তাফসীর “সূরা আল-ফাতিহা”
আয়াত নং০৭ ( صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْهِمْ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْهِمْ وَ لَا الضَّآلِّیْنَ )
“তাদের পথ যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ, যাদের ওপর গযব পড়েনি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি”
আলোচ্য আয়াতের দুইটি অংশ।
প্রথমত: ( صراط الذين انعمت عليهم ) অর্থাৎ “তাদের পথ যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছো”। আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্তদের বর্ণনা সূরা- আন-নিসা:৬৯ নং আয়াত ও সূরা মারইয়াম:৫৮ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। যা আমরা এর পূর্বের আয়াতের ব্যাখ্যায় আমরা উল্লেখ করেছি।
তাছাড়াও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন-“ তারা হচ্ছেন মূসা আলাইহিস সালাম এবং ঈসা আলাইহিস সালাতু সালাম এর সে সকল উম্মত যারা তাদের দ্বীনের মধ্যে কোন পরিবর্তন করেননি”।
আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ বলেন:- “তারা হচ্ছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং যারা তাঁর সঙ্গী ছিলেন”। – তাফসীর বাগবী।
দ্বিতীয়ত: ( غير المغضوب عليهم ولا الضالين ) অর্থাৎ: “তাদের পথ নয় যারা আপনার গজব প্রাপ্ত এবং পথভ্রষ্ট”। আমাদেরকে তাদের পথে পরিচালিত করবেন না, যাদের নিকট হক্ক বা সত্য সু-স্পষ্ট হওয়ার পরেও তারা হক্বের পথে ছিল না এবং সে অনুযায়ী আমল করেনি। আর যারা মূর্খতা এবং গোমরাহীর কারণে সত্যের আনুসরণ করেনি তাদের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করবেন না।
কারা আল্লাহর গযবপ্রাপ্ত? কারা পথভ্রষ্ট?
ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ সহ রাসূল (সঃ) এর অনেক সাহাবীর বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত যে, (, مَغْضُوْبٌ عَلَيْهِمْ ) ক্রোধভাজন বাগযবপ্রাপ্ত তারা হল ইয়াহুদী। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:-
قُلۡ ہَلۡ اُنَبِّئُکُمۡ بِشَرٍّ مِّنۡ ذٰلِکَ مَثُوۡبَۃً عِنۡدَ اللّٰہِ ؕ مَنۡ لَّعَنَہُ اللّٰہُ وَ غَضِبَ عَلَیۡہِ وَ جَعَلَ مِنۡہُمُ الۡقِرَدَۃَ وَ الۡخَنَازِیۡرَ وَ عَبَدَ الطَّاغُوۡتَ ؕ اُولٰٓئِکَ شَرٌّ مَّکَانًا وَّ اَضَلُّ عَنۡ سَوَآءِ السَّبِیۡلِ
“বলুন,আমি কি তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট মন্দ পরিণতির সংবাদ দেব? (তারা হলো) যাকে আল্লাহ লা’নত দিয়েছেন এবং যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন? আর তাদের মধ্য (ইহুদিদের) থেকে যাদেরকে বানর ও শূকর বানিয়েছেন এবং তারা তাগূতের উপাসনা করেছে। তারাই অবস্থানে মন্দ এবং সোজা পথ থেকে সর্বাধিক বিচ্যুত”। – আল-মায়েদা:৬০.
আর ( ضَالِّيْنَ ) পথভ্রষ্ট বলতে খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। কেননা আল্লাহ তায়ারা বলেছেন:-
قُلْ یٰۤاَهْلَ الْكِتٰبِ لَا تَغْلُوْا فِیْ دِیْنِكُمْ غَیْرَ الْحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعُوْۤا اَهْوَآءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوْا مِنْ قَبْلُ وَ اَضَلُّوْا كَثِیْرًا وَّ ضَلُّوْا عَنْ سَوَآءِ السَّبِیْلِ۠
“বলে দাও, হে আহলি কিতাব! নিজেদের দ্বীনের ব্যাপারে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না এবং তাদের খেয়ালখুশীর অনুসরণ করো না যারা তোমাদের পূর্বে নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং আরো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে আর সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে”। – আল-মায়িদাহ:৭৭,
তাই “সিরাতুল মুস্তাকিম” তথা সঠিক পথে চলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য অত্যাবশ্যক হল যে, তারা ইয়াহুদী এবং খ্রিষ্টান উভয় জাতিসহ যারা নিজেদের কু-প্রবৃত্তি, খেয়াল-খুশি ও অনুমান নির্ভর ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার অনুসরণ করে তাদের ভ্রষ্টতা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে।
ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ভ্রষ্টতা এবং যে অপরাধে তারা ও অন্যরা আল্লাহর গজব ও লা‘নতের যোগ্য হয়:
কুরআন ও রাসূল (সঃ) কে অস্বীকার:
ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের সব থেকে বড় ভ্রষ্টতা এই ছিল যে, তারা জেনে-শুনেও সঠিক পথ অবলম্বন করেনি। আল্লাহর কিতাব কে অস্বীকার করত। রাসূল (সঃ) ও তার রিসালতের বর্ণনা তাদের নিকট গচ্ছিত পূর্ববর্তী কিতাব সমূহে সু-স্পষ্ট পাওয়া সত্বেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করত। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
اَلَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ یَعْرِفُوْنَهٗ كَمَا یَعْرِفُوْنَ اَبْنَآءَهُمْؕ وَ اِنَّ فَرِیْقًا مِّنْهُمْ لَیَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَؔ
“যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে (কুরআন বা রাসূলকে) এমনভাবে চেনে যেমন নিজেদের সন্তানদেরকে চেনে। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে একটি দল সত্যকে জেনে বুঝে গোপন করেছে”। – আল-বাক্বারাহ:১৪৬,
আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার ও নবীদেরকে হত্যা:
আল্লাহ তা’য়ালা যা তাদের জন্য হালাল করেছেন তা হারাম করে দিত, আর আল্লাহ যা তাদের জন্যে হারাম করেছেন সেটা হালাল করে নিত। আল্লাহর বিধানকে নিজেদের মন মত পরিবর্তন করত। নবীদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত। অন্যায় ভাবে অসংখ্য নবীদের কে তারা হত্যা করত। আল্লাহ তা’আলা বলেন-
وَ بَآءُوْ بِغَضَبٍ مِّنَ اللّٰهِؕ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ كَانُوْا یَكْفُرُوْنَ بِاٰیٰتِ اللّٰهِ وَ یَقْتُلُوْنَ النَّبِیّٖنَ بِغَیْرِ الْحَقِّؕ ذٰلِكَ بِمَا عَصَوْا وَّ كَانُوْا یَعْتَدُوْنَ
“আর আল্লাহর গযব তাদেরকে ঘিরে ফেললো। কারণ তারা আল্লাহর আয়াতের সাথে কুফরী করত এবং পয়গম্বরদেরকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। এটি ছিল তাদের নাফরমানির এবং শরীয়াতের সীমালংঘনের ফল”। – আল-বাক্বারাহ:৬১,
আল্লাহর আয়াত পরিবর্তন, বিকৃতি, অপব্যাখ্যা:
তারা আল্লাহর আয়াতসমূহের বিকৃতি ও অপব্যাখ্যা করতে কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করতো না। নিজেরা কিতাব রচনা করে আল্লাহর পক্ষ হতে চালিয়ে দিত। দুনিয়াবি স্বার্থে, সামাজিক মর্যদা এবং রাস্ট্রীয় সুযোগ- সুবিধা ভোগ করার জন্য অর্থের পরিবর্তন, বিকৃতি সাধন, ভুল ব্যাখ্যা, মিথ্যা ফতোয়া প্রদান ইত্যাদি হীন কার্যে অনায়াসে লিপ্ত হতো। ফলে তারা আল্লাহর লা’নত ও গজবের যোগ্য হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
فَبِمَا نَقۡضِہِمۡ مِّیۡثَاقَہُمۡ لَعَنّٰہُمۡ وَ جَعَلۡنَا قُلُوۡبَہُمۡ قٰسِیَۃً ۚ یُحَرِّفُوۡنَ الۡکَلِمَ عَنۡ مَّوَاضِعِہٖ ۙ وَ نَسُوۡا حَظًّا مِّمَّا ذُکِّرُوۡا بِہٖ ۚ
“তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে আমি তাদেরকে লা’নাত করেছি আর তাদের হৃদয়কে আরো শক্ত করে দিয়েছি, তারা শব্দগুলোকে স্বস্থান থেকে বিচ্যুত করেছিল এবং তাদেরকে দেয়া উপদেশের বড় অংশ তারা ভুলে গিয়েছিল”। – আল-মায়েদা:১৩,
فَوَیۡلٌ لِّلَّذِیۡنَ یَکۡتُبُوۡنَ الۡکِتٰبَ بِاَیۡدِیۡہِمۡ ٭ ثُمَّ یَقُوۡلُوۡنَ ہٰذَا مِنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ لِیَشۡتَرُوۡا بِہٖ ثَمَنًا قَلِیۡلًا ؕ فَوَیۡلٌ لَّہُمۡ مِّمَّا کَتَبَتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ وَیۡلٌ لَّہُمۡ مِّمَّا یَکۡسِبُوۡنَ
“সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, এই ‘কিতাবটি’ আল্লাহর পক্ষ হতে। যাতে তার বিনিময়ে নিকৃষ্ট মূল্যে লাভ করতে পারে। সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস”। – আল-বাক্বারাহ:৭৯
এছাড়াও সূরা নিসার ৪৬ নং আয়াতসহ পবিত্র কুরআনে আসংখ্য স্থানে তাদের এই জঘন্য অপকর্মের বিবরণ বিবৃত হয়েছে।
আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, তার বিধান বর্ণনা না করে গোপন করা:
মহান আল্লাহ ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টানদের নিকট এই অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, তাঁর কিতাবে (তাওরাত ও ইঞ্জীলে) যে কথাগুলো লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং শেষ নবীর যে গুণাবলী তাতে উল্লিখিত হয়েছে, সেগুলো তারা মানুষের কাছে বর্ণনা করবে ও তার কোন কিছুই গোপন করবে না। কিন্তু তারা সামান্য পার্থিব স্বার্থের কারণে আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে ফেলে। তাছাড়াও পার্থিব স্বার্থে দুনিয়াবি তুচ্ছ্য মূল্য গ্রহণ করার জন্য ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত আল্লাহর বিধি-বিধান গোপন করে রাখত। তাই আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি লানত করে বলেন-
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡتُمُوۡنَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا مِنَ الۡبَیِّنٰتِ وَ الۡہُدٰی مِنۡۢ بَعۡدِ مَا بَیَّنّٰہُ لِلنَّاسِ فِی الۡکِتٰبِ ۙ اُولٰٓئِکَ یَلۡعَنُہُمُ اللّٰہُ وَ یَلۡعَنُہُمُ اللّٰعِنُوۡنَ
“আমি যে সব উজ্জ্বল নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি ঐগুলিকে জন সাধারণের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা ঐসব বিষয়কে গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিসম্পাত করেন এবং অভিসম্পাতকারীরাও তাদেরকে অভিসম্পাত করে থাকে”। – আল-বাকারা: ১৫৯.
وَ اِذۡ اَخَذَ اللّٰہُ مِیۡثَاقَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ لَتُبَیِّنُنَّہٗ لِلنَّاسِ وَ لَا تَکۡتُمُوۡنَہٗ ۫ فَنَبَذُوۡہُ وَرَآءَ ظُہُوۡرِہِمۡ وَ اشۡتَرَوۡا بِہٖ ثَمَنًا قَلِیۡلًا ؕ فَبِئۡسَ مَا یَشۡتَرُوۡنَ
“আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ আহলে কিতাবদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, অবশ্যই তোমরা তা (আল্লাহর বিধি-বিধান) মানুষের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না। কিন্তু তারা তা তাদের পেছনে নিক্ষেপ করত এবং তার বিনিময়ে নগন্য বিক্রি মূল্যে ভোগ করত। অতএব তারা যা ক্রয় করে, তা কতইনা মন্দ”!- আলে-ইমরান ১৮৭
উযাইর (আঃ) ও ঈসা (আঃ) কেন্দ্রিক বাড়াবাড়ি:
ইয়াহুদীরা উযাইর (আঃ) কে আল্লাহর পুত্র আর খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আঃ)কে আল্লাহর পুত্র মনে করত। আবার খ্রিষ্টানদের কেঊ কেউ বলত ঈসা (আঃ) নিজেই স্বয়ং আল্লাহ। আবার কেউ কেউ বলত তিনি তিন জনের এক।
وَ قَالَتِ الۡیَہُوۡدُ عُزَیۡرُۨ ابۡنُ اللّٰہِ وَ قَالَتِ النَّصٰرَی الۡمَسِیۡحُ ابۡنُ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ قَوۡلُہُمۡ بِاَفۡوَاہِہِمۡ ۚ یُضَاہِـُٔوۡنَ قَوۡلَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ قَبۡلُ ؕ قٰتَلَہُمُ اللّٰہُ ۚ۫ اَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ
“ইয়াহূদীরা বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র’। আর নাসারারা বলে, ‘মাসীহ আল্লাহর পুত্র’। এসব তাদের মুখের কথা। এতে তারা তাদের পূর্বেকার কাফিরদের কথারই অনুকরণ করে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! কেমনভাবে তারা সত্য পথ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছে”। -আত-তাওবা:৩০
সুরা আল- মায়েদার ১৭,৭২,৭৩ নং আয়াতে তাদের এই ভ্রান্ত আকিদা তুলে ধরা হয়েছে।
ধর্মীয় গুরু ও আলেমদেরকে রব হিসাবে গ্রহণ:
ইয়াহুদি ও খ্রিষ্টানরা তাদের পন্ডিত ও সাধু-সন্নাসীদের হালাল ও হারাম করার অধিকার আছে বলে মনে করতো। তাদের কথামত হালাল হারাম বানিয়ে নিতো, হারামকে হালাল বানিয়ে নিতো। মহান আল্লাহ তায়ারা বলেন-
اِتَّخَذُوْۤا اَحْبَارَهُمْ وَ رُهْبَانَهُمْ اَرْبَابًا مِّنْ دُوْنِ اللّٰهِ وَ الْمَسِیْحَ ابْنَ مَرْیَمَۚ وَ مَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِیَعْبُدُوْۤا اِلٰهًا وَّاحِدًاۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَؕ سُبْحٰنَهٗ عَمَّا یُشْرِكُوْنَ
“তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের ‘আহবার’ (ইয়াহুদি আলেম) ও ‘রাহবার’কে (খ্রিষ্টান আলেম) রব হিসেবে উপাসনা করেছে এবং মারইয়াম পুত্র মাসীহকেও। অথচ তাদেরক এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই নির্দেশ করা হয়েছে, যিনি ছাড়া কোন (হক) ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করে তিনি তা থেকে পবিত্র”। – আত-তওবা:৩১,
আদী বিন হাতেম তাঈ (রাঃ) রাসূল (সঃ) পবিত্র মুখে এ আয়াতটি শুনে তিনি বলেন:- ইয়া রাসূল্লাহ সঃ “ইয়াহূদী খ্রীষ্টানরা তো তাদের আলেম ও দরবেশদের উপাসনা করেনি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ “তাহলে শুন! তারা তাদের আলেম ও দরবেশদের হারামকৃত বিষয়কে হারাম বলে মেনে নেয় এবং হালালকৃত বিষয়কে হালাল বলে স্বীকার করে নেয়। এটাই তাদেরকে তাদের উপাসনা করার শামিল”। – ইবনে কাছির।
কাফির মুশরিক ও তাগুতকে সত্যায়ন:
মূর্তি পূজারি, মুশরিক, কাফির ও যারা শয়তানের দাসত্ব করে এবং তাগূতকে অস্বীকার করেনা তাদেরকে যারা হক্বের উপর রয়েছে বলে সত্যায়ন করে। ঐ সমস্ত ব্যাক্তি ও গুষ্টিদেরকে আল্লাহ তায়ালা লা’নত করেছেন। তারাও আল্লাহর গজবে পতিত হবে। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন-
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡا نَصِیۡبًا مِّنَ الۡکِتٰبِ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡجِبۡتِ وَ الطَّاغُوۡتِ وَ یَقُوۡلُوۡنَ لِلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ہٰۤؤُلَآءِ اَہۡدٰی مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا سَبِیۡلًا . اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ لَعَنَہُمُ اللّٰہُ ؕ وَ مَنۡ یَّلۡعَنِ اللّٰہُ فَلَنۡ تَجِدَ لَہٗ نَصِیۡرًا
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছে? তারা অমূলক যাদু, প্রতিমা ও তাগূতের প্রতি বিশ্বাস করে এবং কাফিরদের সম্বন্ধে বলে যে তারা মু’মিনগণের তুলনায় অধিক সঠিক পথে রয়েছে। এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ লা’নত করেছেন। আর আল্লাহ যাকে লা’নত করেন তুমি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবে না”। – আন-নিসা; ৫১-৫২.
বর্তমান পৃথিবীতেও দেখা যায় পার্থিব বিভিন্ন স্বার্থে অনেকে কবর ও মাজার পূজারী এবং বাতিলপন্থী তাগূতি শক্তির অনুসারীদেরকে হক পন্থী হিসেবে অবহিত করে।
কুপ্রবৃত্তি, ধারণা ও খেয়াল,-খুশির আনুগত্য করা:
যারা আল্লাহর বিধানের অনুসরণ করে না বরং মানব রচিত বিধানের অনুসরণ করে। নিজের ইচ্ছে, প্রবৃত্তি, ধ্যান- ধারণা ও খেয়াল-খুশিকে ইলাহ বানিয়ে নেয় তারাও আল্লাহর হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হবে। “সিরাতুল মুস্তাকিম” পথের সন্ধান পায়না। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
اَفَرَءَیۡتَ مَنِ اتَّخَذَ اِلٰـہَہٗ ہَوٰىہُ وَ اَضَلَّہُ اللّٰہُ عَلٰی عِلۡمٍ وَّ خَتَمَ عَلٰی سَمۡعِہٖ وَ قَلۡبِہٖ وَ جَعَلَ عَلٰی بَصَرِہٖ غِشٰوَۃً ؕ فَمَنۡ یَّہۡدِیۡہِ مِنۡۢ بَعۡدِ اللّٰہِ ؕ اَفَلَا تَذَکَّرُوۡنَ
“তুমি কি লক্ষ্য করছ তাকে, যে তার খেয়াল খুশীকে নিজের মা’বূদ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনে শুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব, কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবেনা?”- আল-জাসিয়া ২৩
آمين
“হে আল্লাহ আপনি কবুল করুন”
সূরা ফাতিহার শেষে ‘আ-মীন’ বলার ব্যাপারে নবী করীম (সাঃ) খুব গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তার ফযীলতও উল্লেখ করেছেন। হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إِذَا قَالَ الْإِمَامُ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ فَمَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
‘ইমাম গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদদ্বলীন বলে তখন তোমরা ‘আমীন’ বা ‘হে আল্লাহ কবুল কর’ একথাটি বল; কেননা যার কথাটি ফেরেশতাদের কথা অনুযায়ী হবে তার পূর্বের গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। -বুখারী: ৭৮২
অন্য বর্ণনায় এসেছে,
وَإِذَا قَالَ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ فَقُولُوا آمِينَ يُجِبْكُمُ الله
যখন ইমাম ‘গাইরিল মাগদূবি আলাইহিম ওয়ালাদ দ্বলীন’ বলে তখন তোমরা আমীন বা ‘হে আল্লাহ কবুল কর একথাটি বল; এতে আল্লাহ তোমাদের আহবানে সাড়া দিবেন (দোআ কবুল করবেন)”। -মুসলিম ৪০৪
অন্য একহাদীসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَا حَسَدَتْكُمْ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ ، مَا حَسَدَتْكُمْ عَلَى السَّلَامِ وَالتَّأْمِينِ
“ইয়াহুদীরা তোমাদেরকে সালাম ও আমীন বলার চেয়ে বেশী কোন বিষয়ের উপর হিংসা করে না”। – ইবন মাজাহ: ৮৫৬
শিক্ষা ও প্রায়োগিক ক্ষেত্র:
সূরা ‘ফাতিহা’র মাধ্যমে একজন মু’মিন বিশ্বাস করে যে আল্লাহর হুকুম এবং তাওহীদের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত জীবনব্যবস্থাই হলো একমাত্র কল্যাণ ও মুক্তির পথ। উপরে বর্ণিত নৈতিকতার মানদন্ডে পদস্খলিত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করা, শিরক, বেদয়া’ত ও যাবতীয় পাপাচার মুক্ত জীবন গড়া, প্রবৃত্তির দাসত্ব, সীমালংঘন ও অবাধ্য মিথ্যা জীবনাদর্শ থেকে বেঁচে থাকা, আল্লাহর আনুগত্য তার হুকুম- আহকাম ও আদেশ-নিষেধ মান্য করে একমাত্র তার ইবাদতের মাধ্যমে তার নির্ধারিত পথে চলার সৌভাগ্য অর্জন করা মু’মিন জীবনের একমাত্র সফলতা ও পরম সার্থকতা। তার সাহায্য, দয়া ও অনুগ্রহই হলো উভয় জাহানের একমাত্র পাথেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’য়ালা বলেন-
صِبْغَةَ اللّٰهِۚ وَ مَنْ اَحْسَنُ مِنَ اللّٰهِ صِبْغَةً٘ وَّ نَحْنُ لَهٗ عٰبِدُوْنَ
“(আমাদের দ্বীন বা ঈসলাম) আল্লাহর রঙে রঞ্জিত এবং আল্লাহর রঙ অপেক্ষা আর কার রঙ উত্তম হবে? আর আমরা তো তাঁরই ইবাদাতকারী”। – আল-বাক্বারাহ:১৩৮,
আমরা মহান আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে এবং আপনাদেরকে তার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। যাদেরকে তিনি ‘সিরাতুল মুস্তাকিমের’ উপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন এবং সেই পথে চলার তৌফিক দান করেছিলেন।
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله واصحابه وسلم
আল্লাহ আমাদের নবী মুহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর পরিবার ও তাঁর সঙ্গীদের প্রতি দোয়া করুন।