আহলে হাদীসদের ঐতিহাসিক সত্যতা : সালাফদের দৃষ্টিতে – পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ – [রিপোষ্ট]
আহলে হাদীস বা আহল-ই-হাদীস একটি ফার্সি শব্দ যার শাব্দিক অর্থ হল হাদীসের অনুসারী। আরবীতে তার প্রতিশব্দ হল আসহাবুল হাদীস। আল কুরাআনে সুরা যুমারে (৩৯:২৩) আল্লাহ তা’আলা নিজেই হাদীস শব্দটি উল্লেখ করেছেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা হাদীস এর শব্দিক অর্থ তার বাণী বা কুরআন কে বুঝিয়েছেন। সাধারনত মুসলিমগন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী কে হাদীস বলে থাকে। অপর পক্ষে আহল শব্দটিও ফার্সি, যার অর্থ অনুসারী (আরবী আহল অর্থ বংশধর)। যেহেতু কুরআন এর অপর নাম হাদীস। মুলত: এই কারনেই মাযহাবের অনুসরণের বিরোধীতা করে, সরাসরি কুরআন ও হাদীসের অনুসরন করতে গিয়ে আহলে হাদীস নাম ধারন করে। বিশ্ব বিখ্যাত বহু আলেম যেমন-
১. খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (মৃঃ ১০১ হিঃ)
২. মাকহুল বিন আব্দুল্লাহ সিন্ধী (মৃঃ ১১৩ হিঃ)
৩. আমর বিন মুসলিম বাহেলী (মৃঃ ১২৩ হিঃ)
৪. ইমাম আওযাঈ (মৃঃ ১৫৭ হিঃ)
৫. ইমাম মালেক (মৃঃ ১৭৯ হিঃ)
৬. ফযায়েল বিন আয়ায (মৃঃ ১৮৭ হিঃ)
৭. ইমাম শাফেঈ (মৃঃ ২০৪ হিঃ)
৮. ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ)
৯. আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন খালাক (মৃঃ ৩১১ হিঃ)
১০. ইমাম ইবনে খুযাইমা (মৃঃ ৩১১ হিঃ)
১১. আবুল হাসান আশআরী (মৃঃ ৩২৪ হিঃ)
১২. ইব্রাহীম বিন মুঃ দেবলী (মৃঃ ৩৪৫ হিঃ)
১৩. আবু আব্দুল্লাহ হাকিম নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ)
১৪. ইমাম ইবনে হাযয আন্দালুসী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ)
১৫. ইমাম বায়হাকী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ),
এরা সহ অনেক আলেম আহলে হাদিস ছিলেন। (উৎস – মোঃ আব্দুল্লাহেল কাফী : আহলে হাদীস পরিচিত)।
এছাড়াও আরও যে সকল প্রখ্যাত ইমামরা আহলে হাদীস ছিলেন। যেমন –
১। আবু হানীফা (রহ) (৮০-১৫০ হিজরী)
২। ইমাম মালেক (রহ) (৯৩-১৭৯ হিজরী)
৩। ইমাম শাকেয়ী (রহ) ( ১৫০-২০৪ হিজরী)
৪। ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল (রহ) ( ১৬৪-২৪১ হিজরী)
৫। ইমাম বুখারী (১৯৪-২৫৬ হিজরী)
৬। ইমাম মুসলিম (২০৪-২৬১ হিজরী)
৭। ইমাম নাসাঈ (২১৫-৩০৩ হিজরী)
৮। ইমাম আবু দাউদ (২০২-২৭৫ হিজরী)
৯। ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিজরী)
১০। ইমাম ইবনে মাযাহ (২০৯-২৭৩ হিজরী)
১১। ইমাম আলি ইবনে মাদানী (১৬১-২৩৪ হিজরী)
এই সকল জগত বিখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিসগণ সকলে আহলে হাদীস ছিলেন। (উৎস – মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের লেখা আহলে হাদীছ আন্দোলন কি এবং কেন? পৃষ্ঠা -৭ ও ৯)।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হ’লেন আহলেহাদীসদের নেতা। এ সম্পর্কে খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,
ﻭَﻛُﻞُّ ﻓِﺌَﺔٍ ﺗَﺘَﺤَﻴَّﺰُ ﺇِﻟَﻰ ﻫَﻮًﻯ ﺗَﺮْﺟِﻊُ ﺇِﻟَﻴْﻪِ، ﺃَﻭْ ﺗَﺴْﺘَﺤْﺴِﻦُ ﺭَﺃَﻳًﺎ ﺗَﻌْﻜُﻒُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ، ﺳِﻮَﻯ ﺃَﺻْﺤَﺎﺏِ ﺍﻟْﺤَﺪِﻳﺚِ، ﻓَﺈِﻥَّ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏَ ﻋُﺪَّﺗُﻬُﻢْ، ﻭَﺍﻟﺴُّﻨَّﺔُ ﺣُﺠَّﺘُﻬُﻢْ
[খত্বীব বাগদাদী (৩৯২-৪৬৩ হিঃ), শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৭]।
হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
ﻳَﻮْﻡَ ﻧَﺪْﻋُﻮ ﻛُﻞَّ ﺃُﻧَﺎﺱٍ ﺑِﺈِﻣَﺎﻣِﻬِﻢْ
‘(স্মরণ কর) যেদিন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা (অর্থাৎ নবী অথবা আমলনামা) সহ আহবান করব’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৭১) -এর তাফসীরে বলেন,
ﻭَﻗَﺎﻝَ ﺑَﻌْﺾُ ﺍﻟﺴَّﻠَﻒِ : ﻫَﺬَﺍ ﺃَﻛْﺒَﺮُ ﺷَﺮَﻑٍ ﻟِﺄَﺻْﺤَﺎﺏِ ﺍﻟْﺤَﺪِﻳﺚِ؛ ﻟِﺄَﻥَّ ﺇِﻣَﺎﻣَﻬُﻢُ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲِّ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ
‘কোন কোন সালাফ বলেন, আহলেহাদীসদের জন্য এটাই সর্বোচ্চ মর্যাদা যে, তাদের একমাত্র ইমাম হ’লেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’।[তাফসীর ইবনু কাছীর ৫/৯৯ বনী ইসরাঈলের ৭১নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রঃ।]
তাফসীর ইবনু কাছীর সকলের নিকট একটি নির্ভরযোগ্য তাফসীর। [ইসমাঈল বিন ওমর বিন কাছীর বিন যাও বিন দার‘ কুরাশী বছরী অতঃপর দামেশক্বী আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন। তিনি একজন হাদীছের হাফেয, ঐতিহাসিক ও ফক্বীহ। তদানীন্তন সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত বছরার একটি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৭০৬ হিজরীতে তিনি তার এক ভাইয়ের সাথে দামেশক্বে স্থানান্তরিত হন। তিনি ইলম অন্বেষণের জন্য ভ্রমণ করেছেন। তিনি দামেশক্বে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবদ্দশাতেই লোকেরা তাঁর গ্রন্থসমূহ প্রচার-প্রসার করেছেন (খায়রুদ্দীন যিরিকলী, আল-আ‘লাম ১/৩২০)।]
ইবনু কাছীর ৭০১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭৭৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। না তিনি হিন্দুস্থানের ছিলেন আর না সে সময় ইংরেজদের কোন অস্তিত্ব ছিল। উপরন্তু ইবনু কাছীর আহলেহাদীছদের সম্পর্কে এখানে নিজের কথা নয়; বরং তাঁর পূর্বের বিদ্বানের উক্তি উল্লেখ করেছেন। যার মাধ্যমে একথা প্রতীয়মান হয়েছে যে, সালাফে ছালেহীনের মাঝে ‘আছহাবুল হাদীছ’ নামে বিদ্যমান বিদ্বানগণ আল্লাহর নবী (ছাঃ)-কে তাদের ইমাম বা নেতা মানতেন।
আরোপিত অপবাদ খন্ডনের জন্য কি শুধু এ কথাটুকুই যথেষ্ট নয় যে, আজ থেকে সাতশত বছরেরও বেশী পুরাতন গ্রন্থে একজন নির্ভরযোগ্য মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আহলেহাদীসদের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও সালাফে সালেহীনের উক্তি দ্বারা দলীল গ্রহণ করেছেন? প্রকৃত সত্য এই যে, আহলেহাদীসদের অস্তিত্ব ইবনু কাছীরের চেয়েও প্রাচীন।
শুধু তাই নয়, এ প্রসঙ্গে ‘বড় পীর’ বলে খ্যাত শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (৪৯১-৫৬১ হিঃ) বলেন,
وَأَمَّا الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ فَهِيَ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ قَالَ: وَأَهْلُ السُّنَّةِ لاَ إِسْمٌ لَهُمْ إِلاَّ إِسْمٌ وَّاحِدٌ وَّهُوَ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ–
‘অতঃপর ফির্কা নাজিয়া হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীস’।[আব্দুল ক্বাদির জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর: ১৩৪৬ হিঃ) ১/৯০ পৃঃ।]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ)-কে ‘ক্বিয়ামত পর্যন্ত হক-এর উপরে একটি দল টিকে থাকবে’ মর্মে বর্ণিত হাদীছের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, إِنْ لَّمْ يَكُوْنُوْا أَصْحَابَ الْحَدِيْثِ فَلاَ أَدْرِىْ مَنْ هُمْ؟ ‘তারা যদি ‘আহলেহাদীছ’ না হয়। তাহ’লে আমি জানি না তারা কারা’? তিরমিযী হা/২১৯২; মিশকাত হা/৬২৮৩-এর ব্যাখ্যা; ফাৎহুল বারী ১৩/৩০৬ পৃঃ, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭০; শারফু আছহাবিল হাদীছ পৃঃ ১৫]।
একটি সংশয় নিরসন – পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ
এখানে একটা ভুল ভেঙ্গে দেওয়া জরুরী। সেটা হ’ল কেউ কেউ এ সংশয় পোষণ করে যে, উক্ত উদ্ধৃতিগুলিতে ‘আহলেহাদীস’ শব্দটি মুহাদ্দিসদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। কোন ফিরক্বা বা দলকে বুঝানোর জন্য নয়। তারা বলে যে, তাফসীর শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে যেমন ‘মুফাসসির’ বা ‘আহলে তাফসীর’ বলা হয়, তেমনি হাদীছের জগতে দক্ষ ব্যক্তিকে ‘মুহাদ্দিস’ বা ‘আহলেহাদীস’ বলা হয়। কিন্তু এ কথাটি সঠিক নয়। এটা ভুল হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, যদি বাস্তবেই আহলেহাদীস দ্বারা স্রেফ মুহাদ্দিসগণই উদ্দেশ্য হয় তাহ’লে হাদীছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকা যেই দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্য থেকে মুফাসসির ও ফক্বীহগণকে বের করতে হবে। হাদীসের শব্দগুলি ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে এ ভুল ধারনাটা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। কেননা হাদীসে আহলে বাতিলের মুকাবিলায় আহলেহাদীসকে উল্লেখ করা হয়েছে। আহলে ফিক্বহ ও আহলে তাফসীরের মুকাবিলায় নয়।
এ কথাটা আরো পরিষ্কার করার জন্য আমরা শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ)-এর উক্তিটি পেশ করা যথোপযুক্ত মনে করছি, যা তার ‘গুনইয়াতুত ত্বলেবীন’ গ্রন্থে উদ্বৃত হয়েছে।
আহলুল হাদীসই আহলুস সুন্নাহ : শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ) বলেন,
.
ﻭﺍﻋﻠﻢ ﺃﻥ ﻷﻫﻞ ﺍﻟﺒﺪﻉ ﻋﻼﻣﺎﺕ ﻳﻌﺮﻓﻮﻥ ﺑﻬﺎ . ﻓﻌﻼﻣﺔ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺒﺪﻋﺔ ﺍﻟﻮﻗﻴﻌﺔ ﻓﻲ ﺃﻫﻞ ﺍﻷﺛﺮ . ﻭﻋﻼﻣﺔ ﺍﻟﺰﻧﺎﺩﻗﺔ ﺗﺴﻤﻴﺘﻬﻢ ﺃﻫﻞ ﺍﻷﺛﺮ : ﺑﺎﻟﺤﺸﻮﻳﺔ، ﻭﻳﺮﻳﺪﻭﻥ ﺇﺑﻄﺎﻝ ﺍﻵﺛﺎﺭ . ﻭﻋﻼﻣﺔ ﺍﻟﻘﺪﺭﻳﺔ ﺗﺴﻤﻴﺘﻬﻢ ﺃﻫﻞ ﺍﻷﺛﺮ : ﻣﺠﺒﺮﺓ . ﻭﻋﻼﻣﺔ ﺍﻟﺠﻬﻤﻴﺔ ﺗﺴﻤﻴﺘﻬﻢ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺴﻨﺔ ﻣﺸﺒﻬﺔ . ﻭﻋﻼﻣﺔ ﺍﻟﺮﺍﻓﻀﺔ ﺗﺴﻤﻴﺘﻬﻢ ﺃﻫﻞ ﺍﻷﺛﺮ : ﻧﺎﺻﺒﺔ . ﻭﻛﻞ ﺫﻟﻚ ﻋﺼﺒﻴﺔ ﻭﻏﻴﺎﻅ ﻷﻫﻞ ﺍﻟﺴﻨﺔ، ﻭﻻ ﺍﺳﻢ ﻟﻬﻢ ﺇﻻ ﺍﺳﻢ ﻭﺍﺣﺪ، ﻭﻫﻮ ﺃﺻﺤﺎﺏ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ . ﻭﻻ ﻳﻠﺘﺼﻖ ﺑﻬﻢ ﻣﺎ ﻟﻘﺒﻬﻢ ﺑﻪ ﺃﻫﻞ ﺍﻟﺒﺪﻉ، ﻛﻤﺎ ﻟﻢ ﻳﻠﺘﺼﻖ ﺑﺎﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺗﺴﻤﻴﺔ ﻛﻔﺎﺭ ﻣﻜﺔ ﻟﻪ ﺳﺎﺣﺮًﺍ ﻭﺷﺎﻋﺮًﺍ ﻭﻣﺠﻨﻮﻧًﺎ ﻭﻣﻔﺘﻮﻧًﺎ ﻭﻛﺎﻫﻨًﺎ، ﻭﻟﻢ ﻳﻜﻦ ﺍﺳﻤﻪ ﻋﻨﺪ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﻋﻨﺪ ﻣﻼﺋﻜﺘﻪ ﻭﻋﻨﺪ ﺇﻧﺴﻪ ﻭﺟﻨﻪ ﻭﺳﺎﺋﺮ ﺧﻠﻘﻪ ﺇﻻ ﺭﺳﻮﻟًﺎ ﻧﺒﻴًﺎ ﺑﺮﻳًﺎ ﻣﻦ ﺍﻟﻌﺎﻫﺎﺕ ﻛﻠﻬﺎ
‘জেনে রাখ যে, বিদ‘আতীদের কিছু নিদর্শন রয়েছে, যা দেখে তাদের চেনা যায়। বিদ‘আতীদের লক্ষণ হ’ল আহলেহাদীসদের গালি দেওয়া ও বিভিন্ন বাজে নামে তাদেরকে সম্বোধন করা। যিনদীক্বদের (নাস্তিক) নিদর্শন হ’ল, তারা আহলে আছারকে হাশাবিয়া বলে থাকে। এর মাধ্যমে তারা আছারকে বাতিল সাব্যস্ত করতে চায়। ক্বাদারিয়াদের নিদর্শন হ’ল, তারা আহলেহাদীসদেরকে মুজবেরাহ বলে। জাহমিয়াদের নিদর্শন হ’ল তারা আহলুস সুন্নাহকে মুশাবিবহা তথা সাদৃশ্য স্থাপনকারী বলে। রাফেযীদের নিদর্শন হ’ল তারা আহলে আছারকে নাছেবাহ বলে। এগুলি সুন্নাতপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের দলীয় গোঁড়ামি ও অন্তর্জ্বালার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন কিছুই নয়। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হল ‘আসহাবুল হাদীস’ বা ‘আহলেহাদীস’। বিদ‘আতীদের এইসব গালি প্রকৃত অর্থে আহলেহাদীসদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যেমন মক্কার কাফিরদের জাদুকর, কবি, পাগল, মাথা খারাপ, গায়েবজান্তা প্রভৃতি গালি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা মন্ডলী, মানুষ, জ্বিন ও তাঁর সৃষ্টির নিকটে সকল দোষ-ত্রুটি থেকে পূত-পবিত্র একজন নবী ও রাসূল ছিলেন।’ [গুনয়াতুত ত্বলেবীন ১/১৬৬]।
উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো চিন্তা-ভাবনার দাবী রাখে-
(১) শায়খ আব্দুল কাদের জীলানী (রহঃ) ভ্রান্ত ফিরক্বাগুলির বিপরীতে আহলেহাদীস-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
(২) তাঁর নিকটে আহলেহাদীসদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন কথা বলা বাতিল ফিরক্বাগুলির নিদর্শন।
(৩) তাঁর নিকটে আহলেহাদীস ও আহলে সুন্নাত একই।
(৪) আহলুস সুন্নাতের একটাই নাম ‘আহলুল হাদীস’।
এ সকল আলোচনার পর প্রশ্ন হ’ল, এরপরেও কি আহলেহাদীছকে একটি নতুন দল বলে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করা ঠিক হবে? আমরা এর জবাব সম্মানিত পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার সারাংশে বলা যায় যে, অতএব আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী বিবাদীয় সকল বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। আর সুন্নাহ হ’তে হবে সহীহ সুন্নাহ। কোন যঈফ বা জাল হাদীস নয়। সুতরাং তারাই হবে সত্যিকারের আহলে সুন্নাত, যারা নিজেদের মনগড়া শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজ থেকে খালেসভাবে তওবা করে সর্বাবস্থায় সহীহ হাদীস মুখী হবে। নইলে মুখে ‘সুন্নী’ বলে কাজের বেলায় শিরক ও বিদ‘আতের বাজার গরম করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নিদর্শন নয়।
অতএব افةراق الأمة বা উম্মতের বিভক্তি রোধের একটাই পথ খোলা রয়েছে। আর তা হ’ল তাক্বলীদী গোঁড়ামী পরিহার করে নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে সর্বাবস্থায় পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দিকে ফিরে যাওয়া এবং খোলাফায়ে রাশেদীন, ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আতের বুঝ হাছিল করা। কারু কোন বিষয় জানা না থাকলে বিজ্ঞ ও মুত্তাক্বী আলেমের নিকট থেকে তিনি জেনে নিবেন দলীলের ভিত্তিতে, রায়-এর ভিত্তিতে নয়। মনে রাখা আবশ্যক যে, দ্বীন সম্পূর্ণ হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায়। অতএব সে যুগে যা দ্বীন ছিল না, এ যুগে তা দ্বীন নয়। যতই তার গায়ে দ্বীনের লেবাস পরানো হৌক না কেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, কুকুরের বিষ দ্রুত আক্রান্ত ব্যক্তির সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তার কোন শিরা-উপশিরা বাকী থাকে না। অনুরূপভাবে বিদ‘আত মানুষকে এমনভাবে প্রলুব্ধ করে যে, মানুষ তার প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হয় এবং তা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কারণ বিদ‘আতের পিছনে শয়তান কাজ করে থাকে।
এজন্যই দেখা যায়, অনেক নিরীহ গরীব মুসলমান ফরয সালাত ও সিয়াম পালন করে না। কিন্তু একমাত্র সম্বল গাছটি বিক্রি করে হ’লেও বছর শেষে বাড়ীতে একবার মৌলভী ডেকে এনে মীলাদ অনুষ্ঠান করবে। শা‘বান মাসে অন্য কোন ছিয়াম পালন না করলেও এমনকি রামাযানের ফরয ছিয়াম বাদ গেলেও শবেবরাতের ছিয়াম ও ছালাত আদায় করবে এবং হালুয়া-রুটি খাবে যে কোন ভাবেই হৌক। এসব অজ্ঞতা আমাদেরকে দূর করতে হবে। সত্যিকারের কুরআন ও হাদীসের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে।
কুরআন ও সুন্নাহর উপরে নিজের জ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই বলা হয় প্রবৃত্তি পরায়ণতা। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,
أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُوْنُ عَلَيْهِ وَكِيْلاً
‘আপনি কি তাকে দেখেছেন, যে তার প্রবৃত্তিকে তার উপাস্য রূপে গ্রহণ করেছে? আপনি কি তার যিম্মাদার হবেন? (ফুরক্বান ২৫/৪৩; জাছিয়াহ ৪৫/২৩)। যখন তাদের সামনে কুরআন-হাদীছের বিধান শুনানো হয়, তখন তারা দর্পভরে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও নিজের প্রবৃত্তির উপরে যিদ করে। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا تُتْلَى عَلَيْهِ آيَاتُنَا وَلَّى مُسْتَكْبِرًا كَأَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا كَأَنَّ فِي أُذُنَيْهِ وَقْرًا فَبَشِّرْهُ بِعَذَابٍ أَلِيْمٍ
‘যখন তার সামনে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন সে দম্ভের সাথে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন সে তা শুনতেই পায়নি অথবা যেন ওর দু’কান বধির। অতএব ওকে মর্মান্তিক আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন’ (লোকমান ৩১/৭)। আমাদেরকে এ সকল প্রবৃত্তির পূজা থেকে বিরত থেকে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করার তৌফিক দিন, আমীন!
ধন্যবাদান্তে-
সংকলন – সাজ্জাদ সালাদীন।