বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহীর একটি আদালত এক ব্যক্তিকে দশ বছরের কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি ২০১৭ সালে ফেসবুকে ‘আওয়ামী’ শব্দ বিকৃত করে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন।
ওই আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোসা ইসমত আরা বেগম বিবিসিকে বলেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তি ইসলামী ছাত্র শিবিরের স্থানীয় একজন নেতা। তিনি আওয়ামী লীগকে হেয় করে পোস্ট দিয়েছিলেন যেখানে তিনি দলটিকে অন্ধকারের দল হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন।
“মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তো যা খুশি তা করার অধিকার আইন দেয়নি। এ ধরনের পোস্টের কারণে তখন এলাকায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা ছিলো। সে কারণেই স্থানীয় একজন বিষয়টি নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আদালতও বলেছেন যে পোস্টটিতে মিথ্যাচার করে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে আসামী পক্ষের আইনজীবী নিজামুল ইসলাম বলছেন তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন কারণ তারা মনে করেন কোন দলকে নিয়ে কৌতুক করলে বা সমালোচনা করলে সেটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে না।
“দলের সমালোচনা বা দলকে নিয়ে কৌতুক করলে তা অপরাধ কেন হবে? মন্ত্রীরা প্রতিনিয়ত বিরোধী দলকে নিয়ে বলছেন আবার বিরোধীরা সরকারকে নিয়ে বলছে এগুলো তো রাজনৈতিক বিষয়। আমরা হাইকোর্টে যাবো এবং আশা করি সেখানে ন্যায় বিচার পাবো,” বলছিলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন পান থেকে চুন খসলেই অনেকে এখন আদালতে যাচ্ছেন এবং কারাদণ্ডও হচ্ছে- যা আসলে কর্তৃত্ববাদী শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য।
“ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা কিংবা বিরূপ সমালোচনাকে ফৌজদারি আইনে অপরাধ হিসেবে দেখাটা সভ্য দেশগুলোতে উঠে গেছে ৫০ বছর আগে। বাংলাদেশে এগুলো আদালতে আনা হচ্ছে কারণ এতে করে অন্যরা সমালোচনা করতে ভয় পাবে বলে শাসকগোষ্ঠী মনে করে,” বলছিলেন তিনি।
মামলায় যা বলা হয়েছিল
রাজশাহীর পবা থানায় ২০১৭ সালের ২৮শে মে, ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (সংশোধনী ১৩) ৫৭(২) ধারায় মামলাটি করেছিলেন মোঃ সাইদুর রহমান ওরফে বাদল নামের এক ব্যক্তি।
মামলায় তিনি অভিযোগ করেন যে আব্দুল মুকিত রাজু নামে এক ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডিতে একটি কৌতুক পোস্ট করেছেন যেখানে বলা হয়েছে “আওয়ামী শব্দটি আইয়াম শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার আর লীগ অর্থ দল। আওয়ামী লীগ অর্থ অন্ধকারে দল।”
এছাড়াও ওই পোস্টে বাবা-পুত্রের কথোপকথনের মতো করে এমন কিছু মন্তব্য করা হয়েছে যাতে আওয়ামী লীগ নামের সংগঠনের মানহানি ঘটানো হয়েছে এবং সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়া হয়েছে।
মামলার এজাহারে সাইদুর রহমান বাদল উল্লেখ করেন, “আসামী তার ফেসবুক আইডির মাধ্যমে এহেন ব্যঙ্গ করে আওয়ামী লীগ নামক সংগঠনের বিরুদ্ধে অপমানমূলক, অপপ্রচার মূলক, উস্কানিমূলক কৌতুক প্রচার করে ধর্তব্য অপরাধ করায় আমি নিজে বাদী হয়ে এই এজাহার দায়ের করলাম।”
আদালত যা বলেছে
রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এই মামলায় আসামীকে দশ বছর কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা অর্থদণ্ড এবং অনাদায়ে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।
মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন যে পৃথিবীর কোন সভ্য দেশেই বাক স্বাধীনতা অবারিত নয়-যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে এই স্বাধীনতা ভোগ করতে হয়।
এতে বলা হয়, “আসামীর পোস্ট পড়লে মনে হতে পারে যে কোন ধর্মপ্রাণ বাবা তার শিশুকে শিক্ষা দিচ্ছে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে কৌতুকের নামে যে পোস্ট করা হয়েছে তার মাধ্যমে পরিকল্পিত মিথ্যাচার করা হয়েছে, ঘৃণার বিষবাস্প ছড়ানো হয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উস্কানি দেয়া হয়েছে।”
বিচারক তার পর্যবেক্ষণে আরও বলেন যে, পোস্টে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের নাম নেয়া পাপ, এটা গজবের নাম। ইসলামের নামে গল্প ফেঁদে পোস্টদাতা ঘৃণার বিষবাস্প ছড়িয়ে দিচ্ছে।
“পোস্টে বলা হয়েছে আওয়ামী শব্দটি এসেছে আইয়াম হতে যার অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার আর আওয়ামী লীগ অর্থ অন্ধকারের দল। অথচ উর্দু আওয়াম শব্দ থেকে আওয়ামী লীগ শব্দ এসেছে আর উর্দু আওয়াম শব্দের অর্থ জনতা। পোস্টদাতা নির্লজ্জ মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে। আওয়ামী লীগ নাকি দুর্গা দেবীর পূজা করতো। যারা আওয়ামী লীগ করে তাদেরকে এই পোস্টে দানব বলা হয়েছে। এ বক্তব্যের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উস্কানি দেয়া হয়েছে। এই পোস্টে আওয়ামী লীগ শব্দের জায়গায় যে কোন রাজনৈতিক দলের নাম ব্যবহার করলেও একই অপরাধ হতো,” বলা হয়েছে এই পর্যবেক্ষণে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোসা ইসমত আরা বেগম বলছেন মামলাটি আওয়ামী লীগের দলগত সিদ্ধান্ত থেকে না হলেও আওয়ামী লীগের একজন কর্মী এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলার স্বার্থে এটি করেছেন।
“এটি না হলে তখন বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা ছিলো। কারণ আওয়ামী লীগকে এভাবে বিকৃত করে বর্ণনা করায় সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছিল। আদালত যথাযথভাবে সেটি তুলে ধরেছে,” বলছিলেন তিনি।
আসামী পক্ষের আইনজীবী নিজামুল ইসলাম বলেন ফেসবুক পোস্টটি কোন ফোন থেকে পোস্ট করা হয়েছে তা পরীক্ষাই করা হয়নি।আবার এ ধরনের কৌতুকের কারণে একটি দলেরও মানহানির সুযোগ নেই।
“রাজনৈতিক দল নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, ব্যঙ্গ, কৌতুক- এগুলো বিশ্বব্যাপী প্রচলিত বিষয়। এগুলোর কারণে বিশৃঙ্খলা হয় না। মানহানিও হওয়ার কারণ নেই,” বলছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক বিতর্ক-কুৎসা আদালতে আনা কতটা যৌক্তিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা কিংবা কোন একটা বিষয় নিয়ে কৌতুক করা বা বিরূপ সমালোচনা করার মতো বিষয়গুলোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা ফৌজদারি আইন থেকে উঠে গেছে অন্তত ৫০ বছর আগে।
কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই ফৌজদারি আইনে মামলা হচ্ছে বাংলাদেশে এবং কারাদণ্ডও হচ্ছে এবং এগুলো কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোই সাধারণত এভাবে সামনে নিয়ে আসে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
“এগুলো দেওয়ানি ব্যাপার। দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করবে। কিন্তু সব কর্তৃত্ববাদী সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো তাদের যে অবস্থান সেটা কেউ যাতে ক্ষুণ্ণ বা সমালোচনা না করতে পারে সেজন্য তারা ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ বা মানহানির মতো বিষয়কে সামনে নিয়ে আসে।”
তিনি বলেন, বহু আলোচিত ৫৭ ধারার পর এগুলো বেশি করে আসছে আর এটি করা হচ্ছে কারণ এখন যে কোন ব্যক্তি যে কোন ব্যাপারে মন্তব্য করতে ভয় পাবে।
প্রসঙ্গত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই আপত্তি জানিয়ে আসছিলো। যেটিকে সংশোধন করে পরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়। তবে এ আইনেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণের অনেক উপাদান থাকায় এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে সংবাদকর্মী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
মি. মালিক বলেন যে রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক কাদা ছোঁড়াছুড়ি হয় কিংবা একে অন্যকে ব্যঙ্গ করে যেগুলো এভাবে আদালতে আসতে থাকলে তো অন্য কাজ করাই মুশকিল হয়ে যাবে এবং রাজনীতির অনেক বিষয় থাকে যা আদালত নিজেও ধর্তব্যে নেন না।
”তবে এখনও নিম্ন আদালত আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে, যা সরকারের অংশ। অনেক সময় সেখানকার বিচারকরা এমন কোন রায় দিতে চান না, যেখানে সরকার খুশি হবে না। ফলে নিম্ন আদালতে আগে মানুষ সুরক্ষা দিতে পারলেও এখন অনেক সময় তা পারছে না।”
ঢাকায় জনস্বার্থে অনেক ইস্যুতে রিট করার জন্য সুপরিচিত আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন ব্যক্তির মানহানি হলে আইন অনুযায়ী মানহানি মামলা হয় কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে।
“কিন্তু আওয়ামী লীগ তো প্রতিষ্ঠান। এ মামলায় আওয়ামী লীগের মানহানি হলে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি।”
তিনি বলেন কিছু বিষয় আছে যেগুলো রাজনীতি ও সংবিধানের সাথে জড়িত। সেগুলো অনেক সময় আদালতে আসে জাতীয় স্বার্থে কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রচার-পাল্টা প্রচার, কুৎসা-পাল্টা কুৎসা এগুলো তো আদালতে বয়ে আনার যুক্তি নেই।
“এসব বিষয়ে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স যারা করবেন তাদের শক্তভাবে এগুলো দেখা উচিত। সব বিষয় আদালতে আসলে তো হবে না,” বলছিলেন তিনি।