প্রতিবছর সাধারণত জুলাই-আগস্ট থেকে পাঠ্য বই ছাপার কাজ পুরোদমে শুরু হয়। এর পরও ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হয় না। এবার অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় চলে এলেও একটি বই ছাপার কাজও শুরু হয়নি। যেভাবে কাজ এগোচ্ছে তাতে আগামী নভেম্বরের আগে বই ছাপার কাজ শুরু করা সম্ভব নয়।
ফলে আগামী দুই মাসে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য সাড়ে ৩৭ কোটি পাঠ্য বই ছাপার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে (এনসিটিবি)। কিন্তু মুদ্রাকররা বলছেন, আগে জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে দরপত্র শুরু হতো। বই ছাপতে কমপক্ষে ৭২ দিন সময় দেওয়া হতো। আর একটি কাজ শেষ করে মুদ্রাকররা আরেকটি কাজ ধরতে পারতেন।
কিন্তু এবার সব কাজ একসঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। আর সময় কমিয়ে মাত্র ৪৫ দিন করা হচ্ছে। ফলে এই সময়ের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া দুঃসাধ্য। এ ছাড়া এনসিটিবির কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্তহীনতাই ভুগছেন।সব প্রক্রিয়া শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরও প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ এখনো দিতে পারেননি।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সিনিয়র সহসভাপতি জুনায়েদুল্লাহ আল মাহফুজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেই কাজটা আমরা পাঁচ মাসে শেষ করি, সেটা ৪৫ দিনে কিভাবে সম্ভব? তবে যদি পর্যাপ্ত কাগজের সরবরাহ পাওয়া যায়, তাহলে কাজ অনেকখানি এগিয়ে যাবে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এর পরও স্বাভাবিক হিসেবে যদি বলি, ৪৫ দিনে গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ পাঠ্য বই ছাপার কাজ শেষ হতে পারে।’
এনসিটিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে মোট ৩৭ কোটি ৬৪ লাখ পাঠ্য বই ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এর মধ্যে প্রাথমিকের বই ৯ কোটি ২১ লাখ। আর মাধ্যমিকের ২৮ কোটির কিছু বেশি। যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বই ছাপানো হবে এক লাখ ৯২ হাজার ৮২৫টি। মাদরাসার দাখিল পর্যায়ে তিন কোটি ৩৬ লাখ আর দাখিল ভোকেশনালে এক কোটি ৯২ লাখ।
এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, আগামী বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যার খুব একটা পরিবর্তন না হলেও বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আগে বই ছিল ১৪টি করে। পুরনো শিক্ষাক্রমে ফেরত যাওয়ায় আগামী বছর এসব শ্রেণির ২২টি করে বই ছাপাতে হবে। কৃষি শিক্ষা, গার্হস্থ্য অর্থনীতি, শারীরিক শিক্ষাসহ বেশ কয়েকটি বই এবার নতুন করে যাবে। আবার যেহেতু বিভাগ বিভাজন ফিরছে, সে কারণে দশম শ্রেণিতে নতুন বই দিতে হবে। ফলে নবম-দশম শ্রেণির জন্য ৩৩টির মতো বই ছাপাতে হবে। এতে সব মিলিয়ে আগামী শিক্ষাবর্ষে আড়াই কোটির মতো বই বেড়ে গেছে।
সূত্র জানায়, গত জুন মাসে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের দরপত্র আহবান করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব কিছু পরিবর্তন হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর নতুন শিক্ষাক্রম থেকে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে সেই প্রক্রিয়া আটকে থাকে। এসব বইতে সামান্য পরিমার্জন শেষে এ সপ্তাহেই কার্যাদেশ দেওয়া হতে পারে। আর চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি পুরনো শিক্ষাক্রমে চলছিল। ফলে তাদের বইতে সামান্য পরিমার্জন লাগবে, যা শেষ হয়েছে। এই দুই শ্রেণির বই ছাপতে দরপত্র প্রক্রিয়া গত সপ্তাহে শেষ হয়েছে। এখন কার্যাদেশ দেওয়ার অপেক্ষা। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। কারণ এসব শ্রেণির বইতে বড় ধরনের পরিমার্জনের প্রয়োজন পড়ছে, যা এখনো শেষ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এসব শ্রেণির বই ছাপার জন্য দরপত্র আহবানও করা হয়নি।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ. কে. এম রিয়াজুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রাথমিকের টেন্ডার হয়ে গেছে। এ সপ্তাহেই প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির কার্যাদেশ দিয়ে দেব। আমরা দ্রুতই মাধ্যমিকের টেন্ডারে চলে যাব। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হতে হতে আমরা পাণ্ডুলিপিও হাতে পেয়ে যাব। যদি মুদ্রাকররা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন, তাহলে আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই সব বইয়ের কাজ শেষ করতে পারব। করোনার মধ্যে তাঁরা কিন্তু দ্রুত সময়ে বই ছেপে দেখিয়েছেন। কাগজের স্বল্পতা না থাকলে এবারও তেমন সমস্যা হবে না বলে আমার মনে হয়।’
নাম প্রকাশ না করে একজন মুদ্রাকর বলেছেন, ‘এ সপ্তাহে প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হলেও কাজ ওঠানো কষ্টকর হয়ে যাবে। কারণ আমরা জুলাই মাসের কাগজের দর হিসাব করে বইয়ের দরপত্র জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন কাগজের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় আগের রেটে কাজ করলে লসে পড়তে হবে। এবার ৮৫ ব্রাইটনেস ও ৮০ জিএসএমের কাগজে বই ছাপতে হবে। আগে মানে কিছুটা ছাড় পাওয়া গেলেও এবার তা সম্ভব নয়। ফলে এসব বিষয়েও এনসিটিবিকে চিন্তা করতে হবে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী যেকোনো দরপত্রের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময়সীমা কমিয়ে আনলেও মাধ্যমিকের দরপত্র আহবান শেষে তা জমা হতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। এরপর কার্যাদেশ শেষে নিয়মানুযায়ী আরো ২৮ দিন সময় দেওয়ার কথা। কারণ যে মুদ্রাকর কাজ পাবেন তিনি পারফরম্যান্স গ্যারান্টি (পিজি), ব্যাংক ঋণ, কাগজের সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ার পরই এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তি করবেন। তাই কোনোভাবেই মাধ্যমিকের কাজ নভেম্বরের শেষ দিক ছাড়া শুরু করা সম্ভব নয়। এরপর আবার ৭২ দিনের কাজ ৪৫ দিনের মধ্যে করতে হবে। ফলে সব কিছু মিলিয়ে একটি বড় জটিলতায় পড়তে হবে।
তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বইয়ের কাজ শেষ করতে গত সপ্তাহে এনসিটিবিতে এক সভা হয়। সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবির কর্মকর্তারা, পেপার মিল মালিক ও প্রেস মালিকরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সভায় বইয়ের মান ঠিক রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা সরকারের থেকে দেওয়া হবে বলেও সভা সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, মূলত গত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে পাঠ্য বই পরিমার্জনের কাজ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ জন্য একটি গ্রুপ ঠিক করে দেওয়া হয়। তবে পরিমার্জনের দায় নিয়ে প্রশ্ন যাতে না ওঠে সে জন্য একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তা বাতিল করা হয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সেই গ্রুপ ঠিকই পরিমার্জনের কাজ চালিয়ে যায়। কিন্তু এত বিষয়ের বই পরিমার্জনে যত তাড়াতাড়িই করা হোক না কেন, সময়ের প্রয়োজন। এ মাসের মধ্যে তাঁরা পাঠ্য বই সংশোধন ও পরিমার্জনের কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন।
এদিকে গত ৮ আগস্ট একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হলেও এখনো এনসিটিবির পাঠ্য বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। মূলত এইচএসসির বাংলা, ইংরেজি, সহপাঠ ও তথ্য-প্রযুক্তি বইটি রয়ালিটির মাধ্যমে ছাপিয়ে দেন মুদ্রাকররা। কিন্তু এই বইগুলো পরিমার্জনের কাজ শেষ না হওয়ায় দরপত্র শেষে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এনসিটিবিকে প্রস্তাব দিয়েছি বাংলা, ইংরেজি, গণিতের মতো বইগুলো আগে দিতে। এরপর অন্য বইগুলো সরবরাহ করতে। কারণ এবার চাপ পড়বে একসঙ্গে। আর ৭২ দিনের সময় হচ্ছে ৪৫ দিন। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই দিতে চাইলে কেউ পারবে না। আমার মনে হয়, বর্তমানে এনসিটিবির কর্মকর্তারা আন্তরিক। তবে তাঁদের আগের মতো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এখন নিজেরা সিদ্ধান্ত নিলে তা ফেল করবে। সবাইকে সম্মিলিতভাবে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।’