মানুষের মধ্যে যেসব হীন চরিত্র পাওয়া যায়, তার সংশোধন আবশ্যক। তার মধ্যে অন্যতম দুটির কথা রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি হাদিসে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুটি ক্ষুধার্ত বাঘকে যদি বকরির পালের মধ্যে মুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়া হয় তারা যেভাবে বকরির পালের বিনাশ করবে, এর চেয়ে একজন মুসলিমের দ্বিনের বেশি বিনাশ করবে তার দুটি খারাপ চরিত্র : সম্পদের লোভ ও পদমর্যাদার লালসা।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৬)
ভেবে দেখুন! বাঘ স্বভাবগতভাবেই সুযোগ পেলে বকরির পালকে বিনাশকারী, এর ওপর যদি তা ক্ষুধার্ত হয়, এমন একটি নয়; বরং দুটি বাঘকে আবার উন্মুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে বকরির পালের কী সর্বনাশই না করবে।
তদ্রুপ রাসুলুল্লাহ (সা.) এ উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চাচ্ছেন যে সম্পদের লোভ ও পদমর্যাদার লোভ এ দুটি হলো ক্ষুধার্ত বাঘ, আর মানুষ হলো এর সামনে অসহায় বকরির পালের মতো। ক্ষুধার্ত বাঘগুলো যেভাবে বকরির পালের বিনাশ করে ছাড়বে। তদ্রুপ এই দুই চরিত্রও একজন মুসলিমের দ্বিন ও ঈমানের সর্বনাশ করে ছাড়ে।
আত্মমর্যাদাবোধ ও অহংকার এক নয় হ্যাঁ, তবে একটি কথা বুঝতে হবে।
তা হচ্ছে, হাদিসে ‘হুব্বে জাহ’ এর অর্থ বলা হয়েছে ‘সম্মান ও পদমর্যাদার লোভ।’ আর লোভ কাকে বলা হয়? তা হচ্ছে পদমর্যাদা অর্জনের প্রতি সীমাতিরিক্ত লালসা।
ইসলামে ‘হুব্বে জাহ’ থেকে নিষেধ করার অর্থ এই নয় যে অযথা নিজের সত্তাকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করার নির্দেশ রয়েছে। এমন কথা ও কাজ করাও ইসলামে নিষিদ্ধ, যার কারণে নিজেকে মানুষের সামনে লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়, অপমানিত হতে হয়।
প্রয়োজনে পদমর্যাদা গ্রহণ দোষণীয় নয়
তবে কিছু অবস্থা ও প্রেক্ষাপট এ বিধান থেকে ব্যতিক্রম। হাদিসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসুলুুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে আরজ করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন আমানত হারিয়ে যাবে, তখন তুমি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষা করো।’ সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন : আমানত কিভাবে হারিয়ে যাবে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো দায়িত্ব অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে ন্যস্ত করা হবে, তুমি কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অপেক্ষা কোরো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯)
এখন যদি কোনো এমন দ্বিনি কাজ সামনে আসে যা আমি সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবো এবং সেখানে আর অন্য এমন কেউ নেই যে তা ভালোভাবে আঞ্জাম দিতে পারে, তখন যদি কেউ আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা করে ওই দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই, ইনশাআল্লাহ।
যেমন—কোনো মসজিদে নামাজের সময় পৌঁছে দেখল যে সেখানে নামাজের ইমামতি করার মতো অন্য আলেম বা কারি লোক উপস্থিত নেই, তাহলে এখানে বিনয় অবলম্বনের প্রয়োজন নেই; বরং বলে দিন আপনারা দাঁড়ান, আমি নামাজ পড়িয়ে দিচ্ছি।
কেননা এখানে সবার নামাজের বিশুদ্ধতার বিষয় রয়েছে। এ জন্যই ইউসুফ (আ.) মিসরের বাদশাহের সামনে অকপটে বলেছেন, ‘আমাকে ফসলাদি সংরক্ষণসংক্রান্ত দায়িত্ব দিন, আমি এ বিষয়ে আমানতদার ও সঠিক জ্ঞান রাখি।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৫৫)
এখানে পুরো জাতির অস্তিত্ব সংকট তৈরি হয়েছে। তাই এই প্রয়োজন সামনে রেখে তিনি তাঁর যোগ্যতা প্রকাশ করেছিলেন। এটি তিনি করেছিলেন নিজের পদমর্যাদার লোভে নয়; বরং ওই দেশে অবস্থিত সব প্রাণীকে আগত মুসিবত ও সংকট থেকে উত্তরণ ও রক্ষার জন্য তা করেছিলেন।
তদ্রুপ সুলাইমান (আ.) আল্লাহর কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে ক্ষমা করো এবং এমন রাজত্ব দান করো যেমনটি আমার পরে আর কারো জন্য সমীচীন নয়।’ (সুরা সোয়াদ, আয়াত : ৩৫)
ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমনই রাজত্ব দান করেছিলেন, তাঁর রাজত্ব জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে ও প্রাণীজগৎসহ সব সৃষ্টির রাজত্ব দান করেছিলেন। তাই কোথাও যদি এমন কোনো দ্বিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে এসে যায়, যা নিজের প্রবৃত্তি পূরণের নিয়ত না হয় এবং তা গ্রহণ না করার কারণে দ্বিনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে নিজে তা গ্রহণ করার আবেদন করতে পারে। তদ্রুপ নিজে তাতে সক্ষম হলে ওই দায়িত্ব গ্রহণেও কোনো আপত্তি নেই।