কুরআনের অনুবাদ ও তাফসিরের ব্যাপারে একটা উসূল খুবই গুরুত্বপূর্ণ
কুরআনের ভাষার ক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুবাদ প্রথমে আসে। আর যেখানে আক্ষরিক আনা যায় না সেখানেই কেবল আলংকারিক অনুবাদ হবে এবং আলংকারিক জায়গায় এমনিতেই আলংকারিক অর্থ হবে।
এটা বিখ্যাত তাফসির “তাদাব্বুরে কুরআন” এ মাওলানা আমীন আহসান ইসলাহি রাহিমাহুল্লাহ তার উস্তাদ মাওলানা হামিদ উদ্দীন আল-ফারাহি রাহিমাহুল্লাহ থেকে এনেছেন।
এর কারণ লী? সোজা কথায় – কুরআনের অর্থ ও এর বিকৃতিরোধ। আর এজন্য কুরআনের নতুন অনুবাদ বা তাফসিরের জন্য আরবী ভাষা ও এর উচ্চতর দক্ষতা থাকা ফরজ (এর মাঝে অলংকারও রয়েছে)। মাওলানা ইসলাহী ছিলেন আরবী ভাষার সুনপন্ডিত, উনি নিজেও এই উসূল অনুযায়ী তাফসির করেছেন দীর্ঘ ২৩ বছরে।
কুরআনের শাব্দিক অনুবাদ বেশিরভাগ অংশেই হয়। কিন্তু যেখানে আমাদের ভাষায় অশ্লীলতা আছে, সরাসরি ঐ শব্দ প্রয়োগ করলে তার খারাপ অর্থ ভেসে উঠে, সেগুলোতে কুরআন ও হাদীস উভয় স্থানেই দেখবেন আলংকারিক শব্দের ব্যবহার হয়েছে স্বতস্ফুর্তভাবে (স্ত্রীকে শষ্যক্ষেত্র বলা (সূরা বাকারা), অযুর আয়াতে স্পর্শ বলে সহবাস বোঝানো(সূরা মায়েদা), স্ত্রীর সাথে সহবাস করাকে হাদীসে জিহাদ শব্দে এসেছে। এছাড়াও কুরআনে ৪০টির মতো প্রবাদ, প্রবচন রয়েছেব যেগুলো সবই আলংকারিক। ফলে শাব্দিক অর্থকে আলংকারিক বানাতে গিয়ে বিকৃতি করে সাহিত্যমান বইলা চিন্তা তো করতেই হবে না, কুরআনে তো এমনিতেই আলংকারিক ভাষার ব্যবহার আছে প্রচুর, যেখানে যেটুকু দরকার।
খোদ কুরআনের আলংকারিক বিষয়ের উপর বই আছে (“কুরআন ও অলংকার”, ইফাবা, বেশ মোটা বই)। তাই, এতো অলংকার থাকতে মূল অর্থের শাব্দিক অনুবাদকে আলংকারিক বানাতে গিয়ে বিকৃতি করতে হবে কেন? এটাতো কুরআনের উসূল, আরবী ভাষার উচ্চতর জ্ঞান, ইসলামের মেজর শব্দগুলোর বিশালতা, প্রজ্ঞা, আলেমদের থেকে কুরআন ও তাফসির বিষয়ে না জানা ও সার্বিক ইসলাম বিষয়ে জানার স্বল্পতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাফসির ইবনে কাসিরে তাফসিরের কয়েকটা মূলনীতি রয়েছে, সাহাবারা কেন তাফসির করতে ভয় পেতেন তার একটা কাহিনি বর্ণিত আছে। কুরআন মানে আল্লাহর কথা। এর অর্থ বা তাফসির করা মানে আল্লাহর কথা ব্যাখ্যা করা। আর স্বল্প জ্ঞানের কারণে বিকৃতি করা মানে আল্লাহর ওহীকে বিকৃতি করা। জাস্ট এই কারণে সাহাবারা তাফসির করতে চাইতেন না। একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলে আরেক সাহাবার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি আবার অন্য সাহাবীর কাছে পাঠাতেন। এভাবে দেখা যেতো আবার প্রথম সাহাবীর কাছে চলে আসতো! এতোটাই সতর্ক থাকতেন তারা।
মূলক শব্দটি ধরি। এই শব্দটি সূরা মূলক, আয়াত আল কুরসি এবং সূরা ফাতিহার তৃতীয় আয়াতের দুই পাঠ মালিক ও মূলক শব্দ নিয়ে পড়ুন। কয়েকটা তাফসির দেখলে বুঝবেন এই শব্দের বিশালতা, এর হুকুম, এর কদর (একচ্ছত্র শক্তি ও ক্ষমতা), এর তাওহীদি গুরুত্ব কতোটা চাতুর্মুখিক ও বিশাল। এমনকি এই শব্দের মাঝে আখিরাতের একটা বড় বিষয়ই জড়িত আছে। জাস্ট, মালিক/মূলক নিয়ে ইমাম আল-শারাওয়ী (রাহুমাহুল্লাহ) এর ব্যাখ্যাটাই দেখুন। তো, একে আলংকারিক হিসেবে এমন শব্দ আনলেন যার মাঝে এর বিন্দুটি আপনার পড়ার সময় চিত্রায়িত হয় না, তখন বুঝতে অসুবিধে হবে না যে এটা বিকৃতির কারণে ঘটেছে।
এই বিকৃতির কারণে দেখবেন অনেক দল-উপদল তৈরি হয়েছে ইতিহাসে (এরকম একটা শব্দ ইয়াকিন)! এজন্য দেখবেন সালাফিদের ব্যাপারে পৃথিবীর যত ভালো আলেমদের সমালোচনা আছে, সেখানে সালাফিদের একটা বড় প্রশংসা পাবেন এই আক্ষরিকতার জন্য। কেননা আক্ষরিকতা ও টেক্স এর কাছাকাছি থাকার কারণে এদের মাঝে বিকৃতি কম, বিদআত কম।
ইমাম আল-শারাওয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) তো ৬০ বছর হওয়ার আগে নিজে তাফসির করার যোগ্য মনে করেন নাই নিজেকে।
আরবী ভাষা না জেনে কুরআনের অনুবাদ না করার জন্য বলতেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
আমি নিজেও অনূদিত বইগুলোতে অনেক কষ্ট করে অনুবাদ আনি, দুই তিনটা অনুবাদ থেকে। কারণ একটাতেও পছন্দসই অনুবাদ পাইনি। ফলে দুই তিনটা মিলিয়ে অনুবাদ আনতে হয় যেন আম পাবলিকরা খুব সহজেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে স্পষ্টভাবে অর্থ বুঝতে পারে। কিন্তু এর মানে এই না যে আমার যোগ্যতাহীনতা সত্ত্বেও নতুন অনুবাদে হাত দিয়ে বিকৃতি ঘটাবো। ফলে আলেম ও মুফাসসিরদের ভালো অনুবাদের উপর নির্ভর করে লিখি।