আনুষ্ঠানিক লিখিত চাহিদা ছাড়া ও গ্রাহককে অবহিত না করে সরকারি-বেসরকারি মুঠোফোন অপারেটর কোম্পানি থেকে কললিস্ট বা কল রেকর্ড (কথোপকথন) সংগ্রহ অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া এক রায়ে ওই অভিমত এসেছে।
রায়ে আদালত বলেছেন, অডিও-ভিডিওসহ নাগরিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত যোগাযোগ প্রায়ই ফাঁস হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এসব প্রকাশিত হয়, যা এখনকার সাধারণ অভিজ্ঞতা। অথচ এটি ভুলে গেলে চলবে না যে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অন্যান্য যোগাযোগের অধিকার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এটি কোনো আগ্রহী গোষ্ঠীর জন্য সহজেই লঙ্ঘন করা যাবে না। যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষায় সাংবিধানিক অঙ্গীকার (ম্যান্ডেট) যথাযথ বাস্তবায়নে বিটিআরসি ও ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে।
শিশু সৈকত হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিল ও আবেদনের ওপর গত বছরের ২৮ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. শওকত হোসেন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত), বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এ এস এম আব্দুল মোবিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ রায় দেন।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৪৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়।
রায়ে বলা হয়, নির্দিষ্ট অনুসন্ধান বা তদন্তে কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহক ও নাগরিকের যোগাযোগসম্পর্কিত তথ্য বা কললিস্ট দিতে পারে না। তবে কোনো অনুসন্ধান বা তদন্তের কারণ বর্ণনা করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের (অনুসন্ধান বা তদন্তকারী) আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহককে জানিয়েই শুধু ফোন কোম্পানিগুলো কললিস্ট বা তথ্য সরবরাহে বাধ্য থাকবে। তা না হলে সরবরাহ করা তথ্য–উপাত্ত সাক্ষ্যমূল্য হারাবে এবং সরবরাহকারী ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ একজনের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী থাকবেন।
রায়ে আদালত বলেছেন, এটি সময়ের দাবি যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নয়নের পরেও নানা ধরনের অপরাধে এর ব্যবহার হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি তথা ইলেকট্রনিক রেকর্ড বা নথি হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংশোধন বা নতুন আইনের মাধ্যমে সাক্ষ্য আইনটি হালনাগাদ করা উচিত। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে রায়ের অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। রায়ের আলোকে ফোন কোম্পানিগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে বিটিআরসির কাছে অনুলিপি পাঠাতে বলা হয়েছে।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ৭ বছরের শিশু সৈকত খেলতে বাইরে যায়। পরে শিশুটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন সকালে ফোনে কতিপয় অপহরণকারী ১ লাখ টাকা দাবি করে শিশুটির বাবাকে জানায় যে শিশুটি তাদের কাছে আছে। টাকা না দিলে শিশুটিকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ২০১০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানায় মামলা করেন শিশুটির বাবা মো. সিদ্দিকুর রহমান। এ মামলায় ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর রায় দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪। রায়ে অলি আহম্মেদকে (নেত্রকোনা সরকারি কলেজের ছাত্র) মৃত্যুদণ্ড এবং সবুজ মিয়া ও তাপস চন্দ্র সাহাকে (পলাতক) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপর এক শিশুর ১০ বছরের সাজা হয়।
আইনজীবীদের তথ্যমতে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স, দুই আসামির আপিল ও আবেদন হাইকোর্টে শুনানির জন্য আসে। শুনানিতে সাজাপ্রাপ্ত শিশুর জবানবন্দির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে দেওয়া হয়। হাইকোর্ট অলি আহম্মেদ ও সবুজ মিয়াকে খালাস দিয়ে রায় দেন।
আদালতে অলি আহম্মেদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও কায়সার কামাল। আইনজীবী কায়সার কামাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, অলি ফোন করে টাকা দাবি করে ও হুমকি দিয়েছে বলে ওই মামলায় অভিযোগ করা হয়। এর সপক্ষে অলির কললিস্ট সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। এই কললিস্ট যথাযথ নয় এবং এতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো স্বাক্ষরও ছিল না।
কায়সার কামাল বলেন, ‘যে কারণে ওই কললিস্টের সাক্ষ্যমূল্য নেই বলে উচ্চ আদালতে যুক্তি দিয়েছি। এসব যুক্তি আমলে নিয়ে হাইকোর্ট সাক্ষ্য আইন সংশোধনে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এই রায় যুগান্তকারী। রাষ্ট্র ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ রায়ের পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, আইনজীবী হিসেবে এটিই প্রত্যাশা।’