতে চাইলেন কি কারনে তার এমনটা হলো। তিনি বললেন,“আমি জাহিলিয়্যাহ’র দিনগুলোর কথা মনে করছিলাম। আমার কাছে খেজুরের তৈরি প্রতিমা থাকতো। একদিন আমি এতোই ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লাম যে, আমি এর একটিকে খেয়ে ফেললাম। এটি মনে পড়ার পর আমি হাসলাম। আর এরপর আমি কাঁদলাম একারনে যে, আমার মনে পড়লো আমি একটি গর্ত খুঁড়ে আমার মেয়েকে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলাম। যখন আমি তাকে গর্তে রাখলাম, তখন সে তার হাত তুলে আমার দাঁড়ি থেকে ধুলো ঝেড়ে দিলো।”

মুসলিম হিসেবে এই ঘটনাগুলোর কারনে তিনি হেসেছেন আর এরপর কেঁদেছেন। ইসলামে না থাকা অবস্থায় এই মুহূর্তগুলো তার কাছে মজার বা দুঃখজনক ছিল না, বরং সেগুলো ছিল সাধারণ। ইসলামে না থাকা অবস্থায় খেজুরের তৈরি প্রতিমাকে সিজদাহ করার পর সেটিকেই খেয়ে ফেলা অবশ্যই চমৎকার আর গ্রহণযোগ্য, আর একটি জ্যান্ত কন্যা শিশুকে হত্যা করাও গ্রহণযোগ্য। ইসলামই তো উমার (রাঃ) কে পরিবর্তন করে দিলো। আর এক্ষেত্রে মূল বিষয়টি ছিল কুরআন। সুতরাং সাহাবীদের মধ্যে কুরআন ছাড়া কিছুই ছিল না,তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষাও ছিল না। ইসলাম গ্রহনের পর তাদের কাছে ছিলো সে জ্ঞানটিই, যা তারা আল্লাহর কিতাব থেকে শিখতে পেরেছিলেন।

আনাস ইবন মালিক (রাঃ) এর মা উম্ম মাহারা (রাঃ) কুরআন অধ্যয়ন করে বুঝতে পেরেছিলেন যে আল্লাহর এ দ্বীন ইসলাম বিস্তার লাভ করবে আর ভুমি ও সমুদ্রপথে  জিহাদ পরিচালিত হবে। তাই তিনি রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে বললেন,“যারা সমুদ্রপথে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ করতে বের হবেন, আমি তাদের মধ্যে একজন হতে চাই।” (নোটঃ মক্কা ও মদিনার লোকদের জন্য এটি ছিল অস্বাভাবিক, কারন তারা সাধারনত সমদ্রপথে আসা যাওয়া করতো না। আরবদের কোন সামরিক নৌবাহিনী বা সমুদ্রপথে বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল না। তারা ভুমি ব্যবহার করেই ইয়েমেন ও শামের সাথে ব্যবসা করতো। উপকূলবর্তী লোকদেরই সমুদ্রের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা ছিলো, আর সে সময় এমন কোন সাহাবী ছিলেন না যারা উপকূলবর্তী অঞ্চলে বাস করতেন) রসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) এ মহিলা সাহাবীর জন্য দুয়া করলেন যাতে তিনি সেই ব্যক্তিগুলোর মধ্যে একজন হতে পারেন। পরবর্তীতে মুওাওিয়া বিন আবি সুফইয়ান (রাঃ) এর খিলাফাহ চলাকালীন সময়ে যেসব মুজাহিদ সমুদ্রপথে জিহাদের জন্য যোগদান করেন, তিনি তাদের একজন হোন। কুরআন অধ্যয়নের মাধ্যমে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আল্লাহ সমুদ্রপথকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবেন। আল্লাহ বলেছেনঃ

“তিনিই সমুদ্রকে (তোমাদের) অধীনস্থ করে দিয়েছেন,যেন তার মধ্য থেকে তোমরা তাজা মাছ খেতে পারো এবং তা থেকে তোমরা (মণিমুক্তার) গহনাও আহরণ করো,যা তোমরা পরিধান করো,তোমরা দেখতে পাচ্ছো কিভাবে এর বুকে জলযানগুলো এগিয়ে চলে, যেন এর মাধ্যমে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো,(সর্বোপরি) তোমরা যেন তার (নিয়ামতের) কৃতজ্ঞতা আদায় করো।” (সূরাহ আন-নাহল,১৬ : ১৪)

যদিও তিনি কখনও সমুদ্রে যান নি,এরপরও তিনি কুরআন পাঠের মাধ্যমে জানতে পারলেন যে, একদিন এই দ্বীন ইসলাম সমুদ্রপথের মধ্য দিয়েও বিস্তার লাভ করবে।

বর্তমানে বিশ অথবা ত্রিশ হাজার জাহাজ বিশ্বের সমুদ্রপথগুলোতে চলাচল করছে। সমুদ্রগুলো ভুপৃষ্ঠের ৮/১০ ভাগ অবস্থান জুড়ে বিরাজ করছে। এই জাহাজগুলোর একটিও মুসলিমরা নির্মাণ করে নি। একটি সাবমেরিনও মুসলিমরা তৈরি করে নি। সুতরাং উপরে উল্লেখ করা সেই আয়াতে যা উল্লেখ করা হয়েছে সেটির ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কোথায় ? কুরআন নিয়ে আমাদের অনুধাবনের অবস্থানটা কোথায় ? যদিও সাহাবীদের সাথে সমুদ্রের কোন সংস্পর্শই ছিলো না, কিন্তু এরপরও তারা অবিলম্বে নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। মুওাওিয়াহ ইবন আবি সুফইয়ান (রাঃ) ছিলেন ইসলামিক নৌবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা, আর একই সাথে ইসলামিক বাণিজ্যিক নৌবহরের প্রতিষ্ঠাতাও, এরপর কয়েক শতাব্দির জন্য মুসলিমরা পুরো বিশ্বে প্রভাবশালী বাণিজ্যিক শক্তিতে পরিণত হলো সেই সামরিক নৌবাহিনী আর বাণিজ্যিক লেনদেনের কারনে। সুতরাং এটি পরিস্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহর কিতাব সঠিকভাবে অনুধাবনের ব্যাপারে আমরা অনেক দূরেই আছি।

আমরা আল্লাহর কাছে দুয়া করছি তিনি যেন আমাদেরকে তার দ্বীনের ব্যাপারে ফিকহ (বুঝ) দান করেন আর আমাদের সকলকে কল্যাণ দান করেন,আমিন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

3 + 17 =

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য