তাফসীর সূরা আন নাস
আয়াত নং ০১ (قل اعوذ برب الناس)
আউযু, অর্থাৎ আশ্রয় প্রার্থনা করা।এখানে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর উম্মতকে যিনি সমস্ত মাখলুকাতের একমাত্র প্রতিপালক তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন অসংখ্য হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার অসংখ্য দোয়া বর্ণিত হয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপ তাঁর নিম্মোক্ত দোয়াগুলো দেখা যেতে পারেঃ
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ فِى دُعَائِهِاللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أَعْمَلْ (مسلم)
“হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত নবী ﷺ নিজের দোয়াগুলোতে বলতেনঃ হে আল্লাহ! আমি যেসব কাজ করেছি এবং যেসব কাজ করিনি তা থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। অর্থাৎ কোন খারাপ কাজ করে থাকলে তার খারাপ ফল থেকে পানাহ চাই এবং কোন কাজ করা উচিত ছিল কিন্তু তা আমি করিনি, যদি এমন ব্যাপার ঘটে থাকে তাহলে তার অনিষ্ট থেকেও তোমার পানাহ চাই। অথবা যে কাজ করা উচিত নয় কিন্তু তা আমি কখনো করে ফেলবো, এমন সম্ভাবনা থাকলে তা থেকেও তোমার আশ্রয় চাই।” (মুসলিম)
عَنِ ابْنِ عُمَرَ رض كَانَ مِنْ دُعَاءِ رَسُولِ اللَّهِصَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ زَوَالِ نِعْمَتِكَ وَتَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ وَفُجَاءَةِ نِقْمَتِكَ وَجَمِيعِ سَخَطِكَ (مسلم)
“ইবনে উমর থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি দোয়া ছিলঃ হে আল্লাহ! তোমার যে নিয়ামত আমি লাভ করেছি তা যাতে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে না নেয়া হয়, তোমার কাছ থেকে যে নিরাপত্তা আমি লাভ করেছি তা থেকে যাতে আমাকে বঞ্চিত না করা হয়, তোমার গযব যাতে অকস্মাৎ আমার ওপর আপতিত না হয় সেজন্য এবং তোমার সব ধরনের অসন্তুষ্টি থেকে আমি তোমার আশ্রয় চাচ্ছি” (মুসলিম)।
عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَيَقُولُ اَلَّلهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ (مسلم)
“যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলতেনঃ যে ইলম উপকারী নয়, যে হৃদয় তোমার ভয়ে ভীত নয়, যে নফস কখনো তৃপ্তি লাভ করে না এবং যে দোয়া কবুল করা হয় না, আমি সেসব থেকে তোমার আশ্রয় চাচ্ছি” (মুসলিম)।
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُاللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُوعِ فَإِنَّهُ بِئْسَ الضَّجِيعُ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخِيَانَةِ فَإِنَّهَ بِئْسَتِ الْبِطَانَةُ- (ابو داود)
“হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ ﷺ বলতেনঃ হে আল্লাহ! আমি ক্ষুধা থেকে তোমার আশ্রয় চাই। কারণ, মানুষ যেসব জিনিসের সাথে রাত অতিবাহিত করে তাদের মধ্যে ক্ষুধা সবচেয়ে খারাপ জিনিস। আর আত্মসাৎ থেকে তোমার আশ্রয় চাই। কারণ এটা বড়ই কলুষিত হৃদয়ের পরিচায়ক।” (আবু দাউদ)।
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُاللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُنُونِ وَالْجُذَامِ وَمِنْ سَيِّئِ الأَسْقَامِ (ابو داود) “হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ বলতেনঃ হে আল্লাহ! আমি শ্বেতকুষ্ঠ, উন্মাদনা, কুষ্ঠরোগ ও সমস্ত খারাপ রোগ থেকে তোমার আশ্রয় চাই।” (আবু দাউদ)
عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَدْعُو بِهَؤُلاَءِ الْكَلِمَاتِاللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ النَّارِ وَمِنْ شَرِّ الْغِنَى وَالْفَقْرِ-
“আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী ﷺ নিম্নোক্ত কথাগুলোসহ দোয়া চাইতেনঃ হে আল্লাহ! আমি আগুনের ফিতনা এবং ধনী ও দরিদ্র হওয়ার অনিষ্ট থেকে তোমার আশ্রয় চাই।” (তিরমিযী ও আবু দাউদ)
عَنْقُطْبَةُ بْنُ مَالِكٍ كَانَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الأَخْلاَقِ وَالأَعْمَالِ وَالأَهْوَاءِ (ترمزى)
“কুতবাহ ইবনে মালেক বলেন, নবী ﷺ বলতেন, হে আল্লাহ! আমি অসৎ চরিত্র, অসৎ কাজ ও অসৎ ইচ্ছা থেকে তোমার আশ্রয় চাই।”
শাকাল ইবনে হুমাইদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, আমাকে কোন দোয়া বলে দিন। জবাবে তিনি বলেনঃ
اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِى وَمِنْ شَرِّ بَصَرِى وَمِنْ شَرِّ لِسَانِى وَمِنْ شَرِّ قَلْبِى وَمِنْ شَرِّ مَنِيِّى –
“হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই আমার শ্রবণ শক্তির অনিষ্ট থেকে, আমার দৃষ্টি শক্তির অনিষ্ট থেকে, আমার বাক শক্তির অনিষ্ট থেকে, আমার হৃদয়ের অনিষ্ট থেকে এবং আমার যৌন ক্ষমতার অনিষ্ট থেকে।” (তিরমিযীও আবু দাউদ)
اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ (وفى رواية لمسلم) وضلع الدين وغلبة الرجال (بخارى ومسلم)
“আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ ﷺ বলতেনঃ হে আল্লাহ! আমি অক্ষমতা, কুঁড়েমি, কাপুরুষতা, বার্ধক্য ও কৃপণতা থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আর তোমার আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে। (মুসলিমের অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ ) আর ঋণের বোঝা থেকে এবং লোকেরা আমার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে, এ থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই।” (বুখারী ও মুসলিম)
عن خَوْلَةَ بِنْتَ حَكِيمٍ السُّلَمِيَّةَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ نَزَلَ مَنْزِلاً ثُمَّ قَالَ أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ. لَمْ يَضُرُّهُ شَىْءٌ حَتَّى يَرْتَحِلَ مِنْ مَنْزِلِهِ ذَلِكَ (مسلم)
“খাওলা বিনতে হুকাইম সুলামীয়া থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি কোন নতুন মনযিলে নেমে একথাগুলো বলবে— আমি সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহর নিষ্কলঙ্ক কালেমাসমূহের আশ্রয় চাই, সেই মনযিল থেকে রওয়ানা হবার আগে পর্যন্ত তাকে কোন জিনিস ক্ষতি করতে পারবে না।” (মুসলিম)
রসূলুল্লাহ ﷺ আল্লাহর কাছে যেভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন হাদীস থেকে তার কয়েকটি নমুনা এখানে আমরা তুলে ধরলাম। এ থেকে জানা যাবে, প্রতিটি বিপদ-আপদ ও অনিষ্টকরিতার মোকাবেলায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়াই মু’মিনের কাজ। তাছাড়া আল্লাহর প্রতি বিমুখ ও অনির্ভর হয়ে নিজের ওপর ভরসা করাও তার কাজ নয়।
আল্লাহ তাআলা সমস্ত জাহানের প্রতিপালক তথাপিও বিশেষ করে মানুষের প্রতিপালক উল্লেখ করার মাধ্যমে অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সকল সৃষ্টি ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আল্লাহকে প্রতিপালক হিসেবে মেনে নিয়েছে ।শুধু এক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির পরিলক্ষিত হয়। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো শক্তি বা উৎস কে তারা প্রতিপালক হিসাবে গ্রহণ করে। তাই তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মানুষের প্রতিপালক উল্লেখ করা হয়েছে।