কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারের একই সেলে আটক থাকার সময় নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির জের ধরে সৃষ্ট বিরোধে জেলখানার ভেতর হাজতি সাইদুর মিয়া (৩৬) কাঠ দিয়ে ঘুমন্ত হাজতি আব্দুল হাই (২৭)কে এলোপাতাড়ি মাথায় আঘাত করে খুন করে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয় আরেক হাজতি মো. জাহাঙ্গীর (২৮)। তাকেও হত্যার উদ্দেশে সাইদুর কাঠ দিয়ে এলোপাতাড়ি মাথায় ও চোখের উপর আঘাত করে গুরুতর আহত করে। সাইদুর তার এই কিলিং মিশনে হাজতের বাথরুমের দরজার কাঠ ভেঙে সেটিকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। মঙ্গলবার ভোররাতে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার-১ এ সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় করা এজাহারে এই তথ্য দেয়া হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার-১ এর জেলার নাশির আহমেদ বাদী হয়ে সাইদুর মিয়াকে আসামি করে ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের ৩২৫/৩০৭/৩০২ ধারায় মামলাটি দায়ের করেন। রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলাটি (নং-১৪) রেকর্ড করা হয়। কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মো. আবু বকর সিদ্দিক পিপিএম মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মিজানুর রহমানকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। জেলের ভেতরে হত্যাকাণ্ডের শিকার আব্দুল হাই কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার রশিদাবাদ ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামের ইসরাইল মিয়ার ছেলে। নেশা করে পিতা-মাতাকে মারপিট ও তাদের খুন করতে উদ্যত হওয়ায় পিতা ইসরাইল মিয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ৫ই জানুয়ারি আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করে কিশোরগঞ্জ সদর মডেল থানা পুলিশ। পরদিন ৬ই জানুয়ারি তাকে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৫১ ধারায় আদালতে সোপর্দ করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এরপর থেকে সে হাজতি হিসেবে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে আটক ছিল। এছাড়া আহত মো. জাহাঙ্গীর জেলার নিকলী উপজেলার রুদার পোড্ডা নয়াহাটি গ্রামের শাহজাহানের ছেলে। ২০১৮ সালের ৭ই ডিসেম্বর নিকলী থানায় দায়ের করা একটি মাদক মামলায় সে গ্রেপ্তার হয়ে হাজতি হিসেবে কারাগারে আটক রয়েছে। অন্যদিকে ঘাতক সাইদুর মিয়া জেলার তাড়াইল উপজেলার কালনা মাইজপাড়ার ইসমাইল মিয়ার ছেলে। ২০১৭ সালের ৫ই জুলাই ভৈরব থানায় মুক্তিপণের দাবিতে শিশু অপহরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পরদিন ৬ই জুলাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৭ই জুলাই থেকে কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে হাজতি হিসেবে আটক রয়েছে।
ঘটনা তদন্তে আইজি (প্রিজন) ও জেলা প্রশাসন ৩ সদস্য বিশিষ্ট পৃথক দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আইজি (প্রিজন) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিআইজি (প্রিজন) মো. তৌহিদুল ইসলামকে। কমিটি’র অন্য ২ সদস্য হলেন নেত্রকোনার জেল সুপার আব্দুল কুদ্দুস ও মানিকগঞ্জের জেল সুপার বিকাশ রঞ্জন। অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের তরফ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল্লাহ আল মাসউদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. মিজানুর রহমান ও ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান। দু’টি তদন্ত কমিটিই মঙ্গলবার থেকে কাজ শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, জেলের ভেতরে দুর্ধর্ষ হত্যাকাণ্ডের ঘাতক সাইদুর মিয়া (৪০) ভৈরবের সাদেকপুরে শ্বশুরবাড়ি হওয়ায় কাছাকাছি থাকার উপলক্ষে স্ত্রী মিতু বেগমকে নিয়ে জেলার ভৈরবের ভৈরবপুর উত্তরপাড়া স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকার সেন্টু মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতো। প্রায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ওই বাড়িতে ভাড়া থাকায় দুই পরিবারের মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ২০১৭ সালের ৫ই জুলাই সকালে বাড়ির মালিকের শিশুকন্যা হালিমাকে কাপড় কিনে দেয়ার কথা বলে সাইদুর দম্পতি বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। পরে মোবাইলে শিশুটির বাবার কাছে তারা ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। অন্যথায় শিশুটিকে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেয়। বিষয়টি জানিয়ে ওইদিন রাতেই শিশুটির বাবা সেন্টু মিয়া ভৈরব থানায় অপহরণ মামলা করেন। পুলিশ মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অপহরণের ২৩ ঘণ্টা পর ৬ই জুলাই দুপুরে অপহৃত হালিমাকে তাড়াইল উপজেলার কালনার হাওর এলাকার পাটক্ষেত থেকে উদ্ধার করে। এ সময় অপহরণকারী সাইদুর ও তার স্ত্রী মিতু বেগমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরদিন ৭ই জুলাই তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। এদিকে কারাগারে থাকার সময়ে পূর্বেও আলোচনার জন্ম দিয়েছে সাইদুর। কিশোরগঞ্জ শহরের গাইটাল বটতলা এলাকার পুরাতন কারাগার থেকে নবনির্মিত কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার-১ এ ২০১৯ সালের ১২ই জানুয়ারি বন্দি স্থানান্তর করা হয়। তখন এক হাজার ৩৮৪ জন বন্দি স্থানান্তরের এ প্রক্রিয়ার সময় সব বন্দিকে স্থানান্তর করা হলেও সাইদুরকে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাথরুমের ট্যাঙ্কিতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় এবং সর্বশেষ বন্দি হিসেবে নবনির্মিত কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগার-১ এ স্থানান্তর করা হয়।