ওসিলা, এই শব্দটি কুরআনুল কারীম এর সূরা মায়িদা এর ৩৫ নং আয়াতে এসেছে। উপমহাদেশের (তথা ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান) কয়েকটি দেশ সহ কিছু মুসলিম দেশেও এই আয়াত ও এই ওসিলা শব্দটিকে বলা হয়ে থাকে পীর ধরার কথা বলা হয়েছে। ওসিলা শব্দটির সঠিক অর্থ জানতে চাই। এই আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা জানতে চাই।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوٓا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجٰهِدُوا فِى سَبِيلِهِۦ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে ঈমানদাগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, (আনুগত্য ও সন্তোষজনক আমলের মাধ্যমে) তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান কর এবং তাঁর পথে জিহাদ কর, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পার।”
(সূরা মায়িদা: ৩৫)
উক্ত আয়াতের সঠিক তাফসিরঃ
আল্লাহ তাআলা মু’মিনদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁকে ভয় করার এবং তাঁর কাছে ওসিলা বা নৈকট্য অন্বেষণ করার। ওসিলা (الوسيلة) এর আভিধানিক অর্থ হল মাধ্যম ও নৈকট্য।
আন-নিহায়াহতু ফী গারীবিল হাদিস ওয়াল আসার ৫/১৮৫, লিসানুল আরব ১১/৭২৪
উপরে উল্লেখিত উভয় অর্থেই ওসিলা শব্দটি ব্যবহার হয়। তবে সাহাবি, তাবেঈ ও বিশিষ্ট মুফাসসিরগণ এ আয়াতে ওসিলা শব্দটিকে মাধ্যম অর্থে ব্যবহার না করে “নৈকট্য” অর্থে ব্যবহার করেছেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, الوسيلة অর্থ القربة বা নৈকট্য। কাতাদাহ রাহ. বলেন,
تقربوا إليه بطاعته والعمل بما يرضيه
“আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য ও যেসব কাজে তিনি খুশি হন, তার দ্বারা তাঁর নৈকট্য হাসিল কর।”
ইবনে কাসির, ৩/১২৪
তাই আয়াতের অর্থ হলঃ হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় কর এবং তাঁর আনুগত্য ও সৎ আমলের মাধ্যমে নৈকট্য অন্বেষণ কর।
যেভাবে ওসিলা শব্দটির অপব্যাখ্যা করা হয়ঃ
এক শ্রেণির নামধারী মুসলিম ইসলামকে ব্যবসার বস্তু বানিয়ে নিজের জীবনোপকরণ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। আর অপর শ্রেণি ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে তাদের ব্যবসাকে ভাল মনে করে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সহজ কথায় ওসীলার দোহাই দিয়ে পীর-মুরিদীর ব্যবসা চালু করেছে।
সেসব নামধারী ধর্মীয় ব্যবসায়ীগণ বলে: শুধু ঈমান ও আমলের দ্বারা সাধারণ মানুষের পক্ষে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল করা সম্ভব নয় বরং একজন পীরের হাতে বাইআত নিতে হবে।
বান্দা যখন গুনাহ করতে করতে চরম পর্যায়ে চলে যায় তখন আল্লাহ তাআলা ও বান্দার মাঝে আড়াল সৃষ্টি হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা সে বান্দার গুনাহ ক্ষমা করতে চান না। পীর সাহেবের অনুনয়-বিনিয়ের কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেন। জনৈক পীর সাহেব অত্র আয়াতের তাফসীরে তার বইতে লিখেছেন: “আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের জন্য একজন পীরের হাতে বাইআত কর।” (নাউযুবিল্লাহ)
মূলত কোন পীর, গাউস-কুতুব, বাবা, খাজার হাতে বাইআত করা অথবা মাজারে গিয়ে ওসিলা তালাশ করা সম্পূর্ণ শিরকি ও বিদআতি কাজ-যা মক্কার তৎকালীন মুশরিকরা করত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَي اللّٰهِ زُلْفٰي
“আমরা তো এদের উপাসনা এজন্য করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছে দেয়।”
সূরা যুমার ৩৯:৩
শরিয়তসম্মত ওসিলা তিন প্রকারঃ
১. আল্লাহ তাআলার সুন্দর নাম ও গুণাবলীর ওসিলায় দুআ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلِلہِ الْاَسْمَا۬ئُ الْحُسْنٰی فَادْعُوْھُ بِھَا
“আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাক।”
সূরা আরাফ ৭:১৮০
অনুরূপ সহীহ হাদিসে এসেছে:
يا حَيُّ يا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ
“হে চিরঞ্জীব! হে সবকিছুর ধারক! আমি তোমার রহমতের ওসীলায় সাহায্য কামনা করছি।”
নাসায়ী হা: ৩৫২৪, সহীহ
২. সৎ আমলের দ্বারা ওসীলা করা। যেমন ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি।
সহীহ হাদিসে এসেছে- একদা বানী ইসরাইলের তিন ব্যক্তি পথে চলছিল, ঝড় বৃষ্টির কারণে তারা একটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গুহায় আশ্রয় নেয়। পাহাড়ের চূড়া থেকে একটি পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে তারা পরস্পর বলতে লাগল,
إِنَّهُ لَا يُنْجِيْكُمْ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ إِلَّا أَنْ تَدْعُوا اللّٰهُ بِصَالِحِ أَعْمَالِكُمْ
“তোমাদের সৎ আমলের ওসিলায় আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান না করা ব্যতীত এ পাথর থেকে তোমাদের মুক্তির কোন উপায় নেই।”
সহীহ বুখারি হা: ২২৭২, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৪৩
মানুষ তার কৃত শরিয়তসম্মত আমলের ওসিলায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে মুক্তি ও সাহায্য চাইবে।
৩. কোন ব্যক্তির দুআর মাধ্যমে ওসিলা করা। তবে শর্ত হল:
- ব্যক্তি জীবিত থাকতে হবে।
- ব্যক্তি নেককার ও মুত্তাকি হতে হবে।
- উপস্থিত থাকতে হবে।
যেমন সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর চাচা আব্বাস রা.-এর দু‘আর ওসীলায় আল্লাহ তাআলার কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করতেন। (সহীহ বুখারি হা: ১০১০)
অতএব কোন মৃত ব্যক্তির ওসিলা গ্রহণ করা, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সত্ত্বা দ্বারা ওসিলা তালাশ করা, তার সম্মান ও মর্যাদা দ্বারা ওসিলা তালাশ করা ও কোন বুজুর্গ ব্যক্তি, কবর বা মাজারের ওসিলা তালাশ করা বিদআত এবং পর্যায়ক্রমে তা শিরকে পৌঁছে দেয়া।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
- সর্বদা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা আবশ্যক।
- ঈমান ও সৎ আমল দ্বারা ওসীলা গ্রহণ করা শরীয়তসম্মত।
- শর্ত সাপেক্ষে জীবিত ব্যক্তির ওসিলা গ্রহণ বৈধ।
- সমাজে প্রচলিত ওসিলার অপব্যাখ্যা ও পীর-মুরিদির অসারতা সম্পর্কে জানলাম।
- কিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য কোন প্রকার বিনিময় দেয়া যাবে না।
[উৎস: ফাতহুল মাজিদ]
সংকলন ও গ্রন্থনায়ঃ
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।