Wednesday, November 29, 2023

আমাদের মুসলিমউম্মাহ ডট নিউজে পরিবেশিত সংবাদ মূলত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের সমাহার। পরিবেশিত সংবাদের সত্যায়ন এই স্বল্প সময়ে পরিসরে সম্ভব নয় বিধায় আমরা সৌজন্যতার সাথে আহরিত সংবাদ সহ পত্রিকার নাম লিপিবদ্ধ করেছি। পরবর্তীতে যদি উক্ত সংবাদ সংশ্লিষ্ট কোন সংশোধন আমরা পাই তবে সত্যতার নিরিখে সংশোধনটা প্রকাশ করবো। সম্পাদক

হোমদৈনন্দিন খবরচট্টগ্রাম কাস্টমসে ভয়াবহ জালিয়াতি: আরেক জাহালমের সন্ধান

চট্টগ্রাম কাস্টমসে ভয়াবহ জালিয়াতি: আরেক জাহালমের সন্ধান

এক জাহালম ব্যাংক ও দুদক কর্মকর্তাদের ভুলে বিনা দোষে ৩ বছর জেল খেটেছেন। এবার চট্টগ্রাম কাস্টমসের করা মামলায় আরেক ‘জাহালম’ ন্যায়বিচারের আশায় আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন।

এ ‘জাহালম’ পেশায় একজন গার্মেন্ট মালিক, নাম আমীনুল ইসলাম। তার বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানের বিআইএন (ব্যবসা নিবন্ধন নম্বর) ব্যবহার করে ও জাল কাগজপত্র বানিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পর্দার ও চেনিল কাপড় আমদানি করেছে। শুধু তাই নয়, আদালতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে রায় নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পণ্য খালাসও নিয়েছে চক্রটি। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

জানতে চাইলে কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে থানায় মামলা করা হয়েছে। পুলিশ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আদালতে চার্জশিট দেবে।

সে অনুযায়ী আদালত বিচার করবেন। তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি আমার যোগদানের আগের। যতদূর জেনেছি, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ জালিয়াতি করেছে। এর সঙ্গে কাস্টমসের লোকজনও সম্পৃক্ত থাকতে পারে। পুলিশ একজনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে বলে জেনেছি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের ওয়াসিফ নিট কম্পোজিটের নামে চায়না থেকে বন্ড সুবিধায় এফওসির (ফ্রি অব কস্ট) মাধ্যমে পলিস্টার ফেব্রিক্স আনা হয়। পণ্য খালাসে ২৩ মে অক্সফোর্ড শিপিং লিমিটেড (সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট) কাস্টমসে বিল অব এন্ট্রি জমা দেয়। এক মাস পার হওয়া সত্ত্বেও খালাস না নেওয়ায় নিয়মানুযায়ী পণ্য নিলামে তোলা হয়।

নিলামের ক্যাটালগভুক্ত হওয়ায় ১ জুলাই পণ্য কায়িক পরীক্ষা ও ইনভেন্ট্রি করা হয়। কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায়, পলিস্টার ফেব্রিক্সের বদলে আনা হয়েছে পর্দার ও চেনিল কাপড়। আর ২৩ হাজার ৫০০ কেজির পরিবর্তে ২৬ হাজার ৬৪০ কেজি ফেব্রিক্স পাওয়া যায়। জালিয়াত চক্র নিলাম স্থগিত রাখতে আদালতের শরণাপন্ন হয়। পরে আদালতের রায় আমলে নিয়ে ১৫ অক্টোবর ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে চালান খালাসের অনুমতি দেন কমিশনার। আদেশ ইস্যু হয় ১৮ অক্টোবর।

রহস্যজনকভাবে কমিশনারের বিচারাদেশের পরও কাস্টমসের এআইআর শাখা চালানটি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে (কাস্টমসের নিজস্ব সফটওয়্যার) লক করে। পরে ওই আইডি থেকেই ৮ নভেম্বর চালান আনলক করা হয় এবং শুল্ক-কর পরিশোধ না করেই চালানটি বন্দরের গেট দিয়ে নির্বিঘ্নে নিয়ে যাওয়া হয়।

রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পেরে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আয়রন চাকমা বাদী হয়ে গার্মেন্ট মালিক আমীনুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মেহরাজ সুলতানা এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অক্সফোর্ড শিপিং লিমিটেডের মিলন কান্তি আচার্য, একেএম শহীদুল কাউছার, কাজী রিয়াজ উদ্দিন, শাহাবউদ্দিন, মিনহাজ উদ্দিন নিজাম ও এরশাদুল করিম তালুকদারকে আসামি করে কাস্টমস আইনে বন্দর থানায় একটি মামলা করেন।

মিথ্যা তথ্যে আদালতের রায় : নিলাম স্থগিত রাখতে জালিয়াত চক্র ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর আদালতে রিট করে। আদালতে রিটকারী যে এফিডেভিট দেয়, তাতে আমীনুল ইসলামের বাবা ও মায়ের নাম উল্লেখ করা হয় যথাক্রমে ফায়জুল ইসলাম ও মৃত জাহানারা বেগম। এবং যে ভোটার আইডি কার্ড দেওয়া হয়, তার নম্বর হচ্ছে : ২৬৯৫৪৩২৯২৫০১৯।

অথচ আমীনুল ইসলামের বাবার নাম স্মার্টকার্ড অনুযায়ী সিরাজুল ইসলাম ও মায়ের নাম রেজিয়া বেগম। অর্থাৎ, জালিয়াত চক্র অন্য ভোটার আইডি কার্ডে শুধু আমীনুল ইসলামের নাম বসিয়ে আদালতে রিট দায়ের করে।

শুধু তাই নয়, কোম্পানির প্যাড, স্ট্যাম্প ও স্বাক্ষর জাল করা হয়। এফিডেভিটে উল্লেখ করা এনআইডি কার্ডের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকৃত কার্ডধারীর নাম লুৎফর রহমান। পিতা : ফিরোজুর রহমান, মায়ের নাম : জাহানারা বেগম। তিনি কুমিল্লার কালিয়াজুরি মৌলভীপাড়া বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা।

রিটের বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস মতামত দিয়েছেন যে, রিট মোকদ্দমার বাদী জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করে আদেশ হাসিল করেছেন ও কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে আমদানিকৃত মালামাল খালাস করেছেন। আমদানিকারকসহ জড়িত অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

সব কাগজপত্রই জাল : ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির দায়ে আমদানিকারক ওয়াসিফ নিট কম্পোজিটকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে লিখিত জানানো হয়, এ চালান তারা আমদানি করেননি।

অক্সফোর্ড শিপিং লিমিটেড নামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তাদের নয়। এমনকি তাদের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কালকিনি কমার্শিয়াল এজেন্সির কাছে থাকা পাস বইয়ে আমদানি সংক্রান্ত তথ্য নেই। এ ছাড়া লিয়েন ব্যাংক হিসাবে ইসলামী ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা উল্লেখ থাকলেও তাদের লিয়েন ব্যাংক ফার্মগেট শাখা। বিজিএমইএর ইউডিও তাদের নয়।

এ তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে কাস্টমস। গত বছরের ৯ জুলাই কাস্টমস ইসলামী ব্যাংকের ফার্মগেট শাখায় চিঠি দিয়ে আমদানি (আইবিএল/২০১৮/১৩২০, তাং-১৩-০৪-২০১৮) সংক্রান্ত তথ্য এবং বিজিএমইএর কাছে ইউডি সংক্রান্ত তথ্য জানতে চায়।

১২ জুলাই ইসলামী ব্যাংক থেকে জানানো হয়, এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি ফার্মগেট শাখা থেকে ইস্যু করা হয়নি। বিজিএমইএ কাস্টমসে ২৩ আগস্ট চিঠি দিয়ে জানায় ইউডি সঠিক নয়। অর্থাৎ, ব্যাংকের ডকুমেন্ট ও বিজিএমইএর সনদ জাল করে পণ্য আমদানি করা হয়েছে।

নির্বিঘ্নে পণ্য খালাস : কাস্টমসের নিজস্ব গোপনীয় প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আলোচ্য পণ্য চালানটি ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ‘sahommod’ আইডি থেকে ব্লক করা হয়। এ আইডি হচ্ছে তৎকালীন এআইআর শাখার কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমদের। পরবর্তী সময়ে ৮ নভেম্বর দুপুরে চালানটি একই আইডি থেকে আনলক করা হয় এবং ওইদিনই বন্দর থেকে চালানটি বেরিয়ে যায়।

আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, শুল্ক পরিশোধ না করে জালিয়াতির মাধ্যমে চালান গেট দিয়ে বের হওয়ার বিষয়ে কাস্টমস কিছুই জানত না। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কর্মকর্তারা খবর পান কনটেইনার বেরিয়ে গেছে। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করলে ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর রিপোর্ট দিয়ে জানায়, ২০১৮ সালের নভেম্বরে কনটেইনার বন্দর থেকে বেরিয়ে গেছে এবং তা রপ্তানি হয়ে গেছে। যদিও পরে ২০১৯ সালের ৮ মে চালানটি saifulislambhuiyan1962 আইডি থেকে ব্লক করা হয়।

গোপনীয় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ‘sahommod’ আইডি থেকে চালানটি আনলক করা হয়েছে এবং একইদিন বন্দর থেকে গেট ভেরিফাই হয়ে বের হয়ে যায়। কী কারণে চালান আনলক করা হয়, তার সংশ্লিষ্ট কোনো নথির রেফারেন্স ইন্সপেকশন অ্যাক্ট এবং ইনফরমেশন কলামে উল্লেখ করা হয়নি। এ বিষয়ে কর্মকর্তার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া যায়।

ভুক্তভোগীর বক্তব্য : জানতে চাইলে ওয়াসিফ নিট কম্পোজিটের মালিক আমীনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কাস্টমস আমাকে নোটিশ দেওয়ার পর একাধিকবার চালানটি আমি আমদানি করিনি বলে লিখিতভাবে জানিয়েছি এবং এর সপক্ষে সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি।

তারা আমার সব বিষয়ে একাত্মতা প্রকাশ করলেও কেন আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি, তা জানতে চেয়েছে? কিন্তু আদালতে আদৌ আমি গিয়েছি কি না, তা ভেরিফাই করেনি। সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে জালিয়াত চক্র শুধু আমার নাম ব্যবহার করে রায় নিয়ে পণ্য খালাস করে নিয়ে গেছে। কিন্তু কাস্টমস আমার ও আমার স্ত্রীর নামে মামলা করেছে। এ কারণে আমি সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন এবং আর্থিকভাবে দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।

তদন্তকারী কর্মকর্তার বক্তব্য : কাস্টমসের করা মামলার তদন্ত করেন বন্দর থানার এসআই মো. নুরুজ্জামান। তিনি ৩১ অক্টোবর আদালতে চার্জশিট জমা দেন। চার্জশিটে এজাহারে থাকা আসামি মিলন কান্তি আচার্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ না পাওয়ায় এবং তিনি মৃত্যুবরণ করায় মামলার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানান। একইসঙ্গে রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহমেদকে আসামি করে ওয়ারেন্ট জারির আবেদন জানায়।

ওয়াসিফ নিটওয়্যারের মালিক আমীনুল ইসলামের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকিটা আদালতের এখতিয়ার। কে দোষী, কে নির্দোষ সেটা আদালতই নির্ধারণ করবেন। তিনি আরও বলেন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লোকজন পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।

প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে : পুলিশের চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, মামলার এজাহারে নামীয় আসামিদের (সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের ৬ কর্মকর্তা ও গার্মেন্ট মালিক এবং তার স্ত্রী) গ্রেফতারে অভিযান চালানো হয়। আসামিরা আত্মগোপনে থাকায় গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। পুরো ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয় কাস্টমসের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে।

তারা বলেন- প্রকৃত দোষী কে, তা একমাত্র পণ্য খালাসে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট সদস্যরাই বলতে পারবেন। কারণ, তারা মালামাল খালাস করে কাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন বা কে তাদের কাগজপত্র সরবরাহ করেছেন, সেসব বিষয়ে বিস্তারিত তারা জানেন। তাদের আটক করতে পারলে পুরো জালিয়াত চক্রের মুখোশ উন্মোচন করা সম্ভব।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

2 + 15 =

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য