পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসে চমকের পর চমক দিয়ে দলবদল শুরু হয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে বাংলার রাজনীতিতে প্রতিদিনই বহু নাটকীয় মুহূর্ত এবং ঘাত-প্রতিঘাত তৈরি হচ্ছে।
কিন্তু সোমবার দুপুরে সৌমিত্র-সুজাতার কাহিনী সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। সুন্দরী স্ত্রী দলত্যাগ করায় ডিভোর্সের ঘোষণা দিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি যুবমোর্চার সভাপতি ও সংসদ সদস্য সৌমিত্র খাঁ। এদিকে সোমবার ১০ বিধায়ক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন ও সেচমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।
স্ত্রী সুজাতা বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেয়ার খবর পেয়ে ঘণ্টাখানেক নীরবে ছিলেন বিজেপি সংসদ সদস্য ও রাজ্য যুবমোর্চার সভাপতি সৌমিত্র খাঁ। সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠকে কেঁদে ভাসালেন তিনি। বিবাহ বিচ্ছেদের নোটিশ পাঠানোর ঘোষণা করেও সুজাতাকে তিনি প্রশ্ন করেন, আমি কি খুব পাপী?
রাজনীতির জন্য ভালোবাসাকে বিসর্জন দেয়ার অভিযোগ তুলে কান্নাভেজা গলায় তিনি বলেন, ‘সুজাতা, খুব ভুল করলে। আর তুমি পদবিতে খাঁ লিখো না। শুধু মণ্ডল লিখো।’ এদিকে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেয়া স্ত্রী সুজাতা খাঁ ডিভোর্সের নোটিশ পেয়ে বলেছেন, বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও ওর (সৌমিত্র) সিঁদুরই সিঁথিতে পরব। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্বর্গে তৈরি হয়। সেই সম্পর্ক কি মর্ত্যরে কোনো রাজনৈতিক দল ভেঙে দিতে পারে?’
স্বামী এক দলে স্ত্রী অন্য দলে, এমন নজির রাজনীতিতে কম নেই। দলবদলের সময় এমন অনেক ঘটনা অতীতেও দেখা গেছে। কিন্তু তার জন্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘বিবাহ বিচ্ছেদ’র নোটিশ পাঠানো সত্যিই বেনজির। একই সঙ্গে নাটকীয়ও। বঙ্গের রাজনীতি শোভন চট্টোপাধ্যায়-বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়-রত্না চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কের ত্রিকোণ দেখেছে। ফলে ‘রাজনীতির রিয়েল লাইফ সোপ অপেরা’র খামতি ছিল না। সে সময়ও ক্ষেত্রে বিশেষে শোভনকে ছলোছলো চোখে দেখা গেছে। কিন্তু সৌমিত্রর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ার ‘লাইভ’ দৃশ্য বাঙালি এর আগে দেখেনি। সঙ্গে বাছা বাছা আবেগপ্রবণ মন্তব্য। যা সাধারণত চার দেয়ালের ঘেরাটোপে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হয়ে থাকে।
মেদিনীপুরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতে তৃণমূল কংগ্রেসে বড় মাপের ধস নামিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পর তৃণমূলে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা পরিবহন ও সেচমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। ১০ বিধায়ক নিয়ে তিনি সোমবার বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। তার সঙ্গে রয়েছেন একজন বর্তমান ও দু’জন সাবেক সংসদ সদস্য, বেশ কয়েকজন সাবেক বিধায়ক এবং এক সাবেক মন্ত্রীও। বিধানসভার স্পিকার বিমান ব্যানার্জির হাতে শুভেন্দু ইস্তফা দিয়েছেন। এর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিজেপির যুবমোর্চার সভাপতি সৌমিত্রের স্ত্রী সুজাতা তৃণমূলে যোগ দেন। লোকসভা নির্বাচনে সৌমিত্রকে এই সুজাতাই জিতিয়েছিলেন।
বিজেপিতে যোগ দিয়ে মেদিনীপুরের জনসভায় প্রথম বক্তৃতায় শুভেন্দু তৃণমূলকে আক্রমণ করেন। তিনি বলেন, লোকসভা ভোটে পুরনো দলের কর্মী হিসেবে বলেছিলাম, ‘বিজেপি হটাও, দেশ বাঁচাও।’ আর কাল থেকে বলব, ‘তোলাবাজ ভাইপো হঠাও, বাংলা বাঁচাও।’ বিজেপিতে যোগ দেয়ার জন্য তাকে বিশ্বাসঘাতক বলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে পাল্টা অভিযোগ করেন শুভেন্দু। নাম না করে মমতাকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, আমি নাকি মায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। আমার মা গায়েত্রী অধিকারী। এরপর মা হলেন দেশমাতৃকা, অন্য কেউ আমার মা নয়।
উন্নয়নের স্বার্থে নরেন্দ্র মোদির হাতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে দেয়ার ডাক দিয়েছেন মমতার দলের এক সময়ের দুরন্ত ‘স্ট্রাইকার’ শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপিতে যোগ দেয়ায় পুরনো গেরুয়া কর্মীরা যাতে বিব্রত না হন তা আশ্বস্ত করে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন শুভেন্দু। তিনি বলেন, আপনাদের আশ্বস্ত করছি, শুভেন্দু কোথাও মাতব্বরি করবে না, কর্মী হিসেবেই কাজ করবে। পতাকা লাগাতে বললে লাগাবে, দেয়ালও লিখবে। পার্টি যা নির্দেশ দেবে, তাই করব। আমি ক্ষমতার জন্য বিজেপিতে আসিনি। ছাত্র রাজনীতি করে সিঁড়ি ভেঙে এখানে এসেছি। সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে মনে করি।
শুভেন্দু বলেন, ২০১৪ সালে দিল্লিতে অমিত শাহের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়। অমিতের সঙ্গে তার ‘দাদা ও ভাইয়ের সম্পর্ক’। তিনি বলেন, যখন আমি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম তখন আমার ২২ বছরের পার্টির কেউ খবর নেয়নি। কিন্তু দু’বার অমিতজি ফোনে খোঁজ নেন।
বিজেপিতে যোগ দেয়ার আগে রাজ্যবাসীকে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন শুভেন্দু। সেখানে লিখেছেন যে, তৃণমূলের জন্য আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি। সেই তৃণমূলের মধ্যে পচন ধরতে শুরু করেছে। যেসব মানুষ এ দলকে তৈরি করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আজ তারাই ব্রাত্য, অপমানিত। জনগণ দ্বারা নির্বাচিত দলই আজ সেই জনগণের রায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে যুগান্তরকে শুভেন্দু বলেন, আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি দিল্লি ও কলকাতায় একই দলের সরকার থাকা উচিত। তিনি বলেন, বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির হাতে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে না দিলে রাজ্যের আরও সর্বনাশ হবে। বিজেপিতে শুভেন্দুকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর প্রমাণ-রীতি ভেঙে দিলীপ ঘোষের পর এবং অমিত শাহের ঠিক আগে তাকে সভায় বক্তব্য রাখতে দেয়া হয়। যোগ দেয়ার কিছুক্ষণ পর শুভেন্দুকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হেলিকপ্টারে চাপিয়ে কলকাতায় কোর কমিটির বৈঠকে নিয়ে যান অমিত শাহ। সভায় অমিত শাহ বলেন, মমতাদি এভাবে সবাই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবেন। নির্বাচনের দিন আপনি একা হয়ে যাবেন। আপনি আর আপনার ভাইপো শুধু থাকবেন। বিজেপি নেতাদের মমতা বহিরাগত বলে আক্রমণ করায় বোলপুরে অমিত শাহ বলেন, বাইরের কাউকে লাগবে না। বাংলার বিজেপি নেতারাই আপনাকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন। আর মুখ্যমন্ত্রী হবেন বাংলারই ভূমিপুত্র।