তিস্তা নদী তিস্তাপারের মানুষের জীবনের সঙ্গে যেন গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আমারও শৈশব, কৈশোর, যৌবন—সবই তিস্তার ঢেউ, তিস্তার চর আর ভাঙনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে। বছরের বেশির ভাগ সময় আমরা দেখি তিস্তার চর, যখন নদীটি পরিণত হয় এক সংকীর্ণ নালায় এবং চারপাশে তৈরি হয় মরুভূমির মতো শুকনা চরের বিস্তৃতি। তবে বাকি সময়টি আমরা আতঙ্কে থাকি, তিস্তার ভাঙন যে কখন আমাদের ঘরবাড়ি, ফসল আর জীবনকে গ্রাস করবে! বাংলাদেশ অংশে তিস্তা একটি খরস্রোতা নদীর পানিসংকট এবং ভাঙনের প্রকোপে খুব কম সময়ই তিস্তা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে।
নদীটি বছরের একটি অংশে তীব্র স্রোতে ভেসে যায়, আর অন্য সময়ে শীর্ণ ধারায় রূপান্তরিত হয়। তাই তিস্তাপারের মানুষের জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা কেবল একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা নয়, এটি তাদের টিকে থাকার লড়াইয়ের এক প্রতীক। তিস্তার প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং এর দ্বারা সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে এই মহাপরিকল্পনা আজ প্রজন্মের পর প্রজন্মের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা চারটি মূল উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত, যা তিস্তাপারের মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে ধারণ করে।
প্রথমত, বন্যা পরিস্থিতি প্রশমনের জন্য তিস্তার পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, যা বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করবে। দ্বিতীয়ত, ভাঙন হ্রাসের মাধ্যমে বসতবাড়ি ও কৃষিজমি রক্ষা করা। তৃতীয়ত, তিস্তার ভাঙনে বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করে পুনরায় চাষযোগ্য করা, যা কৃষকদের আর্থিক স্থিতি দেবে। চতুর্থত, নদীকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, যা মানুষের জীবনমান ও দেশের প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
তিস্তাপারের মানুষের প্রধান দুঃখ হলো তিস্তার ভাঙন, যা দীর্ঘদিন ধরে সুনির্দিষ্ট মহাপরিকল্পনার অভাবে বেড়েছে। এই ভাঙন বসতবাড়ি, কৃষিজমি ও অবকাঠামোর ক্ষতির পাশাপাশি জনজীবনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তিস্তার সমস্যা অনেকটাই চীনের এককালের ‘দুঃখ’ হোয়াংহো নদীর সঙ্গে তুলনীয়। চীন সরকার পরিকল্পিত ড্রেজিং ও নদীশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করে হোয়াংহোকে কৃষকদের জন্য এক আশীর্বাদে পরিণত করেছে। তিস্তায়ও একইভাবে মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন অত্যন্ত প্রয়োজন, যা কেবল ভাঙন ও বন্যা থেকে সুরক্ষা দেবে না, বরং কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ এবং পর্যটনের মতো শিল্প খাতে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।
তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্ত সীমান্ত নদী। নদীটির পানি ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতভেদ সৃষ্টি করে আসছে। ১৯৮৩ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি হলেও এর সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নির্ধারিত না হওয়ায় সমস্যার সমাধান হয়নি। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ পানির ৮০ শতাংশ সমানভাবে ভাগ করার প্রস্তাব দিলেও ভারত এতে সম্মতি জানায়নি। ভারত উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি, যা সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলেছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফাভাবে তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করছে, যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি পুরোপুরি শুকিয়ে যাচ্ছে। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামের জনপদ আর রংপুরের গঙ্গাচড়া—সবাই তিস্তার কোল ঘেঁষে বসে আছে, তবে গঙ্গাচড়ার মানুষ সবচেয়ে বেশি শুষ্কতার ও ভাঙনের বেদনা বয়ে বেড়ায়। এই উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সাতটিই তিস্তা নদী বেষ্টিত। নদীর শাসন নেই, তাই পাঁচ বছর ধরে তিস্তা পাল্টাচ্ছে তার গতিপথ, সরে যাচ্ছে দূরে, ফেলে যাচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে গত ৪১ বছরে মূল প্রবাহের তিন-চার কিলোমিটার দূরে সরে গেছে তিস্তা। ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে বন্যা, ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি আর ঘর হারানো মানুষের সংখ্যা।
২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের পর যে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে, সেখানে এই উত্তর জনপদের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জুলাই বিপ্লবের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের স্মৃতিবিজড়িত উত্তরাঞ্চলের মানুষ তিস্তা নদীকে একটি আশীর্বাদ হিসেবে দেখতে চায়। তারা ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে স্বাক্ষরিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বিষয়ক সমঝোতা স্মারকের বাস্তবায়ন কামনা করে। সেই মহাপরিকল্পনার অধীনে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মডেলে তিস্তার দুই তীরে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশ সরকারও চীনের প্রস্তাবিত সেই মহাপরিকল্পনার আলোকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিল। চীনের প্রস্তাবিত এই ‘তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্য পুরোপুরি বদলে যাবে। এই প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে ভারত থেকে আর অতিরিক্ত পানি আনতে হবে না বাংলাদেশকে। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। ফলে বন্যার পানি আর গ্রামাঞ্চলকে প্লাবিত করবে না। সারা বছর ধরে নৌ চলাচলের মতো পর্যাপ্ত পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা যাবে। এই প্রকল্পের আওতায় ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন এবং নদীর দুই তীরে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ ছাড়া বালু অপসারণ করে কৃষিজমি পুনরুদ্ধার করা এবং এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ সংরক্ষণ করা যাবে, সঙ্গে প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদিত হবে। নৌবন্দর স্থাপন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে দুই তীরে থানা, কোস্ট গার্ড ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপনের পরিকল্পনাও ছিল। এই প্রকল্পে সাত থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ ছিল। পাশাপাশি ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামে একটি প্রকল্পও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২০২০ সালের আগস্টে তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে আট হাজার ২১০ কোটি টাকার পিডিপিপি (প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে জমা দেওয়া হয়। এরপর ২০২৩ সালের ৫ মার্চ চীন সরকার পিডিপিপি সম্পর্কে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রেরণ করে এবং কিছু সমীক্ষার পরামর্শ দেয়। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবটি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে। অবশেষে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে চীন তাদের আগ্রহের কথা পুনরায় জানায়। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন তখন বলেছিলেন, চীন তিস্তা প্রকল্প শুরু হওয়া নিয়ে আশাবাদী। এরপর এপ্রিল মাসে চীনের রাষ্ট্রদূত জানান, বাংলাদেশ চাইলে চীন প্রকল্পটি শুরু করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
কিন্তু তিস্তা মহাপরিকল্পনার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে ভারত এই প্রকল্প নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু সামনে আনে। ভারতীয় গবেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-কৌশলগত দিক বিবেচনা করে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে চীনের বাড়তি আগ্রহ রয়েছে। তবে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে চীনের ভূ-রাজনৈতিক কোনো স্বার্থ জড়িত ছিল না; এটি ছিল শুধুই বাংলাদেশের প্রকল্প। চীন কেবল অর্থায়ন করতে চেয়েছিল।
তবে জুলাই বিপ্লব-পূর্ববর্তী সরকার ভারতের প্রতি একটু বেশি দায়িত্ববদ্ধ ছিল। কারণ ভারত বিগত দুটি বিতর্কিত নির্বাচনকে দ্রুত বৈধতা দিয়েছিল। ফলে সেই সরকার ভারতের অযৌক্তিক দাবিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনাকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। এর ফলে উত্তরবঙ্গের আবু সাঈদের স্মৃতিবিজড়িত জনপদে অন্ধকার নেমে আসে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন উত্তরের মানুষের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর অবহেলিত এই জনপদের মানুষ এখন নতুন করে আশার আলো দেখছে। বিপ্লবের পর যে পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, তা যেন তিস্তা নদীর প্রতিটি ঢেউয়ে প্রতিফলিত হয়। আবু সাঈদের আত্মত্যাগ স্মরণ করিয়ে দেয় যে এই প্রকল্প শুধু উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি মুক্তির আহবান। তিস্তার মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মানুষ বাঁচার নতুন সুযোগ পাবে, তিস্তা হয়ে উঠবে তাদের সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লেখক : ছাত্র উপদেষ্টা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর