বাগদাদ দূতাবাস বন্ধের হুমকি দেওয়ার সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ইরাক থেকে কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকের নাগরিকদের আশঙ্কা ওয়াশিংটনের এই পদক্ষেপের ফলে নতুন যুদ্ধের কবলে পড়তে যাচ্ছে তাদের দেশ। – দুই ইরাকি কর্মকর্তা এবং দুই পশ্চিমা কূটনীতিক এই তথ্য জানিয়েছেন।
পাঁচ হাজার মার্কিন সেনা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও দেশটি থেকে কূটনীতিক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ইরানের সাথে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে কূটনৈতিক এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা হামলার অভিযোগ করেছে ওয়াশিংটন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে, ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত ইরাকে সামরিক পদক্ষেপের আশঙ্কাকে জোরালো করছে। নির্বাচনি প্রচারণায় ইরান ও তার সমর্থিত বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলে আসছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ইরাক সরকারের দুই কর্মকর্তা জানায়, সপ্তাহখানেক আগে প্রেসিডেন্ট বাহরাম সালিহকে ফোন করে এই হুমকি দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ফোনালাপটি সম্পর্কে প্রথমে ইরাকি একটি অনলাইন বার্তা সংস্থা জানিয়েছিল।
এই সিদ্ধান্তের জের ধরে, বাগদাদ থেকে কূটনীতিক কর্মীদের সরিয়ে নিতে গত রবিবার থেকে প্রস্তুতি শুরু করেছে ওয়াশিংটন।– ঐ সূত্রটি এবং দুই পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন।
ইরাকি নাগরিকদের আশঙ্কা, কূটনীতিকদের সরিয়ে নেওয়ার পর অভিযুক্ত হামলাকারী বাহিনীদের বিরুদ্ধে দ্রুত সামরিক পদক্ষেপ জোরালো করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
কয়েক লাখ ইরাকির নেতৃত্ব দেওয়া জনপ্রিয় নেতা মুক্তাদা আল সদর গত সপ্তাহে একটি বিবৃতিতে, বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোর প্রতি উত্তেজনা এড়ানোর আহ্বান জানান, যাতে ইরাক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়ে না পড়ে।
পশ্চিমা এক কূটনীতিক বলেন, ‘ইরান কিংবা ইরান সমর্থিত যোদ্ধাদের ইরাককে দুর্বল করার সুযোগ সীমিত করতে চাইছে না মার্কিন প্রশাসন। বাগদাদ থেকে কূটনীতিক প্রত্যাহারের পর ইরাকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারে কিনা জানতে চাইলে ওই কূটনীতিক জোরালো আশঙ্কার কথা জানান।
ইরাক থেকে কূটনীতিক প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে বলা হয়, ‘আমরা কখনোই বিদেশি নেতাদের সঙ্গে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত আলোচনার বিষয়ে মন্তব্য করি না।…ইরান সমর্থিত গ্রুপগুলো আমাদের দূতাবাসে যে হামলা চালাচ্ছে তা কেবল আমাদের জন্য বিপদজনক নয় বরং ইরাক সরকারের জন্যও।’
এ মাসের শুরুতে মার্কিন সেনারা বলেছিল, ইরাকে তাদের উপস্থিতি ৫,২০০ থেকে ৩,০০০-এ নামিয়ে আনা হবে।
সোমবার পেন্টাগন বলে, তারা ইরাকের দীর্ঘমেয়াদী “সুরক্ষা, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি” এবং সশস্ত্র গ্রুপ আইএসআইএল (আইএসআইএস) এর বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকির সম্ভাবনা
মধ্যপ্রাচ্যের সবগুলো দেশই ইরান কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম ইরাক: ওয়াশিংটন ও তেহরান উভয়ের সঙ্গেই নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে তাদের। আর সেকারণেই দেশটি দীর্ঘমেয়াদি ওয়াশিংটন-তেহরান ছায়াযুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারিতে বাগদাদ বিমানবন্দরে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে যুক্তরাষ্ট্র হত্যা করে। জবাবে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান।
তারপর অবশ্য ইরাকের ক্ষমতা নিয়েছেন নতুন এক প্রধানমন্ত্রী। তাকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে ইরাকের শক্তিশালী শিয়া মতালম্বী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর সঙ্গে এখনও নিবিড় যোগাযোগ রেখে চলেছে তেহরান।
সশস্ত্র গোষ্ঠীর রকেটগুলি নিয়মিত টাইগ্রিসের শক্তিশালী মার্কিন কূটনৈতিক প্রাঙ্গণের দিকে উড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাগদাদের তথাকথিত “গ্রিন জোন” নামে খ্যাত বিশ্বের বৃহত্তম মার্কিন দূতাবাস এটি। ২০০৩ এ মার্কিনীদের আক্রমণের পরে এটি নির্মিত হয়।
সম্প্রতি মার্কিন দূতাবাস সংলগ্ন এলাকায় রকেট এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সরঞ্জাম বহনকারী বহরগুলিকে লক্ষ্য করে রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা বোমা হামলার ঘটনা বেড়েছে।
বাগদাদে, একটি ব্রিটিশ বহর রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা বোমা হামলার শিকার হয়েছিল। ইরাকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে এটাই প্রথম এমন কোনো হামলার ঘটনা।
ইরাকি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সোমবার দু’টি সামরিক রকেট একটি পারিবারিক বাড়িতে আঘাত হানার ফলে তিন শিশু ও দুই মহিলা নিহত হয়েছেন। পুলিশের সূত্র থেকে জানা যায়, তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল বাগদাদ বিমানবন্দর।
দুটি ইরাকি গোয়েন্দা সূত্র থেকে প্রাপ্ত, আমেরিকান কূটনীতিকদের প্রত্যাহারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এখনও শুরূ হয়নি। তবে এটি নির্ভর করবে, ইরাকি সুরক্ষা বাহিনী হামলা প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ট কাজ করতে সক্ষম হয়েছে কিনা তার উপর।
ইরাকি সুরক্ষা বাহিনী জানায়, মার্কিন প্রাঙ্গণে আক্রমণ প্রতিরোধ করার আদেশ পেয়েছে তারা এবং এই প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেই মার্কিন কূটনীতিক প্রত্যাহার শুরু হবে বলে জানানো হয় তাদেরকে।
মার্কিনিদের দ্বিমুখী কৌশল
ইরাকিরা নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষে ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক গৃহিত সিদ্ধান্তের প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন।
ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান সাড়ম্বরে প্রদর্শন করলেও, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই মধ্য প্রাচ্য থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। আমেরিকা ইতোমধ্যে আইএসআইএল যোদ্ধাদের পরাস্তে সাহায্যের জন্য, ২০১৪-২০১৭ সাল পর্যন্ত ইরাকে প্রেরিত বাহিনীকে সরিয়ে নিচ্ছে।
কিছু ইরাকি কর্মকর্তা পম্পেওর কূটনীতিক প্রত্যাহারের হুমকিকে স্রেফ দম্ভোক্তি বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের ধারণা, এটি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে আক্রমণ বন্ধে ভয় দেখানোর পরিকল্পনা মাত্র। তবে তাদের আশঙ্কা এটি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যদি সশস্ত্র দলগুলি উস্কানিপ্রাপ্ত হয়ে ওয়াশিংটনকে পিছু হটানোর কোনও সুযোগ অনুসন্ধান করতে থাকে।
‘আমেরিকান দূতাবাস বন্ধ করার হুমকি, কেবল তাদের একটি চাপের কৌশল এবং তাদের দ্বিমুখী নীতির একটি অংশ।’- ইরাকের সংসদীয় সুরক্ষা কমিটির সদস্য গাতি রিকাবি বলেছেন।
তিনি ও কমিটির আরেকজন সদস্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোস্তফা আল-কাদিমির সমর্থনে মার্কিনী পদক্ষেপগুলি ইরাকি নেতাদের ভয় দেখানোর পরিকল্পনা মাত্র। যিনি এর মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে ইরান-জোটবদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির শক্তি যাচাই করার চেষ্টা করেছিলেন।
উভয় পক্ষে আক্রমনাত্মক লোকের উপস্থিতি
ওয়াশিংটনকে উস্কানি দেয় এমন সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণের দাবিতে সশস্ত্র দলগুলি জনগণের চাপে রয়েছে। গত বছর থেকে, ইরাকের জনমত রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে উঠেছে। ইরান বলছে, এর ফলাফল উগ্র সহিংসতায় রূপ নিবে।
সংসদে বড় বড় দলগুলিকে নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিশালী ইরান-সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপগুলি, পশ্চিমা লক্ষ্যগুলিতে আক্রমণের বিষয়ে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন যে, তারা মনে করে মিলিশিয়া বা তাদের ইরানি সমর্থকরা এ জাতীয় আক্রমণ চালানোর জন্য দল-উপদল তৈরি করেছে। যাতে মূল সংগঠন গুলি দোষ এড়িয়ে যেতে পারে।
শিয়া রাজনৈতিক দলের এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, তার ধারণা, ট্রাম্প কূটনীতিকদের অনিষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য এবং নির্বাচনকালীন বিব্রতকর ঘটনা এড়ানোর জন্য এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সর্বসমক্ষে ইরাকের কূটনৈতিক মিশনে হামলা বন্ধের ঘোষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সশস্ত্র দলগুলির আক্রমণের পেছনে তেহরানের কোন সম্পর্ক নেই।
”ইরান আমেরিকানদের বিতাড়িত করে সরিয়ে দিতে চায়, তবে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে নয়। এটি তার পশ্চিম সীমান্তকে অস্থিতিশীল করতে চায় না।”- শিয়া নেতা বলেন।
”মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন আক্রমনাত্মক লোক রয়েছে তেমনই ইরানেও রয়েছে, যাদের আক্রমণকারী দলগুলির সাথে যোগাযোগ রয়েছে। এবং যারা কোন অবস্থাতেই রাষ্ট্রনীতির অনুসরণ করে থাকে না”।