মহান আল্লাহ মানুষকে জ্ঞানহীন অবস্থায় মায়ের পেট থেকে বের করেছেন (নাহল ১৬/৭৮)। অতঃপর তাকে অল্প ইল্ম দান করা হয়েছে’ (ইসরা ১৭/৮৫)। মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইলমের গুরুত্ব অপরিসীম। দুনিয়াতে অনেক ইলম রয়েছে, যা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে দ্বীনি ইলম তথা মানুষের স্রষ্টা, সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও শেষ পরিণাম সম্পর্কে সকল মানুষের জানা আবশ্যক। এজন্য আল্লাহ রাববুল আলামীন দ্বীনী ইলম অর্জনকে ফরয করেছেন। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি প্রথম অহী ছিল ‘পড়’। আলোচ্য প্রবন্ধে দ্বীনী ইলমের গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।
ইলমের পরিচয় :
‘ইলম’ (علم) কুরআন ও হাদীছে ব্যবহৃত একটি আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ হ’ল জ্ঞান, বিদ্যা, বিজ্ঞান, শাস্ত্র ইত্যাদি।[1] যেমন আল্লাহ বলেন, وَفَوْقَ كُلِّ ذِي عِلْمٍ عَلِيمٌ ‘বস্ত্তত প্রত্যেক জ্ঞানীর উপরে জ্ঞানী থাকেন’ (ইউসুফ ১২/৭৬)। পরিভাষায় বলা হয়, هو حصول صورة الشئ فى العقل ‘আক্বলের মধ্যে কোন বস্ত্তর আকৃতি অর্জিত হওয়া’।[2]
ইল্মের গুরুত্ব ও ফযীলত :
ইলমেরর গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। নিমেণ এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল।-
(১) মহান আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি কলম : কলম ইল্মের অর্জনের মাধ্যম। আল্লাহ প্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। ওবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللهُ الْقَلَمَ فَقَالَ اكْتُبْ. فَقَالَ مَا أَكْتُبُ قَالَ اكْتُبِ الْقَدَرَ مَا كَانَ وَمَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الأَبَدِ، ‘আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে আদেশ করেন, ‘লিখ’। কলম বলল, কি লিখব? তিনি বললেন, তাক্বদীর লিখ, যা হয়েছে এবং অনন্তকাল পর্যন্ত যা হবে সবকিছুই’।[3] সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টির কারণে ইলমের গুরুত্ব ও ফযীলত প্রমাণিত হয়। আর এই লেখনির মাধ্যমেই যুগ যুগ ধরে ইলম সংরক্ষিত হয়ে আসছে। কুরআন নাযিল হওয়ার পর ছাহাবীগণ সাথে সাথে কুরআন লিখে নিয়েছেন। এছাড়াও কুরআনুল কারীমের ২৯তম পারায় ৬৮তম সূরা হ’ল ‘সূরা ক্বলম’। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তারা বলেছেন, قيّدوا العلم بالكتابة ‘তোমরা ইলমকে লেখনীর দ্বারা বন্দী করে ফেল’।[4]
লিখে রাখার কারণে আমরা হাদীছ পেয়েছি। আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) ব্যতীত আর কারো নিকট আমার চেয়ে অধিক হাদীছ নেই। কারণ তিনি লিখে রাখতেন আর আমি লিখতাম না।[5] আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, অতঃপর ইয়ামানবাসী জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, اكْتُبْ لِي يَا رَسُولَ اللهِ. فَقَالَ اكْتُبُوا لأَبِي فُلاَنٍ، ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! (এ কথাগুলো) আমাকে লিখে দিন। তিনি (ছাহাবীদের) বললেন, তোমরা অমুকের পিতাকে লিখে দাও’।[6]
(২) ইলমের কারণে আদম (আঃ)-কে ফেরেশতাদের উপরে মর্যাদা দেওয়া হয় : আল্লাহ তা‘আলা আদমকে সৃষ্টি করে তার সম্মানার্থে ফেরেশতাদেরকে সিজদা করার আদেশ করলে ফেরেশতাগণ সিজদা করেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করে ইল্ম শিক্ষা দিলেন এবং ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ، قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيْمُ- ‘অতঃপর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিলেন। অতঃপর সেগুলিকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এগুলির নাম বল, যদি তোমরা (তোমাদের কথায়) সত্যবাদী হও। তারা বলল, সকল পবিত্রতা আপনার জন্য। আমাদের কোন জ্ঞান নেই, যতটুকু আপনি আমাদের শিখিয়েছেন ততটুকু ব্যতীত। নিশ্চয় আপনি মহা বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (বাক্বারাহ ২/৩১-৩২)। অতঃপর তিনি আদমকে বললেন, ‘হে আদম! তুমি এদেরকে ঐসবের নামগুলি বলে দাও। অতঃপর যখন আদম তাদেরকে ঐসবের নামগুলি বলে দিল, তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আসমান ও যমীনের অদৃশ্য বিষয় সমূহ আমি সর্বাধিক অবগত এবং তোমরা যেসব বিষয় প্রকাশ কর ও যেসব বিষয় গোপন কর, সকল বিষয়ে আমি সম্যক অবহিত?’ (বাক্বারাহ ২/৩৩)। এরপর আল্লাহ আদমকে সম্মানসূচক সিজদা করার জন্য ফেরেশতাদের আদেশ দিলেন’ (বাক্বারাহ ২/৩৩-৩৪)।
(৩) জ্ঞানের কারণে দুনিয়ায় মানুষকে সম্মান প্রদান করা হয়েছে : পৃথিবীতে যাকেই আল্লাহ সম্মানিত করেছেন ও আদর্শ বানিয়েছেন, তা করেছেন জ্ঞানের কারণে। কুরআনে নবী-রাসূল নন এমন কতক মর্যাদাবান ব্যক্তির আলোচনা এসেছে। যেমন- ১. খিযির (কাহাফ ১৮/৬৫), ২. লোকমান (লোকমান ৩১/১২), ৩. ত্বালূত (বাক্বারাহ ২/২৪৭)।
(৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে অবতীর্ণ প্রথম বাণী ‘পড়’ : লিখার মত পড়াও ইলমের অন্যতম মাধ্যম। জাহেলী সমাজে ইসলামের আলো জ্বালানোর জন্য ‘উম্মী’ তথা ‘নিরক্ষর’ নবীকে (জুম‘আ ৬২/২) প্রথমে পড়া তথা জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন,اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ، خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ، اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ، الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ، عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ- ‘পড়! তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড হ’তে। পড়, আর তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না’ (‘আলাক্ব ৯৬/১-৫)।
(৫) ইলম অন্বেষণ করা ফরয : ইলম অর্জনের হুকুম হ’ল ফরয। মহান আল্লাহ বলেন,فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ ‘অতএব তুমি জানো যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তোমার ত্রুটির জন্য ও মুমিন নর-নারীদের ত্রুটির জন্য তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। এখানে মহান আল্লাহ ‘ঈমান’ ও ‘আমলের’ পূর্বে ইল্ম অর্জনকে আবশ্যক করেছেন। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِم، ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফারয’।[7] ইমাম বুখারী (রহঃ) ছহীহ বুখারীতে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, باب العلم قبل القول والعمل ‘কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান অর্জন অনুচ্ছেদ’। তারপর তিনি সূরা মুহাম্মাদের ১৯নং আয়াত পেশ করে বলেন, ‘আল্লাহ ইলম দ্বারা আরম্ভ করেছেন।[8] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘ইলম ছাড়া ঈমান হয় না’।[9] উল্লেখ্য যে, ফরয ইলম দুই প্রকার। ফরযে আইন ও ফরযে কিফায়া।[10]
ফরযে আইন : শরী‘আত মানুষের উপর যেসব কাজ ফরয বা ওয়াজিব করে দিয়েছে, সেগুলোর হুকুম আহকাম ও মাসআল-মাসায়েল সম্পর্কে জ্ঞান হাছিল করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয।[11] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ফরযে আইন ইলম হ’ল- ১. ঈমানের উছূল তথা খুঁটিগুলো জানা, ২. ইসলামী শরী‘আতের ইলম। যেমন- ওযূ, ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি, ৩. ইসলামের হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলোর জ্ঞান, ৪. মু‘আমালাত ও মু‘আশারাতের ইলম।[12]
ফরযে কিফায়া : কোন বিয়য়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান লাভ করা তথা বিশেষজ্ঞ হওয়া, যা সবার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। যেমন ইসলামী শরী‘আতের জ্ঞান, প্রকৌশল বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ- ‘আর মুমিনদের এটা সঙ্গত নয় যে, সবাই একত্রে (জিহাদে) বের হবে। অতএব তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং ফিরে এসে নিজ কওমকে (আল্লাহর নাফরমানী হ’তে) সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা সাবধান হয়’ (তওবা ৯/১২২)।
(৬) ইলম সকল ইবাদতের মূল : যে কোন আমল আল্লাহর কাছে কবুলযোগ্য হওয়ার জন্য কয়েকটি শর্ত রয়েছে।[13] আর এগুলো জানার জন্য ইল্মের প্রয়োজন। এছাড়াও তাওহীদ, শিরক, সুন্নাত, বিদ‘আত জানার জন্যও ইল্মের প্রয়োজন। আল্লাহ দুনিয়াতে দু’টি রাস্তা দেখিয়েছেন (বালাদ ৯০/১০), একটি শুকরিয়ার অন্যটি কুফরীর (ইনসান ৭৬/৩)। একটি শয়তানের অন্যটি রহমানের। এগুলো জানার জন্য ইল্মের প্রয়োজন। অনুরূপভাবে হক-বাতিল বা সঠিক-বেঠিক জানার জন্য ইল্মের প্রয়োজন।
ছালেহ আল-উছায়মীন (রহ.) বলেন, ইলম অর্জন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ’।… আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের বুঝকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সমতুল্য করেছেন। বরং তদপেক্ষা বেশী। কারণ ইলম ছাড়া মুজাহিদ জিহাদ করতে পারে না; মুছল্লী ছালাত আদায় করতে পারে না; যাকাত আদায়কারী যাকাত দিতে পারে না; ছায়েম ছিয়াম পালন করতে পারে না; হাজী হজ্জ করতে পারে না; ওমরাহকারী ওমরাহ করতে পারে না; খাদ্য গ্রহণকারী খাদ্য খেতে পারে না; পানকারী পান করতে পারে না; ঘুমন্ত ব্যক্তি ঘুমাতে পারে না; জাগ্রত ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগতে পারে না। তাই ইল্ম হ’ল সবকিছুর মূল।[14]
(৭) ইলম অন্তরের জ্যোতি ও চোখের আলো : মহান আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِيْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ- ‘আর এভাবেই আমরা তোমার নিকট প্রেরণ করেছি রূহ (কুরআন), আমাদের আদেশক্রমে। অথচ তুমি জানতে না কিতাব কি বা ঈমান কি? বস্ত্ততঃ আমরা একে করেছি জ্যোতি। যার মাধ্যমে আমরা পথপ্রদর্শন করি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে আমরা চাই। আর নিশ্চয়ই তুমি প্রদর্শন করে থাক সরল পথ’ (শূরা ৪২/৫২)।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, নিশ্চয়ই ইলম জীবন ও আলো আর মূর্খতা হ’ল মৃত ও অন্ধকার। সমস্ত অনিষ্টের মূল হ’ল জীবন ও আলো না থাকা। আর কল্যাণের মূল হ’ল আলো ও জীবন। মহান আল্লাহ বলেন,أَوَمَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِي بِهِ، ‘আর যে ব্যক্তি মৃত ছিল, অতঃপর আমরা তাকে জীবিত করেছি এবং তাকে আলো দিয়েছি যা দিয়ে সে লোকদের মধ্যে চলাফেরা করে’ (আন‘আম ৬/১২২)।[15]
(৮) আক্বীদা ও আমল ছহীহ হওয়ার ভিত্তি ইল্ম : কথা ও কাজের পূর্বশর্ত হ’ল ইল্ম। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, إن العلم إمام العمل، وقائد له، والعمل تابع له ومؤتم به، فكل عمل لايكون خلف العلم مقتديا به فهو غير نافع لصاحبه، بل مضر عليه، كما قال بعض السلف: من عبد الله بغير علم كان ما يفسد أكثر مما يصلح. ‘নিশ্চয় ইলম আমলের নেতা ও তার পরিচালক। আর আমল ইল্মের অনুগামী ও তার অনুসারী। আমল যদি ইল্মের পিছনে না থাকে এবং তার অনুসারী না হয় তাহ’লে তা তার জন্য উপকারী হবে না। বরং তার জন্য ক্ষতিকর হবে। যেমন কোন সালফ বলেছেন, ইল্ম ছাড়া যে আল্লাহর ইবাদত করে সে কল্যাণের চেয়ে বেশী ক্ষতি করে’।[16]
(৯) ইবাদতের চেয়ে ইলমের মর্যাদা অধিক : সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,فضلُ العلمِ أحبُّ إليَّ من فضلِ العبادةِ وخيرُ دِينكمُ الورَعُ، ‘ইবাদতের মর্যাদা অপেক্ষা ইলমের মর্যাদা আমার নিকট অধিক পসন্দনীয়। আর তোমাদের সর্বোত্তম দ্বীন হ’ল আল্লাহভীতি’।[17]
হুযায়ফাহ বিন ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,فَضْلُ الْعِلْمِ خَيْرٌ مِنْ فَضْلِ الْعِبَادَةِ وَخَيْرُ دِينِكُمُ الْوَرَعُ ‘ইলমের মর্যাদা ইবাদতের মর্যাদা অপেক্ষা উত্তম। আর তোমাদের শ্রেষ্ঠতম দ্বীন হ’ল সংযমশীলতা’।[18]
(১০) ইলম পানাহার অপেক্ষা অধিক যরূরী : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পানাহারের প্রয়োজন যেমন, ইলমের প্রয়োজন তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী। এমনকি কোনটা খাবে, কোনটা খাবে না সেটাও ইলমের মাধ্যমেই নির্ধারণ করতে হবে। তাই ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন,الناس مُحْتَاجُون إلى العِلْم أكثر مِن حاجتهم إلى الطعام والشراب؛ لأن الطعام والشراب يُحْتَاج إليه في اليوم مرة أو مرتين، والعِلْم يُحْتَاج إليه بِعَدَد الأنفاس ‘মানুষের পানাহারের চেয়ে জ্ঞানের প্রয়োজন বেশী। কারণ খাদ্য ও পানীয় দিনে একবার বা দু’বার প্রয়োজন। আর জ্ঞানের প্রয়োজন শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা পরিমাণ’।[19]
(১১) ইলম নবীদের উত্তরাধিকার : প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হন। নবীগণ মৃত্যুর সময় মীরাছ হিসাবে ইলম রেখে গেছেন। তাই যারা ইলম অর্জন করতে পারল তারাই নবীগণের প্রকৃত উত্তরাধিকার হ’ল। আবুদ দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَ بِهِ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ، ‘অবশ্যই আলেমগণ নবীদের ওয়ারিছ। আর নবীগণ উত্তরাধিকার হিসাবে কোন দীনার বা দিরহাম রেখে যাননি, বরং তাঁরা মীরাছ হিসাবে রেখে গেছেন ইলম। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলম লাভ করেছে, সে পূর্ণ অংশ লাভ করেছে’।[20]
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি একদা মদীনার বাযার অতিক্রম করছিলেন। তখন বাযারে দাঁড়িয়ে বললেন, হে বাযারের লোক সকল! কিসে তোমাদেরকে অপারগ করল? তারা বলল, উহা কি হে আবূ হুরায়রাহ? তিনি বললেন, ওখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মীরাছ বণ্টন হচ্ছে আর তোমরা এখানে? তোমরা সেখানে গিয়ে কিছু অংশ নাও না কেন? তারা বলল, উহা কোথায়? তিনি বললেন, মসজিদে। একথা শুনে তারা সেখানে ছুটে গেল। আর আবু হুরায়রাহ (রাঃ) দাঁড়িয়ে থাকলেন, শেষ পর্যন্ত তারা ফিরে এল। তারপর তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা কি করলে? তারা বলল, হে আবূ হুরায়রাহ! আমরা গিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলাম। কিন্তু কোন কিছু বণ্টন হচ্ছে তা তো দেখলাম না? আবূ হুরায়রা বললেন, তোমরা মসজিদে কাউকে দেখতে পাওনি? তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা দেখেছি কিছু লোক ছালাত আদায় করছে, কিছু লোক কুরআন তেলাওয়াত করছে, কিছু লোক হালাল-হারামের বিষয়ে পরস্পরে আলোচনা করছে। তখন আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) বললেন, আফসোস তোমাদের জন্যে! ওটাই তো মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মীরাছ’।[21]
(১২) সম্পদের চেয়ে ইলম উত্তম : সকল মানুষই সম্পদের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকে। অথচ দুনিয়া ও আখেরাতে তার সম্পদের তুলনায় ইলম অনেক বেশী উপকারী ও উত্তম। আলী (রাঃ) বলেন,العلمُ خيرٌ مِن المالِ، العلمُ يحرُسُكَ، وأنتَ تحرُسُ المال، المالُ يُنقِصُه النفقةُ، والعلمُ يزكو على الإنفاقِ، ‘সম্পদের চেয়ে জ্ঞান উত্তম। জ্ঞান আপনাকে রক্ষা করে আর আপনি সম্পদকে রক্ষা করেন। অর্থ ব্যয় করলে কমে যায় আর জ্ঞান ব্যয় করলে বৃদ্ধি পায়’।[22] ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, অনেক দিক থেকে সম্পদের চেয়ে ইলমের মর্যাদা বেশী।[23] যেমন- ক. ইলম হ’ল নবীগণের মীরাছ, আর সম্পদ হ’ল ধনীদের মীরাছ। খ. নিশ্চয়ই ইলম তার মালিককে পাহারা দেয়, কিন্তু সম্পদ মালিককে পাহারা দেয় না, বরং মালিককে তার সম্পদ পাহারা দিতে হয়। গ. সম্পদ খরচ করলে কমে যায়, আর ইলম খরচ করলে বৃদ্ধি পায়। ঘ. নিশ্চয়ই মালের মালিক মারা গেলে তার থেকে মাল পৃথক হয়, আর ইলম তার মালিকের সাথে কবরে প্রবেশ করবে। ঙ. সম্পদের উপর ইলমের হুকুম প্রযোজ্য হয় কিন্তু ইলমের উপর সম্পদের হুকুম প্রযোজ্য হয় না। চ. সম্পদ মুমিন-কাফের ও ভালো-মন্দ সকলে অর্জন করতে পারে। কিন্তু উপকারী ইলম মুমিন ছাড়া কেউ অর্জন করতে পারে না। ছ. সম্পদ মানুষকে অবাধ্যতা, অহংকার ও হিংসার দিকে নিয়ে যায় আর ইলম মানুষকে বিনয় ও আল্লাহর ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়। জ. সম্পদের মালিকের দরিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিন্তু ইলমের মালিকের দরিদ্র হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ঝ. নিশ্চয় ইলম মানুষকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করে আর সম্পদ মানুষকে দুনিয়ার দিকে ধাবিত করে। ঞ. সম্পদশালী মৃত্যুকে অপসন্দ করে আর আলেম আল্লাহর সাক্ষাতের আশা করে।
(১৩) ইল্ম অর্জন জিহাদের অন্যতম প্রকার : জিহাদ শুধু ঢাল-তরবারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইলম অর্জনও এক প্রকার জিহাদ; বরং এটিই সকল জিহাদের মূল। কারণ ইলম ছাড়া কোন জিহাদই সঠিক হবে না। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘জিহাদ দুই প্রকার। প্রথমত: হাত ও মুখের জিহাদ; দ্বিতীয়ত: প্রমাণ ও দলীলের জিহাদ। এটা যারা রাসূল (ছাঃ)-এর অনুসারী তাদের সাথে খাছ। এটা নেতাদের জিহাদ’। বিশাল উপকারিতা, সরবাহের ব্যাপকতা ও তার শক্রদের বিশালতার কারণে ২য় প্রকার দু’টি জিহাদের মধ্যে সর্বোত্তম। এজন্য মহান আল্লাহ সূরা ফুরক্বানে বলেন, ‘আর আমরা চাইলে প্রত্যেক জনপদে একজন করে সতর্ককারী (রাসূল) প্রেরণ করতাম। অতএব তুমি কাফেরদের অনুসরণ করো না। আর তুমি তাদের বিরুদ্ধে এর (কুরআনের) সাহায্যে কঠোর জিহাদ কর’ (ফুরক্বান ২৫/৫১-৫২)।[24]
(১৪) ইলম ক্ষতি থেকে বাঁচায় : দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতি থেকে বাচার জন্য সূরা আছরে আল্লাহ চারটি গুণের কথা বলেছেন তান্মধ্যে ঈমান তথা ইল্ম হ’ল প্রথম। মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ، إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ- ‘নিশ্চয়ই সকল মানুষ অবশ্যই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তারা ব্যতীত যারা (জেনে-বুঝে) ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম সম্পাদন করেছে এবং পরস্পরকে ‘হক’-এর উপদেশ দিয়েছে ও পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে’ (আছর ১০৩/২-৩)। মূলতঃ জানার নামই ঈমান। আর ঈমানের পূর্ব শর্ত হ’ল ইলম (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য ইলমের প্রয়োজন। ইমাম শাফেঈ বলেন,من أراد الدنيا فعليه بالعلم ومن أراد الآخرة فعليه بالعلم ومن أرادهما معا فعليه بالعلم أيضا ‘যে দুনিয়া চায় তার জন্য ইলম অর্জন করা যরূরী, যে আখেরাত চায় তার জন্যও ইলম অর্জন করা যরূরী। আর যে (দুনিয়া ও আখিরাত) উভয়টিই চায় তার জন্যও ইলম অর্জন করা যরূরী’।[25]
(১৫) আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে জ্ঞান দান করেন : মু‘আবিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْراً يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকেই দ্বীনী জ্ঞান দান করেন’।[26] আর যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেন তাকেই মূলতঃ সর্বিক কল্যাণ দান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ، ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। বস্ত্তত জ্ঞানী লোকেরা ব্যতীত কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,إن من نال شيئا من شرف الدنيا والآخرة فإنما ناله بالعلم، ‘নিশ্চয়ই দুনিয়া ও আখেরাতে যে মর্যাদা লাভ করেছে, তা ইলমের জন্যই লাভ করেছে’।[27]
ছাহাবীগণ ভিন্ন ভিন্ন ইলমে পারদর্শী ছিলেন। কেউ হাদীছ বিষয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন, যেমন আবূ হুরায়রা (রাঃ), আনাস (রাঃ), আয়েশা (রাঃ) প্রমুখ। কেউ কুরআন লিখার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। যেমন যায়েদ বিন ছাবিত (রাঃ), মু‘আবিয়া (রাঃ) প্রমুখ। কেউ কুরআনের তাফসীরে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন, যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)। কেউ আবার শৈশবেই গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ), আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)। ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) একদা বললেন, গাছ-গাছালির মধ্যে এমন একটি গাছ আছে যার পাতা ঝরে না। আর তা মুসলিমের উদাহরণ। তোমরা আমাকে অবগত কর সেটি কি গাছ? তখন লোকেরা জঙ্গলের বিভিন্ন গাছ-গাছালির নাম ধারণা করতে লাগল। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আমার ধারণা হ’ল, সেটা খেজুর গাছ। কিন্তু আমি (ছোট হওয়ায়) তা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। অতঃপর ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি আমাদের বলে দিন, সেটি কি গাছ? তিনি বললেন, তা হচ্ছে খেজুর গাছ’।[28]
(১৬) ইলমের কারণে বান্দা রিযিক প্রাপ্ত হয় : আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগে দুই ভাই ছিল। তাদের একজন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত থাকত এবং অন্যজন আয়-উপার্জনে লিপ্ত থাকত। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট সেই উপার্জনকারী ভাই তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তিনি তাকে বললেন, لَعَلَّكَ تُرْزَقُ بِهِ ‘হয়তো তার অসীলায় তুমি রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছ’।[29]
(১৭) ইলম আল্লাহর পক্ষ থেকে নে‘মত : আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নে‘মত হ’ল ইলম। মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেন,وَأَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا- ‘আর আল্লাহ তোমার উপর কিতাব ও সুন্নাহ অবতীর্ণ করেছেন এবং তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তুমি জানতে না। বস্ত্তত তোমার উপর আল্লাহর করুণা অসীম’ (নিসা ৪/১১৩)। আর যাকে এই ইলম দেওয়া হয়েছে তাকেই মূলত কল্যাণ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا، ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)। আল্লাহ ইলমের মত নে‘মত তাঁর প্রিয় বান্দা তথা নবী-রাসূলদেরকে দিয়েছেন। যেমন- ইউসুফ (আঃ) (ইউসুফ ১২/২২), মূসা (আঃ) (ক্বাছাছ ২৮/১৪), ঈসা (আঃ) (মায়েদাহ ৫/১১০), দাঊদ (আঃ) (ছোয়াদ ৩৮/২০), সোলায়মান (আঃ) (আম্বিয়া ২১/৭৯;নামল ২৭/১৫)।
(১৮) মৃত্যুর পরও ইলমের ছওয়াব জারী থাকে : দুনিয়াতে ইলম যেমন মর্যাদার বস্ত্ত তেমনি মৃত্যুর পরও ইলমের ছওয়াব জারী থাকে। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا مَاتَ ابْنُ آدَمَ انْقَطَعَ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاثٍ : صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ، ‘আদম সন্তান যখন মারা যায়, তখন তার তিন প্রকার আমল ছাড়া অন্য সব রকম আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; ছাদাক্বাহ জারিয়াহ অথবা ইলম, যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় অথবা সুসন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[30] রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,إِنَّ مِمَّا يَلْحَقُ الْمُؤْمِنَ مِنْ عَمَلِهِ وَحَسَنَاتِهِ بَعْدَ مَوْتِهِ عِلْمًا عَلَّمَهُ وَنَشَرَهُ وَوَلَدًا صَالِحًا تَرَكَهُ وَمُصْحَفًا وَرَّثَهُ أَوْ مَسْجِدًا بَنَاهُ أَوْ بَيْتًا لاِبْنِ السَّبِيلِ بَنَاهُ أَوْ نَهْرًا أَجْرَاهُ أَوْ صَدَقَةً أَخْرَجَهَا مِنْ مَالِهِ فِي صِحَّتِهِ وَحَيَاتِهِ يَلْحَقُهُ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِ ‘মুমিনের মৃত্যুর পর তার আমল ও পুণ্যকর্মসমূহ হ’তে নিশ্চিতভাবে যা তার সাথে মিলিত হয় তা হ’ল সেই ইলম, যা সে শিক্ষা করে প্রচার করেছে অথবা নেক সন্তান, যাকে রেখে সে মারা গেছে অথবা কুরআন, যা সে মীরাছরূপে ছেড়ে গেছে অথবা মসজিদ, যা সে নিজে নির্মাণ করে গেছে অথবা মুসাফিরখানা, যা সে পথিকদের সুবিধার্থে নির্মাণ করে গেছে অথবা পানির নালা, যা সে প্রবাহিত করে গেছে অথবা ছাদাক্বা, যা সে নিজের মাল থেকে তার সুস্থ ও জীবিতাবস্থায় দান করে গেছে। এসব কর্মের ছওয়াব তার মৃত্যুর পরও তার সাথে এসে মিলিত হবে’।[31]
(১৯) রাসূল (ছাঃ) কবরে নামানোর সময় আলেমকে অগ্রাধিকার দিতেন : জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) ওহোদের শহীদগণের দু’দু’জনকে একত্র করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ فَإِذَا أُشِيرَ لَهُ إِلَى أَحَدِهِمَا قَدَّمَهُ فِي اللَّحْدِ فَقَالَ أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلاَءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَمَرَ بِدَفْنِهِمْ بِدِمَائِهِمْ وَلَمْ يُغَسِّلْهُمْ ‘তাঁদের মধ্যে কুরআন সম্পর্কে কে অধিক জ্ঞাত? দু’জনের কোন একজনের দিকে ইঙ্গিত করা হ’লে প্রথমে তাঁকে কবরে রাখতেন। অতঃপর এরশাদ করেন, ক্বিয়ামতের দিন আমি তাঁদের জন্য সাক্ষী হব। তিনি রক্ত-মাখা অবস্থায়ই তাঁদের দাফন করার আদেশ করলেন এবং তাঁদের গোসলও দেননি’।[32]
[ক্রমশঃ}
মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
তুলাগাঁও নোয়াপাড়া, দেবিদ্বার, কুমিল্লা।
[1]. ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, মু‘জামুল ওয়াফী, পৃঃ ৭০৫।
[2]. আল-মাওসূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ, ৩০/২৯০।
[3]. তিরমিযী হা/২১৫৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৩৩।
[4]. হাকেম হা/৩৬০; দারেমী হা/৪৯৮।
[5]. বুখারী হা/১১৩।
[6]. বুখারী হা/১১২।
[7]. ইবনে মাজাহ হা/২২৪; ছহীহুল জামে হা/৩৯১৩।
[8]. কিতাবুল ইলম, অনুচ্ছেদ- ১০।
[9]. ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১) ফাযলুল ইল্ম ওয়াল ‘উলামা (বৈরুত: আল মাকতাব আল ইসলামী: ১ম প্রকাশ ১৪২২/২০০১ খ্রি:) পৃ: ২৯।
[10]. ছালেহ আল-উছায়মীন: শরহে রিয়াযুছ ছালেহীন ৫/৪১৬।
[11]. কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর) মদিনা: বাদশাহ্ ফাহাদ কুরআন মুদ্রণ কমপ্লেক্স, ১/১০২৭ পৃ:।
[12]. ফাযলুল ইল্ম ওয়াল উলামা (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী: ১ম প্রকাশ ১৪২২/২০০১ খ্রি:) পৃ: ৩০-৩১।
[13]. ‘আমল কবুলের শর্ত তিনটি : (১) আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া (২) তরীকা সঠিক হওয়া এবং (৩) ইখলাছে আমল। অর্থাৎ কাজটি নিঃস্বার্থভাবে কেবলমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে হওয়া (যুমার ৩৯/২)। দ্রঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব তাফসীরুল কুরআন, সূরা আছর ৩ নং আয়াতের তাফসীর দ্র:।
[14]. মুহাম্মদ বিন ছালেহ আল-উছায়মিন: শরহ রিয়াযিছ ছালেহীন (রিয়াদ: দারুল ওতান, ১ম প্রকাশ ১৪২৮ হি:) ৫/৪১৩-৪১৪।
[15]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা, পৃঃ ৩২১; মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ ১/২৩১।
[16]. মিফতাহু দারিস সা‘আদাহ পৃঃ ২।
[17]. মুসতাদরাক হাকিম হা/৩১৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৪২১৪।
[18]. ত্বাবারানী আওসাত্ব হা/৩৯৬০; বাযযার হা/২৯৬৯; ছহীহুত তারগীব হা/৬৫।
[19]. মাদারিজুস সালেকীন ২/৪৭০; ইলামূল মু‘আক্কেইন ২/২৫৬।
[20]. আবু দাউদ হা/৩৬৪১; তিরমিযী হা/২৬৮২।
[21]. ত্বাবরানী আওসাত্ব হা/২/১১৪; আলবানী, ছহীহুত তারগীব হা/৮২।
[22]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা, ১৫৬ পৃঃ; ইবনে আসাকির, তারিখ দিমাশক ৫০/৫৭১; গাযালী, ইহইয়া উলূমুদ্দীন ১/১৭-১৮।
[23]. ফাযলুল ইলম ওয়াল ওলামা, পৃঃ ৯-২২৪। তিনি প্রায় চল্লিশটি দিক উল্লেখ করেছেন।
[24]. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম: যাদুল মা‘আদা ৩/৫৮।
[25]. https://marj3y.com/صحة-من-أراد-الدنيا-فعليه-بالعلم-ومن-أرا/
[26]. বুখারী হা/৭১, ৩১১৬, ৭৩১২; মুসলিম হা/২৪৩৬, ২৪৩৯।
[27]. ফাযলুল ইল্ম ওয়াল ওলামা (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী: ১ম প্রকাশ ১৪২২/২০০১ খ্রি:) পৃ:৮০।
[28]. বুখারী হা/৬১।
[29]. তিরমিযী হা/২৩৪৫; সিলসিলা ছহীহা হা/২৭৬৯।
[30]. মুসলিম হা/৪৩১০।
[31]. ইবেন মাজাহ হা/২৪২, ইবনে খুজাইমাহ হা/২৪৯০।
[32]. বুখারী হা/১৩৫৩।