বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিক থাকলেও শুরুতে মানুষ যতটা বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল বর্তমানে মানুষ তার চেয়ে আরো বেশি বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের মানুষরা অনেক বেশি কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হচ্ছে। শুরুতে বিভিন্ন ব্যাক্তি, সংস্থ্যা থেকে সাহায্য-সহযোগীতার তৎপরতা থাকলেও বর্তমানে তা প্রায় নেই বললেই চলে। এজন্য সামর্থ্যবানরা এই সমস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো উচিত তাদের সেবা শুশ্রূষা করা উচিত। তাদেরকে সহযোগিতা করা উচিত। আর মানবসেবা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট অনেক বড় ইবাদত। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ-
(وَأَحْسِنُوَاْ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ) [البقرة: 195].
“তোমরা ইহসান করো,আল্লাহ ইহসান কারীগণকে ভালোবাসেন।”
রাসূল সঃ বলেছেনঃ-
“ومن يسر على معسر يسر الله عليه في الدنيا والآخرة”.بخاري.
“যে ব্যাক্তি কারো কষ্ট সহজ করে দেয় আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতে তার কষ্ট সহজ করে দেন”
“والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه”.مسلم
“আল্লাহ সে বান্দাহকে সাহায্য করেন, যে বান্দাহ তার অপর ভাইকে সাহায্য করে।”
রাসূল (সঃ) বলেছেন “ফরজ ইবাদতের পর সর্বোত্তম আমল হলো একজন মুসলমানের খুশির ব্যবস্থা করে দেওয়া, খাদ্যের ব্যবস্থা করে দেওয়া। এছাড়া সূরা বালাদ এর মধ্যে এতিম মিসকিনদের কে খাদ্যের ব্যবস্থাকারীকে জাহান্নামের গিরিপথ অতিক্রম কারীর সৌভাগ্য অর্জন করবে বলা হয়েছে।
কোরআনের আয়াত এবং হাদিস গুলো কে সামনে রেখে আমাদের দুনিয়ার জীবন এবং আখেরাতের জীবনকে স্বাবলম্বী করার জন্য সামর্থ্যবানদের কে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা উচিত। এক্ষেত্রে যার যার অবস্থান থেকে পেশা গত ভাবেও আমরা অসহায় মানবতার কল্যাণে সহযোগিতা করা পারি। সবাই যার যার সামর্থ্যানুযয়ী এই মহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
♦চিকিৎসক বা সেবক/সেবিকাগণঃ-
ডাক্তার, নার্স ও সেবক-সেবিকাগণ নিজেদের দায়িত্বের সর্বচ্চো পেশাদারিত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে অনন্য দৃষ্টান্ত স্হাপন করতে পারেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেন,,
“وَمَنْ أَحْيَاهَا فَكَأَنَّمَا أَحْيَا النَّاسَ جَمِيعًا”
“যে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করলো সে যেন গোটা মানবজাতির জীবন রক্ষা করলো। “
এছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ওসমান (রাঃ) কে বদর যুদ্ধে অংশ না নিয়ে তার অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এবং অসুস্থ রোগীর সেবা-শুশ্রূষা করাকে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণের মর্যাদা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি তাঁকে বলেছেনঃ-
إِنَّ لَكَ أَجْرَ رَجُلٍ مِمَّنْ شَهِدَ بَدْرًا وَسَهْمَهُ
“তোমার জন্য বদরে অংশ গ্রহণকারী ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াব ও গনীমতের অংশ মিলবে।” বুখারী
চিকিৎসক এবং সেবক/সেবিকাগণ সেবাদান করার মাধ্যমে রোগীদের প্রতি ইহসান করে আল্লাহর ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হতে পারেন। কেননা আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেনঃ-
( وَأَحْسِنُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ,
” তোমরা (রোগীদের উপর) ইহসান করো, নিশ্চয় আল্লাহু ইহসান কারীদেরকে ভালোবাসেন”। বাকারা ১৯৫
♦মালিক/হসপিটাল কর্তৃপক্ষ/ বাড়িওয়ালা/ঋণদাতাঃ–
এই দুর্যোগের দিনে বাড়ির মালিকগণ ভাড়া কমিয়ে বা মওকুফ করার মাধ্যমে, ঋণদাতাগণ ঋণ মওকুফ বা ঋণগ্রহীতাকে অবকাশ দেওয়ার মাধ্যমে এবং হসপিটাল সহ বিভিন্ন কতৃপক্ষ রোগীর বিল, ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুফ করে বা সীমিত করার মাধ্যমে মানবতার সেবায় নিজেদেরকে অংশীদার বানিয়ে আল্লাহর আরশের নিচে জায়গা করে নিতে পারেন। কেননা রাসূল (সঃ) গ্যারান্টি দিয়ে বলেছেনঃ-
من أنظَر معسرًا أو وضع عنه، أظلَّه الله في ظله
“যে ব্যাক্তি কষ্টে পতিত হওয়া ব্যাক্তি ( ঋণগ্রস্ত /দরিদ্র) কে অবকাশ দেয় এবং তার উপর থেকে (অল্প বা বেশি পরিমাণ বোঝা) তুলে নেয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে (কেয়ামতের দিন) তার আরশের নিছে ছায়ার ব্যবস্থ্যা করে দিবেন।” মুসলীম
♦ফার্মাসিস্ট ও ঔষধ বিক্রেতাগণঃ-
মহামারী করোনা ভাইরাসের দুর্যোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্যানিটাইজার, মাস্ক এবং বিভিন্ন ঔষধ সামগ্রী। সেজন্য ফার্মাসিস্ট ও ঔষধ বিক্রেতাগণ সূলভ মুল্যে তা মানুষের কাছে সরবরাহ করার মাধ্যমে মানবতার কল্যান সাধন করে আল্লাহর প্রিয় পাত্র হতে পারেন। কেননা রাসূল সঃ বলেছেনঃ-
أحب الناس إلى الله أنفعهم للناس
“অর্থ্যাৎ; আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হলো সে ব্যক্তি, যে মানুষের মধ্যে অধিক কল্যানের ব্যবস্থ্যা করে।” তাবরানী
♦ব্যবসায়ীগণঃ
ব্যবসায়ীগণ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম না বাড়িয়ে, বরং মহামারির এই দিনে মুল্য কমানোর মাধ্যমে, মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করে এবং নকল ও ভেজাল সামগ্রী বিক্রয় করা হতে বিরত থেকে, সকল পণ্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার ভিতরে রেখে মানবতার পাশে দাঁড়িয়ে নবী, শহীদ,ও সিদ্দিকগণের সঙ্গী হতে পারেন। যারা ওয়াদা রাসূল (সঃ) নিজে দিয়েছেনঃ-
((التاجر الصدوق الأمين مع النبيين والصديقين والشهداء ))
“সৎ ও বিশ্বস্ততার সাথে ব্যবসাকারীগণ নবী, সিদ্দিক এবং শহীদদগণের সাথে থাকবেন।”
পক্ষান্তরে, অসৎ , ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য কারীদের ব্যপারে বলা হয়েছে:-
من غشنا فليس منا.
“অর্থাৎ যে প্রতারণা করলো ( ভেজাল বা নকল তৈরি করে/মুল্য বৃদ্ধি করে/কৃত্রিম সংকট তৈরি করে) সে আমাদের (মুসলিম উম্মার) অন্তর্ভুক্ত নয়।” মুসলিম
এ ছাড়াও আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ-
وَمَنْ يَغْلُلْ يَأْتِ بِمَا غَلَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ}~
“যে ব্যাক্তি প্রতারণার বা ধোঁকার আশ্রয় নিবে সে কেয়ামতের দিন তা নিয়ে উপস্থিত হবে।” আল-ইমরান ১৬১
♦ধনী ও সম্পদশালীগণঃ-
রাসূল সঃ বলেছেনঃ-
مَن كان معه فضلُ ظهرٍ، فليَعُد به على مَن لا ظهر – (أي دابة) – له، ومن كان له فضل من زاد، فليَعُد به على مَن لا زاد له
“যার কাছে অতিরিক্ত বাহন রয়েছে সে যেন যার বাহন নেই তাকে দান করে। আর যার নিকট অতিরিক্ত জীবন ধারণের উপকরন রয়েছে সে যেন তা, যার নেই তাকে দান করে।” মুসলিম
এজন্য মানবতার এই দুর্দিনে সবচেয়ে বেশি ভুমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে ধনী ও সম্পদশালীদের। দান, সদকা, খাদ্য ও ঔষধ সামগ্রি বিতরণ, অর্থনৈতিক সাপোর্ট দেওয়ার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে এক অনন্য ফজিলত ও মর্যাদায় উন্নীত করতে পারেন। কেননা কুরআন সুন্নায় বহু জায়গায় ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে সামান্য কিছু যেমনঃ-
( ارْحَمُوا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ ) رواه أبو داود
“অর্থ্যাৎঃ তোমরা যমীনের অধিবাসীদের উপর অনুগ্রহ করো, তাহলে আসমানের মালিক তোমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন।” আবু দাউদ
أحب الأعمال إلى الله سرور تُدخله على مسلم، أو تكشف عنه كربةً، أو تقضي عنه دينًا، أو تطرد عنه جوعًا،
“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো কোন মুসলিমের (চাহিদা পূরণের মাধ্যমে) খুশি বা প্রশান্তির ব্যবস্থ্যা করা, অথবা তার কোন কষ্ট দূর করা, অথবা তার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেয়া, বা তার ক্ষুধা নিবারণের বন্দোবস্ত করতে পারে।” সহীহ আল জামি
♦সাধারণ জনগণঃ
নিজের চাহিদার উপর অন্যের চাহিদাকে প্রধান্য দেওয়া। যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও ঔষধ সামগ্রী ক্রয়ের ক্ষেত্রে।
এ ক্ষেত্রে রাসূল (সঃ) এর এই বাণী স্মরণ রাখতে পারেন।
لا يؤمن أحدكم حتى يحب لأخيه ما يحب لنفسه.
“অর্থ্যাৎঃ তোমাদের মধ্যে কেউই পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবেনা যতক্ষণ না সে নিজের পছন্দের উপর তার ভাইয়ের পছন্দকে প্রাধান্য দিবে না।” বুখারী ও মুসলিম
স্বাস্থ্যবিধি ও করোনা প্রতিরোধের নিয়মকানুন গুলো যথাযথ ভাবে মেনে চলে নিজের ও অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কেননা আল্লাহু তা’য়ালা বলেছেনঃ-
(وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ ۛ وَأَحْسِنُوا
“নিজের হাতে নিজকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না এবং সর্বোত্তম (ব্যবস্থা) পন্থা অবলম্বন করো।”
তাছাড়াও রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ-
“لا ضرر ولا ضرار”
অর্থ্যাৎঃ এমন কাজ বা কিছু করা যাবেনা, যাহার দ্বারা নিজের ক্ষতি হয়, বা অন্যকে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। “
মিথ্যা খবর বা তথ্য প্রচার না করা/ গুজব না রটানো/ বা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায় বা আতঙ্ক তৈরি হয় এমন কর্মকান্ড হতে নিজেদেরকে বিরত রাখা। হাদীসে এসেছে:-
(كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ
“কোন ব্যাক্তি মিথ্যাবাদি হওয়ার জন্য ইহাই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তা প্রচার করে বেড়ায় ” মুসলিম
ইনশাআল্লাহ, আমরা এই সমস্ত কাজগুলো করার মাধ্যমে মানবতার কল্যাণে আমরা অংশীদার হতে পারবো। করোনা ভাইরাসের এই মহাদুর্যোগে নিজেদেরকে এবং অন্যদেরকেও হেফাযত রাখতে পারবো। পাশাপাশি মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের অধিকারী হয়ে করোনাকে করুণায় রূপান্তর করতে পারবো।
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সকলকে তৌফিক দান করুক। আমীন।