হিজবুল্লাহকে এখন দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হচ্ছে। এক. ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করতে হচ্ছে। দুই. লেবাননের ভেতরে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপ সামাল দিতে হচ্ছে।
১১ নভেম্বর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রেকর্ডসংখ্যক রকেট ও মিসাইল নিক্ষেপ করে। সাফেদ, এইকা ও হাইফা অঞ্চল, যেখানে উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ লোক বাস করেন, সেসব জায়গায় হামলা করে হিজবুল্লাহ।
গত ১ অক্টোবর লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থল অভিযান শুরুর এক মাসের বেশি সময় পর হিজবুল্লাহ এত বড় আক্রমণ করল। প্রতিবছর ১১ নভেম্বরকে হিজবুল্লাহ তাদের ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালন করে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের স্মরণেই দিনটি পালন করে আসছে হিজবুল্লাহ।
শহীদ দিবস উপলক্ষে হিজবুল্লাহর মুখপাত্র মোহাম্মদ আফিফ বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলিতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেন। এই শহরতলির বেশির ভাগটা ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
সাংবাদিকেরা খুব সাবধানে ধ্বংসস্তূপ আর বারুদের গন্ধের ভেতর দিয়ে লর্ড অব মর্টার কমপ্লেক্সে যান। এখানে দাঁড়িয়েই হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ভাষণ দিতেন। গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েলি হামলায় তিনি নিহত হন।
ইসরায়েলে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং হিজবুল্লাহর দুর্গে সংবাদ সম্মেলন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রতীকী মূল্য রয়েছে। কেননা ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, যুদ্ধের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ‘কৌশলগত ব্যবস্থার পরিবর্তন’ করা।
এই বক্তব্যের তাৎপর্য হচ্ছে, ‘প্রতিরোধের অক্ষের’ ভিত্তিমূল হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে ফেলা। কেননা হিজবুল্লাহ ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া ও অন্য জায়গায় ইসরায়েলবিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা।
এসব প্রতীকী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হিজবুল্লাহ তার শত্রু ও সমর্থক—দুই পক্ষকেই দেখাতে চায় যে সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের পরও তাদের শক্তি দৃঢ় আছে এবং তারা লড়াইয়ের প্রতি স্থিরপ্রতিজ্ঞ।
লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখনো বড় কোনো ফাটল তৈরি হয়নি। হিজবুল্লাহ এখনো ইসরায়েলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু। কিন্তু যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকবে।
সেপ্টেম্বর মাস থেকে হিজবুল্লাহর ওপর বড় বড় আঘাত এসেছে। তাদের যোগাযোগ নেটওয়ার্কে ডিভাইস বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে হাসান নাসারুল্লাহসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি বাহিনী হাজার হাজারবার বিমান হামলা করেছে এবং লেবাননে কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়েছে। যদিও ইসরায়েলের সেনারা দক্ষিণাঞ্চলের একটি গ্রামও দখলে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আফিফ বলেন, ‘আমাদের লড়াই করার একটা দৃঢ় ইচ্ছা আছে। আর আমরা একটা দীর্ঘ যুদ্ধের জন্য নিজেদের পুনর্গঠিত করছি, প্রস্তুতি নিচ্ছি।’ এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ প্রতিরোধের ভাগ্য এবং লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।’
১৩ নভেম্বর দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের আক্রমণে নয়জন ইসরায়েলি সেনা নিহত হন।
হাসান নাসরুল্লাহর নিহত হওয়ার পর যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল, লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে হিজবুল্লাহ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নাইম কাশেমকে দলের প্রধান নির্বাচিত করার পর হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব পর্যায়ে পুনর্গঠন শুরু হয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যেসব কমান্ডার নিহত হয়েছেন, তাঁদের জায়গায় নতুন কমান্ডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
গত মাসে হিজবুল্লাহর নতুন মহাসচিব কাশেম তাঁর প্রথম বক্তৃতায় বলেন, ‘সব শূন্য পদ পূরণ করা হয়েছে।’
হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের প্রতিদিনই রকেট ও ড্রোন হামলা অব্যাহত রাখতে পেরেছে। সম্প্রতি তারা ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার এবং ৫০০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম অত্যাধুনিক ফাতেহ–১০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম হয়।
অন্যদিকে ইসরায়েলি বাহিনী, লেবাননের বেশ কয়েকটি সীমান্ত শহরের দিকে অগ্রসর হয়েছে। তারা হিজবুল্লাহ টানেল ও অস্ত্রভান্ডার ধ্বংস করার দাবি করেছে। কিন্তু তারা এসব শহরে পুরোপুরি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ মাসের শুরুতে খিয়াম শহর থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে। একইভাবে হিজবুল্লাহ তাদের মিসাইল হামলা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ চাপ
লেবাননের ভেতরে রাজনৈতিক ও সামাজিক চাপের কারণে হিজবুল্লাহর কাজ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম ও অগ্রাধিকারের দায়িত্ব হলো, ইসরায়েলের আক্রমণের কারণে যে ১০ লাখ মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদেরকে পুনর্বাসন করা।
কেননা এই বাস্তুচ্যুত লোকেরা এখন চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করেই হিজবুল্লাহ প্রচুর পরিমাণে খাবার, বিছানা, কম্বল, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র মজুত করেছিল। কিন্তু ইসরায়েলি বিমান হামলায় সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।
এ ছাড়া পেজার ও ওয়াকিটকি নেটওয়ার্কে বিস্ফোরণে হিজবুল্লাহর সামাজিক কর্মকাণ্ড ও চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্ত অনেক কর্মী আহত হন। এসব কর্মীকেই সম্ভাব্য বাস্তুচ্যুত লোকদের দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া ছিল।
এ কারণেই ইসরায়েলি হামলার শুরুর দিনগুলোতে হাজার হাজার লেবাননিকে রাস্তায় তাঁবুতে রাত কাটাতে হয়েছে।
সেই পরিস্থিতির এখন খানিকটা উন্নতি হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, হিজবুল্লাহ এ কাজের জন্য তাদের লোকদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করেছে। একই সঙ্গে এনজিওগুলোর সহায়তায় লেবানন সরকার বাস্তুচ্যুতদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি প্রচেষ্টা দরকার।
হিজবুল্লাহ তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের দিক থেকেও ক্রমাগত সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিশেষ করে লেবাননের খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধের জন্য হিজবুল্লাহকে দায়ী করে যাচ্ছে। লেবাননের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বতন্ত্র পার্লামেন্ট সদস্য একটি সংবাদমাধ্যেমে বলেন, ‘পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতেরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির রাষ্ট্রদূতেরা হিজবুল্লাহকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে লেবাননে হিজবুল্লাহর শত্রুদের উৎসাহিত করছে।’
লেবাননের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফারেস বুয়েজ। মধ্যপন্থী এই রাজনীতিবিদ ম্যারোনাইট খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের। তাঁর মতে, লেবানন গঠন হয়েছে দেশটির বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের ওপর ভিত্তি করে। এটি ঐকমত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যখন কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় তার স্বাভাবিক ভূমিকার চেয়ে বেশি ভূমিকা নেয়, তখন সেই ভারসাম্যটা নষ্ট হয়।’
লেবাননের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন বাড়া সত্ত্বেও বোয়েজ লেবাননের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বড় আকার ধারণ করেনি বলে মনে করেন। তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত মানুষদের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে একটা জাতীয় সংহতি তৈরি হয়েছে। বিভক্তি আছে, এটা সত্য। কিন্তু সেটা এতটা নগণ্য যে জাতীয় ঐক্যে চিড় ধারতে পারবে না।’
লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখনো বড় কোনো ফাটল তৈরি হয়নি। হিজবুল্লাহ এখনো ইসরায়েলের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শত্রু। কিন্তু যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, লেবাননের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উত্তেজনা ততই বাড়তে থাকবে।