গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার দুজন পুলিশ সদস্যের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্যরা ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছিলেন। দুই পুলিশ সদস্য ডাকাতির কাজে সরকারি পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, গাড়ি ব্যবহার করতেন। ডিবি পরিচয়ে ডাকাতির মাধ্যমে সাড়ে ৯ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ওই দুই পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
ওই দুই এএসআই হলেন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার থানার মাসুম শেখ (৩৩) ও গেন্ডারিয়ার আরআরএফ মিলব্যারাকের শহীদ শেখ (৫৫)। মাসুমের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর এবং শহীদের বাড়ি ফরিদপুরের নগরকান্দায়। দুজনই এখন কারাগারে। ২২ ডিসেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে জমা দেওয়া ডিবির লালবাগ বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির লালবাগ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এএসআই শহীদ শেখ ও মাসুম শেখ দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছিলেন। তাঁদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ একটি অপরাধীচক্র ঢাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে অপরাধ করে আসছিল। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণপত্র হাতে পাওয়ার পর শহীদ ও মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ডাকাতির কাজে ব্যবহার করা পিস্তল, হ্যান্ডকাফ ও একটি প্রাইভেট কার।
দুই পুলিশ সদস্যের ডাকাতি
মামলার নথিপত্রের তথ্য বলছে, আবদুল আওয়াল নামের এক ব্যক্তি রামপুরার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি রামপুরার টিভি সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন কথিত বাবু নামের এক ব্যক্তি মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালের কাছে এসে বলেন, পেশায় তিনি রিকশাচালক। তিনি লেখাপড়া জানেন না। ১০০ রিয়াল ভাঙানোর জন্য তিনি সাহায্য চান। কথোপকথনের একপর্যায়ে আওয়াল ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চান, রিয়াল কোথায় পেয়েছেন? জবাবে বাবু জানান, তাঁর পরিচিত একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ওই রিয়াল রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছেন। কথিত রিকশাচালক বাবুর কথায় বিশ্বাস করে রিয়াল ভাঙিয়ে দেন আওয়াল। পরে কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হায়দারকে আওয়ালের কাছে হাজির করেন বাবু। মোট ১ হাজার ৮৬০ রিয়াল ভাঙানোর জন্য মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালকে অনুরোধ করেন কথিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হায়দার। রিয়ালগুলো ভাঙিয়ে দিলে অর্ধেক টাকা আওয়ালকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন বাবু ও হায়দার। তাঁদের রিয়ালগুলো বুঝিয়ে নেওয়ার জন্য আওয়ালকে রামপুরার লেহাজ হোটেলের সামনে আসতে বলেন বাবু ও হায়দার। প্রলোভনে পড়া মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়াল রিয়ালগুলো নেওয়ার জন্য নিজের ব্যাংক হিসাব থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে আসেন লোহাজ হোটেলের সামনে। আওয়াল পাঁচ লাখ টাকা বাবু ও হায়দারকে বুঝিয়ে দেন। তখন বাবু ও হায়দার আওয়ালের হাতে প্যাকেটভর্তি কথিত রিয়াল তুলে দেন।
তখন সেখানে একটি প্রাইভেট কার এসে থামে। প্রাইভেট কার থেকে নেমে তিনজন ব্যক্তি আওয়ালের কাছে আসেন এবং নিজেদের ডিবি পুলিশের পরিচয় দেন।
আওয়ালকে জোর করে প্রাইভেট কারে তুলে হ্যান্ডকাফ পরান কথিত ডিবি পুলিশের সদস্যরা। রিয়ালগুলো কার কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন, কাগজপত্র কোথায় ইত্যাদি নানা কথা জানতে চায় ডিবি পরিচয় দেওয়া তিন ব্যক্তি। আওয়ালকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর কথা জানান তাঁরা। আওয়ালকে অবৈধ ব্যবসায়ী হিসেবে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরার হুমকি দেওয়া হয়। তবে ১০ লাখ টাকা দিলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। তাঁর ব্যাংক হিসাবে যত টাকা আছে, তা দেবেন বলে জানান আওয়াল। আওয়ালের ব্যাংক হিসাব থেকে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা তুলে নেয় কথিত ডিবি পুলিশের দল।
ঢাকা মহানগর ডিবির লালবাগ বিভাগের তদন্তে উঠে আসে, মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালের কাছে প্রথমে যিনি রিকশাচালকের পরিচয় দিয়ে রিয়াল ভাঙানোর ফাঁদ পেতেছিলেন, আসলে তিনি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য। তাঁর প্রকৃত নাম আনিছুর রহমান। আর হায়দার পরিচয় দেওয়া কথিত পরিচ্ছনতাকর্মী হলেন প্রতারক চক্রের আরেক সদস্য শওকত। ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে আওয়ালের কাছ থেকে যাঁরা টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা ডিবি সদস্য নন। প্রকৃতপক্ষে পুলিশ সদস্য এএসআই শহীদ শেখ ও মাসুম শেখ আওয়ালের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মো. রাজীব আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, আসামি এএসআই শহীদ ও মাসুম শেখ বহু দিন ধরে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে ডাকাতি করে আসছিলেন। সংঘবদ্ধ একটি অপরাধী চক্র ডিবি পরিচয় দিয়ে অপরাধ করে আসছিল। সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডিবির পরিদর্শক আলমগীর হোসেন পাটোয়ারী আদালতকে প্রতিবেদন দিয়ে জানান, শহীদ শেখ পুলিশের এএসআই হয়েও ডিবি পুলিশের মিথ্যা পরিচয়ে মাদ্রাসাশিক্ষক আওয়ালকে গাড়িতে ওঠান এবং কৌশলে তাঁর কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেন। শহীদ শেখের সহযোগী হলেন আরেক পুলিশ সদস্য এএসআই মাসুম শেখ। পুলিশ সদস্য শহীদ শেখ ও মাসুম শেখ তাঁর দলবদলসহ ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতি করে আসছেন। আসামিদের দেওয়া তথ্য, প্রযুক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা এবং সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামিরা সংঘবদ্ধ প্রতারক ও ডিবি পুলিশ পরিচয় দেওয়া ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য।
মামলার এজাহার ও পুলিশ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এই দুই পুলিশ সদস্যের বাইরে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের অন্যতম সদস্য হলেন মহসিন শেখ। তাঁর নামে ছয়টি মামলা আছে। এর মধ্যে চারটি মামলা প্রতারণার। প্রতারক চক্রের অপর সদস্য হলেন আনিছুর রহমান। দুজনই ঢাকার সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে পুলিশ সদস্য শহীদ ও মাসুম শেখের নাম উল্লেখ করেছেন। ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের ছয় সদস্যের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে।
ডিবি কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার ফজলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে এএসআই শহীদ, মাসুম শেখসহ চক্রের সদস্যরা অনেকগুলো ডাকাতি করেছেন। ডিবি পুলিশের পরিচয়ে এই অপরাধী চক্রের সদস্যরা এমনভাবে ডাকাতি করত যে ভুক্তভোগীদের বোঝার উপায় থাকত না, তাঁরা আসলে ভুয়া ডিবি। কারণ, পিস্তল, হ্যান্ডকাফ সবই পুলিশের।