২০০১ উত্থান ঘটে স্বর্ণ চোরাচালানি মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের। মন্ত্রীর আশীর্বাদে গণপূর্ত থেকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। তৎকালীন মন্ত্রীর আশীর্বাদেই থেমে থাকেননি গোল্ডেন মনির। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে রঙ পাল্টে ফেলেন। গোল্ডেন মনির রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরে নিজের আধিপত্য ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বর্তমান সরকারের একজন প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রীকে উপহার দিয়েছেন বিলাসবহুল একটি প্রাদো গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-গ-১৮৬৯৪১)। বিনিময়ে ওই প্রতিমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে একটি মামলা থেকে রক্ষা পান।
এ ছাড়া গোল্ডেন মনিরের বিভিন্ন ব্যাংকে ২৫টি অ্যাকাউন্টে বর্তমানে গচ্ছিত রয়েছে নগদ ৯৩০ কোটি টাকা। তার বিপরীতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন (টিন নম্বর- ১৩২২১০৮২০৪) জমা দেওয়ার সময় মোট সম্পদ দেখিয়েছেন মাত্র ২৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা। গোল্ডেন মনিরকে নিয়ে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এদিকে গতকাল আদালত প্রতিবেদকের পাঠানো তথ্যে বলা হয়, গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে রাজধানীর বাড্ডা থানায় দায়ের হওয়া অস্ত্র, বিশেষ ক্ষমতা ও মাদক নিয়ন্ত্রণ মামলায় গতকাল মোট ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম আবু বক্কর সিদ্দিক অস্ত্র ও বিশেষ হ্মমতা আইনের মামলায় ৬ দিন করে ১২ দিন এবং মহানগর হাকিম মাসুদ উর রহমান মাদক মামলায় গোল্ডেন মনিরের ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নব্বইয়ের দশকে বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকাকালীন তার সঙ্গে সুম্পর্ক গড়ে ওঠে মনিরের। তখন থেকেই ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কের আরও উন্নতি হতে থাকে। ওই নেতা ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি গোল্ডেন মনিরের। একদিকে গণপূর্ত এবং রাজউকের প্লট ও ফ্ল্যাট বাণিজ্য, অপরদিকে সোনা শফির সঙ্গে সোনা চোরাচালানে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মনির।
সরকারের একটি সংস্থার দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর তাদের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গোল্ডেন মনিরের সেলসম্যান থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ার পুরো চিত্র। চারটি ব্যাংকের ২৫টি অ্যাকাউন্টে ৯৩০ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে মনিরের। এ ছাড়া মনির বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ১১০ কোটি টাকা। হুন্ডি বাণিজ্যের অন্যতম হোতা ছিলেন মনির। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছে মনির। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় মনিরের ২০২টি প্লট রয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল- পূর্বাচলে ৭ কাঠা, বাড্ডায় ১৯২টি প্লট, নিকুঞ্জ-২ নম্বরের ৫ নম্বর সড়কে ৭০ কাঠার বিশাল প্লট, বাড্ডায় স্কুল, উত্তরায় জমজম টাওয়ারে অংশীদার, উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে নির্মাণাধীন সাফা টাওয়ার অন্যতম। এ ছাড়া বারিধারার প্রগতি সরণির জে ব্লকের ৭৪ নম্বরে রয়েছে গোল্ডেন মনিরের আলিশান অফিস। সোনা চোরাচালান, জমি দখল, হুন্ডি বাণিজ্য, সরকারি দপ্তরের সিল জাল করে অপরাধ কর্মকা- করতেন মনির।
২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর রাজউক থেকে ৭১টি প্লটের ফাইল বাসায় নিয়ে যান মনির। এ ঘটনায় রাজউকের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়। তবে মামলা হলেও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান ও সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিমন্ত্রীর প্রশ্রয়ে মনিরের বিরুদ্ধে করা মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। তারা দুজন মনিরকে বাঁচাতে ছায়া দেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বিনিময়ে মনিরের কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থসহ নানা ধরনের উপঢৌকন বাগিয়ে নেন। গণপূর্ত ও রাজউকে মনিরের রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট বদলি, পদোন্নতিসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত। এ সিন্ডিকেটকে নজরদারি শুরু করেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে তৎকালীন গণপূর্তমন্ত্রী বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্টে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বরাদ্দকৃত প্লট হাতিয়ে নেন মনির। শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে সংসদ সদস্যরা (এমপি) বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করতে পারেন। এসব গাড়ি ন্যূনতম ৫ বছরের আগে বিক্রি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সংসদ সদস্যের আমদানি করা গাড়ি ৫ বছরের আগেই চলে যেত মনিরের হতে। এমন একটি বিলাসবহুল গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫৭০০৭) শেরপুরের এক এমপির কাছ থেকে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় কিনে নেন মনির। যদিও গাড়িটির প্রকৃত মূল্য প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। শুল্কমুক্ত সুবিধায় কমমূল্যে বিলাসবহুল গাড়িটি আনেন এক সাংসদ। সংসদ সদস্যের স্টিকার সাঁটা এ গাড়িটি ব্যবহার করতেন গোল্ডেন মনির। ওই গাড়িতে করে সোনা পাচারসহ নানা অপকর্ম করতেন তিনি।
২০০৪ সালে বাড্ডার লুৎফন টাওয়ারের সামনের সড়কে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় তার আচারণ সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি ইউনিটের হাতে আটক হন গোল্ডেন মনির। তখন তিনি নিজেকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির ছেলে পরিচয় দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেন। তবে তাকে ওই সংস্থার কার্যালয়ে নিয়ে খবর নিয়ে দেখা হয় সে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালের মে মাসে অবসরে গিয়েছি। প্লটের ফাইল চুরির ঘটনা তার পরে ঘটেছে। চেয়ারম্যান হিসেবে তার (গোল্ডেন মনির) সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকতেই পারে। তার মানে এই নয় যে, আমি তার অনৈতিক কর্মকা-ে সহায়তা দিয়েছি।
এদিকে, নির্বিঘ্নে টাকাপাচার করতে শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে সিভিল এভিয়েশনে একটি ঠিকাদারি ফার্ম খোলেন শফি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলে ইজারা চালায় গত তিন বছর ধরে। সেখানে শফি ও তার কর্মীদের অবাধ যাতায়াতের জন্য নিরাপত্তা পাস ছিল। অবাধে যাতায়াত করতে পারত সংরক্ষিত এলাকায়। সহজে স্বর্ণ পাচারের হাতিয়ার হিসেবে এই পথ বেছে নেন শফি। এভাবেই গোল্ডেন মনির ও সোনা শফি বিদেশে টাকা পাচারের মাধ্যমে পরিণত করেন এ পন্থাকে। এ বছরের জুন থেকে এ ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন তারা।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, গোল্ডেন মনির দেশের বাইরে কী পরিমাণ অর্থপাচার করেছে বা কী পরিমাণ সম্পদ তার রয়েছে সে বিষয়ে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুরোধ করব। তিনি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে কসমেটিকস পণ্য ও চোরাচালানির মাধ্যমে কী পরিমাণ স্বর্ণ দেশে এনেছিলেন সে বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুসন্ধান করতে অনুরোধ করব।
এদিকে অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটিকে (বিআরটিএ) অনুসন্ধানের জন্য আমরা বলব। এ ছাড়া সে জালিয়াতি করে ভূমি দখল করেছে সেসব বিষয়ে রাজউককে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব অনুসন্ধানের জন্য। মনিরের ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে তার সঙ্গীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে, যোগ করেন র্যাবের এ কর্মকর্তা।