‘আল-কালাম’ অর্থ কথা, বাক্য, বক্তব্য, বিতর্ক ইত্যাদি। গ্রীক ‘লগস’ শব্দ থেকে কালাম শব্দটি গৃহীত হয়েছে। লগস শব্দটির অর্থ বাক্য, যুক্তিবৃত্তি, পরিকল্পনা ইত্যাদি। লগস শব্দ থেকে লজিক শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ তর্কশাস্ত্র বা যুক্তিবিদ্যা। সম্ভবত মূল অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে হিজরী দ্বিতীয় শতকের আরব পণ্ডিতগণ লজিক শব্দের আরবী প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইলমুল কালাম’ (কথাশাস্ত্র) পরিভাষা ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে এই অর্থে ‘ইলমুল মানতিক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার আভিধানিক অর্থও ‘কথাশাস্ত্র’। মোটকথা ‘ইলমুল কালাম’ বা ‘ইলমুল মানতিক’ বলতে ‘দর্শনশাস্ত্র’ বা ‘তর্কশাস্ত্র’ ভিত্তিক ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা বা গবেষণা বুঝানো হয়।
প্রাচীন যুগ থেকে দার্শনিকগণ মানবীয় যুক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান বা দর্শনের মাধ্যমে মানবীয় ইন্দ্রিয়ের অজ্ঞাত বিষয়সমূহ নিয়ে গবেষণা করেছেন। স্রষ্টা, সৃষ্টি, সৃষ্টির প্রকৃতি, স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তি-তর্ক দিয়ে তাঁরা অনেক কথা বলেছেন। এ সকল বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিতর্ক মানুষকে অত্যন্ত আকর্ষিত করলেও তা কোনো সত্যে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ, মানুষ যুক্তি বা জ্ঞান দিয়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে বা নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু স্রষ্টার প্রকৃতি, কর্ম, বিশেষণ, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে চূড়ান্ত সত্যে পৌঁছাতে পারে না। এজন্য কখনোই দার্শনিকগণ এ সকল বিষয়ে একমত হতে পারেননি। তাদের গবেষণা ও বিতর্ক অন্ধের হাতি দেখার মতোই হয়েছে।
(‘আল ফিকহুল আকবার’ বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা; ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, প্রকাশকাল, জানুয়ারী ২০১৪ইং ১৪৮পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে মুসলিম সমাজে ‘ইলমুল কালাম’ দর্শনশাস্ত্র বা ‘ইলমুল মানতিক’ তর্কশাস্ত্রের কোনো পরিচিতি ছিল না। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে বিশেষত ১৩২ হিজরী (৭৫০ খষ্টাব্দ) সালে আব্বাসী খিলাফতের প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম উম্মাহ’র মধ্যে গ্রীক, ভারতীয় ও পারসিক দর্শন প্রচার লাভ করে। তখন মূলধারার তাবে‘ঈগণ ও তাদের অনুসারীগণ আকীদাহ-বিশ্বাস বা গাইবী বিষয়ে ‘ইলমুল কালাম’ তথা দার্শনিক বিতর্ক কঠিনভাবে অপছন্দ করতেন। কারণ তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে আকীদাহ-বিশ্বাস বা গাইবী বিষয়ে ওহী তথা আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করা এবং ওহীর নিদের্শনাকে চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়াই মুমিনের মুক্তির পথ। তাঁরা আল-কুরআন, সহীহ হাদীস ও সাহাবীগণের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে আকীদাহ চর্চা করেছেন। এর বিপরীতে দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা নির্ভর আকীদাহ চর্চা কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি তাঁরা সঠিক আকীদাহ প্রমাণের জন্যও দর্শননির্ভর বিতর্ক নিষেধ করেছেন। কারণ, সালাফে সালেহীনের আকীদাহ চর্চা ও ইলমুল কালামের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ওহী এবং আকল-এর।
সালাফে সালেহীনের আকীদাহ চর্চা ওহী নির্ভর, বিশেষত কুরআন, হাদীস ও ‘আসার’ বা সাহাবীগণের বক্তব্য নির্ভর। পক্ষান্তরে ইলমুল কালামের আকীদাহ চর্চা ‘আকল’ বোধশক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও দর্শননির্ভর।
সালাফে সালেহীনের বক্তব্য সর্বদা নিম্নরূপ: “তোমার বিশ্বাস এরূপ হতে হবে; কারণ কুরআনে, হাদীসে বা সাহাবীগণের বক্তব্যে এরূপ বলা হয়েছে।” পক্ষান্তরে ইলমুল কালামের বক্তব্য হচ্ছে: “তোমাকে এরূপ বিশ্বাস করতে হবে; কারণ জ্ঞান, বিবেক ও যুক্তি এটিই প্রমাণ করে।”
‘ইলমুল কালাম’ ‘ইলমুল মানতিক’ তথা দর্শনশাস্ত্র চর্চার ভুত মুসলিমদের কাঁধে চাঁপার ফলে কাদারিয়া, জাবারিয়া, জাহমিয়া, মু‘তাযিলা, আশ‘আরী, মাতুরিদী ইত্যাদি ভ্রান্ত মতবাদের জন্ম হয়। ফলে ওহী তথা কুরআন-সুন্নাহ নির্ভর, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের অনুসারী, সহীহ আকীদায় বিশ্বাসী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ বিভিন্ন সময় এরূপ বাতিল ফিরকা দ্বারা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের ইমাম, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহকে নির্যাতন করার ঘটনা কার অজানা? পথভ্রষ্ট মু‘তাযিলা ফিরকার আলেম, হানাফী মাযহাবের অনুসারী, বিচারপতি আহমাদ ইবন আবী দুআদ এর নির্দেশে আব্বাসী খলিফা মু‘তাসিমের সম্মুখে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয়েছে। এই সম্মানিত ইমামকে দীর্ঘদিন বন্দী রাখা হয়েছে। তাঁর অপরাধ কী ছিল? তিনি মু‘তাযিলা পথভ্রষ্টদের কুফুরী আকীদায় বিশ্বাসী ছিলেন না। মু‘তাযিলা পথভ্রষ্টরা বিভিন্ন রকমের ভ্রান্ত আকীদায় বিশ্বাসী ছিল, তারা বলতো: কুরআন সৃষ্ট বা মাখলুক এবং আখেরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে না। আর ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলতেন: “কুরআন আল্লাহর কালাম এবং আল্লাহর সিফাত-গুণ। আল্লাহ যেমন সৃষ্ট নন তাঁর কালামও সৃষ্ট নয়। আর কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, আখেরাতে মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে দেখবেন”। মূলতঃ এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সহীহ আকীদাহ। ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র আকীদাহও তা-ই।
আফসোসের বিষয় এই যে, বহু পূর্বকাল থেকেই কিছুলোক নিজেদেরকে ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র মাযহাবের অনুসারী বলে দাবী করে আসছেন। অথচ তারা ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র সহীহ আকীদায় বিশ্বাসী নন। এমনকি যারা ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র সহীহ আকীদায় বিশ্বাসী তাদেরকে এই নামদারী হানাফীরা বাতিল বলে ফাতওয়া দিয়ে নির্যাতন করে থাকেন। পথভ্রষ্ট মু‘তাযিলা ফিরকার আলেম, হানাফী মাযহাবের অনুসারী, বিচারপতি আহমাদ ইবন আবী দুআদ-এর নাম এই দাবীর চমৎকার উদাহরণ। এই নরাধম হানাফী হওয়া সত্ত্বেও ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র সহীহ আকীদায় বিশ্বাসী ছিল না। বরং ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ যিনি ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র ন্যায় সহীহ আকীদায় বিশ্বাসী, তাঁকে এই হতভাগা বিচারপতি ‘মুশরিক’ বলে কতলের নির্দেশ দিয়েছিল। এমনকি এই নরপশু নিজে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ’র রক্তের দায় বহন করার ঘোষণা দিয়েছিল।
(‘আল ফিকহুল আকবার’ বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা; ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স, প্রকাশকাল, জানুয়ারী ২০১৪ইং ২৭৫-২৭৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।)
বর্তমান যুগেও এমন কিছুলোক আছেন, যারা হানাফী বলে দাবী করেন; কিন্তু তারা ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র সহীহ আকীদায় বিশ্বাসী নন। বরং তারা ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ’র সহীহ আকীদার বিপরীত ভ্রান্ত আকীদাহ পোষণ করেন।
‘ইলমুল কালাম’ দর্শনশাস্ত্র চর্চার ভুত মুসলিম সমাজে চেপে বসার কারণে পরবর্তীতে আশ‘আরী মাতুরিদী নামে ভ্রান্ত মতবাদের জন্ম হয়। এই মতবাদের আলেমরা আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলার অনেক সিফাতকে অস্বীকার করেন। এমনকি ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফে‘য়ী ও ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ আল্লাহ তা‘আলার যেসব সিফাত বা গুণাবলীকে স্বীকার করেন সেসব সিফাতকেও তারা অপব্যাখ্যার মাধ্যমে অস্বীকার করেন। হানাফী, মালিকী ও শাফে‘য়ী মাযহাবের কিছু লোক আশ‘আরী মাতুরিদী আকীদাহ গ্রহণ করে ফেলেন। আর তারা ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালিক ও ইমাম শাফে‘য়ী রাহিমাহুল্লাহ’র সত্য-সঠিক সহীহ আকীদাকে বর্জন করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তবে অধিকাংশ হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীগণ তাঁদের ইমাম আহমাদ রাহিমাহুল্লাহ’র সহীহ আকীদায় অটল থাকেন।
আশ‘আরী মাতুরিদীরা আল্লাহ তা‘আলার যেসব সিফাত বা গুণাবলীকে অস্বীকার করেন সেসবের কয়েকটি হলো: আল্লাহ তা‘আলার চেহারা, হাত, ‘আরশের উপরে উঠা, শেষ রাতে নিচের আকাশে অবতরণ করা, ক্রোধ, সন্তুষ্টি, ভালোবাসা ইত্যাদি। এসব অস্বীকার করার কারণ হলো, আকীদাহ চর্চার ক্ষেত্রে তাদের উপর ‘ইলমুল কালাম’ তথা কালাম শাস্ত্র বা দর্শন নামক ‘ভূতের ছায়া’ পড়া।