খাদ্য উৎপাদন ঘিরে যে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে উঠছে, তাতে খাবারের জোগানের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে শতকোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া ও আধুনিক কৃষিব্যবস্থার বিরূপ প্রভাবে মানুষকে খাদ্য ক্রয়ের চেয়ে বাড়তি মূল্য গুনতে হচ্ছে, যা হিসাবে আসে না; কিন্তু এর পরিমাণ অনেক বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বর্তমান কৃষিখাদ্য ব্যবস্থায় মানুষকে পরিবেশগত, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত বিপুল অঙ্কের অদৃশ্য খরচ বহন করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ ১৫৬ দেশকে নিয়ে এফএওর এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক কৃষিখাদ্য ব্যবস্থায় যে অদৃশ্য খরচ তৈরি হচ্ছে তার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ১২ ট্রিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ বা ৮.১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে। এতে নানা ধরনের অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, যার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস।
‘স্ট্যাট অব ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে ২০২৩ সালের পরিস্থিতির ওপর। এতে খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ ও ভোগসহ প্রতিটি স্তরের অদৃশ্য খরচ হিসাব করা হয়েছে তিন ভাগে।স্বাস্থ্যগত, পরিবেশগত ও সামাজিক এই বাড়তি খরচ খাদ্যের প্রকৃত মূল্য, অথচ বাজার মূল্যে উঠে আসে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষিখাদ্য ব্যবস্থায় বাংলাদেশের বছরে অদৃশ্য খরচ হচ্ছে ১১ হাজার ৮৭৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। (প্রতি ডলার ১২০ টাকা হারে) বাংলাদেশি মুদ্রায় যা হয় ১৪ লাখ ২৫ হাজার ১২ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিবেশগত কারণে খরচ হচ্ছে দুই হাজার ৬০৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা তিন লাখ ১২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা।
সামাজিক কারণে খরচ হচ্ছে এক হাজার ৩৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার বা এক লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যগত কারণে বাংলাদেশের খরচ হচ্ছে সাত হাজার ৮৮২ কোটি ডলার বা ৯ লাখ ৪৫ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। অন্যদিকে সামাজিক খরচের মধ্যে কৃষিখাদ্য শ্রমিকদের দারিদ্র্যের কারণে খরচ এক হাজার ২৬৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা এক লাখ ৫২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। পুষ্টির ঘাটতির কারণে খরচ ১১৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ১৪ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, কিভাবে মানুষের অদৃশ্য খরচ বাড়ছে, এসব খরচ তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্যগত সমস্যা, পরিবেশগত দূষণ, বিশেষত উচ্চমধ্য ও উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে।এই প্রতিবেদনে ১৩ ধরনের খাদ্যগত ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অপর্যাপ্ত হোল গ্রেইন (গোটা শস্য), ফল ও সবজি গ্রহণ। মাত্রারিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ এবং বেশি পরিমাণে লাল ও প্রক্রিয়াজাত মাংস গ্রহণ ইত্যাদি। যদিও দেশভেদে খাদ্য তালিকায় ভিন্নতা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যগত ঝুঁকি ছাড়াও অটেকসই কৃষিব্যবস্থা অনুশীলনের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তাতেও অদৃশ্য খরচের বোঝা বাড়ছে। এসব কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হচ্ছে, বিপুল সারের ব্যবহারের কারণে মাটি দূষণ হচ্ছে, জমির ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে এবং পানি দূষণ হচ্ছে। এসব ঘটছে বিশেষত যেসব দেশে কৃষিখাদ্য ব্যবস্থার বৈচিত্র্যায়ণ ঘটছে, যেসব দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উৎপাদন ও ভোগের রীতিতে পরিবর্তন আসছে। এতে পরিবেশগত প্রভাবে অদৃশ্য খরচ দাঁড়ায় ৭২০ বিলিয়ন ডলার। আনুষ্ঠানিকীকরণ ও কৃষিখাদ্য ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত ক্ষতি গুনতে হচ্ছে। যেসব দেশ পরিবেশগত দূষণের কারণে দীর্ঘমেয়াদে সংকটে পড়েছে, তাদের পরিবেশগত ক্ষতি জিডিপির ২০ শতাংশ পর্যন্তও হচ্ছে। আর্থসামাজিক অদৃশ্য মূলও গুনতে হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য ও অপুষ্টি। এতে সামাজিক ক্ষতি দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ৮ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, আমাদের কৃষিখাদ্যে যে রূপান্তর ঘটছে তা যেন টেকসই ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়। এর পাশাপাশি অদৃশ্য যে খরচ হচ্ছে, তাকে জিডিপির হিসাবে প্রকৃত খরচ হিসেবে ধরা উচিত। এর ফলে নীতিনির্ধারকদের জন্য এমন নীতিগ্রহণ সহজ হবে, যাতে কৃষিখাদ্য নিরাপদ ও পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়। এর পাশাপাশি টেকসই খাদ্যশৃঙ্খল অনুশীলনে আর্থিক ও নীতিগত প্রণোদনা দিতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যকর খাবারে উৎসাহিত করতে হবে। এফএওর মহাপরিচালক কিউইউ দাংগুই বলেন, ‘আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এসব সমস্যার সমাধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। পরিবর্তন আনতে ব্যক্তি ও সামষ্টিক উদ্যোগ প্রয়োজন।’