তাফসীর সূরা “আল-লাহাব”
নামকরণ:
প্রথম আয়াতের লাহাব (لَهَبٍ) শব্দ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ এ সূরাটি কে শেষ আয়াতের ‘মাসাদ’ ( مسد ) শব্দ থেকে ‘মাসাদ’ নামেও নামকরণ করেছেন।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এই সূরাটি মক্কী হবার ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাওয়াতের বিরুদ্ধে আবু লাহাবের যে ভূমিকা এখানে দেখা গেছে তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, এ সূরাটি এমন যুগে নাযিল হয়ে থাকবে যখন রসূলের (সা.) সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে সে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি ইসলামের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধার সৃষ্টি করেছিল।
আবু লাহাবের পরিচয়:
সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা। রসূলের (সা.) পিতা এবং এ আবু লাহাব ছিল একই পিতার সন্তান। আরবে চাচাকে বাপের মতই মনে করা হতো। বিশেষ করে যখন ভাতিজার বাপের ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল তখন আরবীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী চাচার কাছে আশা করা হয়েছিল, সে ভাতিজাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু এ ব্যক্তি ইসলাম বৈরিতা ও কুফরী প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে এ সমস্ত আরবীয় ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছিল।
নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট:
মুফাসসিরগণ ইবনে আব্বাস থেকে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বসাধারণের কাছে দাওয়াত পেশ করার হুকুম দেয়া হলো এবং কুরআন মজীদে এ মর্মে সূরা আশ-শুআরা:২১৪ নম্বর আয়াতে নির্দেশ দেয়া হলো:
وَ اَنْذِرْ عَشِیْرَتَكَ الْاَقْرَبِیْنَۙ
“আপনি আপনার নিকটতম আত্নীয়-পরিজনদেরকে ভয় দেখাও”
নির্দেশ পাওয়ার পর সকাল বেলা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠে বুলন্দ আওয়াজে চিৎকার করে বললেন يا صباحاه (হায়, সকাল বেলার বিপদ!)
আরবে এ ধরনের আওয়াজ এমন এক ব্যক্তি দিয়ে থাকে যে ভোর বেলার আলো আঁধারীর মধ্যে কোন শত্রুদলকে নিজেদের গোত্রের ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে থাকে। রসূলুল্লাহর (সা.) এ আওয়াজ শুনে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কে আওয়াজ দিচ্ছে? বলা হলো মুহাম্মাদ (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আওয়াজ দিচ্ছেন। একথা শুনে কুরাইশদের সমস্ত পরিবারের লোকেরা দৌঁড়ে গেলো তাঁর দিকে । যে নিজে আসতে পারতো সে নিজে এসে গেলো এবং সে নিজে আসতে পারতো না সে তার একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল। সবাই পৌঁছে গেলে তিনি কুরাইশের প্রত্যেকটি পরিবারের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে বললেন: হে বনী হাশেম! হে বনী আবদুল মুত্তালিব! হে বনী ফেহর! হে বনী উমুক! হে বনী উমুক! যদি আমি তোমাদের এ কথা বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে রয়েছে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য, তাহলে আমার কথা কি তোমরা সত্য বলে মেনে নেবে? লোকেরা জবাব দিল, হ্যাঁ, আমরা কখনো আপনার মুখে মিথ্যা কথা শুনিনি। একথা শুনে তিনি বললেন: তাহলে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আগামীতে কঠিন আযাব আসছে।
একথায় অন্য কেউ বলার আগে তাঁর নিজের চাচা আবু লাহাব বললো: تَبًّا لَكَ أَلِهَذَا جَمَعْتَنَا “তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি কি এজন্য আমাদের ডেকেছিলে?” তখন এই সূরাটি নাযিল হয়।
অন্য একটি হাদীসে একথাও বলা হয়েছে, সে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য একটি পাথর উঠিয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর ইত্যাদি)।
ইবনে যায়েদ বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে: আবু লাহাব একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, “যদি আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করি তাহলে এর বদলে আমি কি পাবো? তিনি জবাব দিলেন, অন্যান্য ঈমানদাররা যা পাবে আপনিও তাই পাবেন।
আবু লাহাব বললো: আমার জন্য কিছু বাড়তি মর্যাদা নেই? জবাব দিলেন: আপনি আর কি চান? একথায় সে বললো:
تَبَّا لَهَذَا الدِّيْنَ تَبَّا اَنْ اَكُوْنَ وَهَوْلَاءِ سَوَاءً
“ধ্বংস হোক এইদিন যেখানে আমি এবং অন্যান্য লোকেরা সবাই সমান”।
রাসূল (সঃ) দাওয়াতের বিরোধিতায় আবু লাহাবের ভূমিকা:
মক্কায় আবু লাহাব ছিল রসূলুল্লাহর (সা.) নিকটতম প্রতিবেশী । উভয়ের ঘরের মাঝখানে ছিল একটি প্রাচীর। এছাড়াও হাকাম ইবনে আস (মারওয়ানের বাপ), উকবা উবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা ও ইবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশী ছিল। এরা বাড়িতেও রসূলুল্লাহকে নিশ্চিন্তে থাকতে দিতো না। তিনি যখন নামায পড়তেন, এরা তখন ওপর থেকে ছাগলের নাড়িভূড়ি তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করতো। কখনো তাঁর বাড়ির আঙিনায় রান্নাবান্না হতো এরা হাঁড়ির মধ্যে ময়লা ছুঁড়ে দিতো।
রসূলুল্লাহ (সা.) বাইরে এসে তাদেরকে বলতেন, “হে বনী আবদে মান্নাফ! এ কেমন প্রতিবেশী সূলভ আচরণ?”
আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল (আবু সুফিয়ানের বোন) প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরের দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিতো। এটা ছিল তার প্রতিদিনের স্থায়ী আচরণ। যাতে রসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর শিশু সন্তানরা বাইরে বের হলে তাদের পায়ে কাঁটা বিঁধে যায়। (বায়হাকী, ইবন আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির ও ইবনে হিশাম)।
নবুওয়াত লাভের পূর্বে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুই মেয়েকে আবু লাহাবের দুই ছেলে উতবা ও উতাইবার সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। নবুওয়াতের পরে যখন তিনি ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখন আবু লাহাব তার দুই ছেলেকে বলে, তোমরা মুহাম্মাদের (রসুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়েদের তালাক না দিলে আমার পক্ষে তোমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাত হারাম হয়ে যাবে। কাজেই দু’জনেই তাদের স্ত্রীদের তালাক দেয়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেখানে যেখানে ইসলামের দাওয়াত দিতে যেতেন আবু লাহাবও তাঁর পেছনে পেছনে সেখানে গিয়ে পৌঁছতো এবং লোকদের তাঁর কথা শুনার কাজে বাধা দিতো।
রাবী’আহ ইবনে আব্বাদ আদদীলী (রা.) বর্ণনা করেন, আমি একদিন আমার আব্বার সাথে যুল-মাজাযের বাজারে যাই। তখন আমার বয়স ছিল কম। সেখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লামকে দেখি। তিনি বলছিলেন: “হে লোকেরা! বলো, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। একথা বললেই তোমরা সফলকাম হয়ে যাবে।” এ সময় তাঁর পেছনে পেছনে এক ব্যক্তি বলে চলছিল, “এ ব্যক্তি মিথ্যুক, নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যূত হয়ে গেছে।” আমি জিজ্ঞেস করি, এ লোকটি কে? লোকেরা বললো ওঁর চাচা আবু লাহাব। (মুসনাদে আহমাদ ও বায়হাকী) এ একই বর্ণনাকারী হযরত রাবীআহ (রা.) থেকে আর একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখলাম। তিনি প্রত্যেকটি গোত্রের শিবিরে যাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন: “হে বনী অমুক! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রসূল। তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছি, একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক করো না। তোমরা আমাকে সত্য নবী বলে মেনে নাও এবং আমার সাথে সহযোগিতা করো। এভাবে আল্লাহ আমাকে যে কাজ করার জন্য পাঠিয়েছেন তা আমি পূর্ণ করতে পারবো।” তাঁর পিছে পিছে আর একটি লোক আসছিল এবং সে বলছিল: “হে বনী অমুক! এ ব্যক্তি নিজে যে নতুন ধর্ম ও ভ্রষ্টতা নিয়ে এসেছে লাত ও উযযার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমাদের সেদিকে নিয়ে যেতে চায়। এর কথা একদম মেনো না এবং এর পেছনেও চলো না।” আমি আমার আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম: এ লোকটি কে? তিনি বললেন: এ লোকটি ওঁরই চাচা আবু লাহাব।
তাই মানুষ আবু লাহাবের কথায় প্রভাবিত হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়ে যেতো। কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার পর যখন আবু লাহাব রাগে অন্ধ হয়ে আবোল-তাবোল বকতে লাগলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতার ব্যাপারে তার কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সে নিজের ভাতিজার শত্রুতায় অন্ধ হয়ে গেছে।
যখন প্রকাশ্যে ঘোষণার মাধ্যমে রসূলের চাচার নিন্দা করা হলো তখন লোকেরা বুঝতে পারলো, এখানে কোন কিছু রেখে ঢেকে করার অবকাশ নেই। এখানে ঈমান আনলে পরও আপন হয়ে যায় এবং ইসলামের বিরোধিতা ও কুফরী করলে আপনও হয়ে যায় পর। এ ব্যাপারে অমুকের ছেলে, অমুকের ভাই বা অমুকের বাপের কোন গুরুত্ব নেই।