অপহরণের পর লাকিংমে চাকমাকে কুমিল্লায় নিয়ে যান আতাউল্লাহ এবং সেখানে তাকে ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করেন। যে জন্মসনদ ব্যবহার করে লাকিংমেকে ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করা হয়েছে, সেটি জাল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সমকালের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের ২১ জানুয়ারি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাজি (বিবাহ রেজিস্ট্রার) নূরুল ইসলাম বিয়েটি পড়ান এবং নিকাহনামা রেজিস্ট্রেশন করেন। একই দিন কুমিল্লা আদালতের আইনজীবী সিদ্দিকুর রহমান একটি হলফনামা নোটারির মাধ্যমে লাকিংমে চাকমাকে ধর্মান্তরিত করেন। এসবই আতাউল্লাহর সরবরাহ করা ওই জাল জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে করা হয়েছে বলে জানান তারা।
লাকিংমে অপহৃত হয়েছে গত বছরের ৫ জানুয়ারি। তার স্বামী দাবিদার আতাউল্লাহ অবশ্য অপহরণের বিষয়টি মানতে নারাজ। তার দাবি, লাকিংমে নিজেই বাড়ি ছেড়ে এসেছিল। তবে লাকিংমে চাকমার ওপর ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার তথ্যানুসন্ধানে গত ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর কক্সবাজার ও টেকনাফ ঘুরে আসা শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আদিবাসী নেতাদের একটি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বলছেন, ‘মেয়েটি নিজে বাড়ি ছেড়ে এসেছে- আতাউল্লাহর এমন দাবি মেনে নিলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া অপহরণ বলেই গণ্য হবে।’
তথ্যানুসন্ধান দলের সংগৃহীত জন্মনিবন্ধন এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) সনদ অনুযায়ী অপহরণের দিন লাকিংমের বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। তথ্যানুসন্ধানীরা আতাউল্লাহ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে অপহরণ, অপ্রাপ্তবয়স্ককে ধর্মান্তর, বিয়েতে বাধ্য করার অভিযোগ এনেছেন। তাদের মতে, বিয়েটি আইনের চোখে অবৈধ, ফলে ধর্ষণের অভিযোগও আসবে আতাউল্লাহর বিরুদ্ধে। অবৈধ বিয়ের ফলে লাকিংমে অকালে মা হয়েছিল। মাত্র ১৩ দিনের একটি মেয়েশিশু রেখে লাকিংমে আত্মহত্যা করেছে বলে তথ্যানুসন্ধানকারী দলকে জানান আতাউল্লাহর মা রহিমা খাতুন। রহিমার এ বক্তব্য নিয়ে তথ্যানুসন্ধানী দলটি সন্দেহ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছেন, মেয়েটিকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। নয়তো আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে অবশ্যই।
আতাউল্লাহ নিজে ও তার মা রহিমা খাতুনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা পরস্পরবিরোধী তথ্য দিয়েছেন তথ্যানুসন্ধানী দলকে। লাকিংমেকে বিয়ের আগে মা ও পরিবারের অন্যদের জানিয়েছিলেন- এমনটাই আতাউল্লাহর দাবি। কিন্তু তার মা রহিমা খাতুন বলেন, গত রমজানের তিন দিন আগে বউ নিয়ে বাড়ি এলে তিনি জানতে পারেন, ছেলে বিয়ে করেছে। কুমিল্লায় ‘বিবাহ সমর্থনে করা’ এফিডেভিটে লাকিংমের সঙ্গে তার ‘প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি’ হয়েছে বলে উল্লেখ করলেও গত ৩১ ডিসেম্বর ও ২ জানুয়ারি তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপে আতাউল্লাহ দাবি করেছেন, ধর্মান্তরে আগ্রহী একটি চাকমা মেয়ের ইচ্ছে পূরণের জন্য বিয়ে করেছেন তিনি। আলাপের প্রথম দিন জাল জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরির বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। দ্বিতীয় দিন ২ জানুয়ারি তাকে বলা হয়, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের পরিচালক এহসান উল্লা জানিয়েছেন, কুমিল্লার আদালতে জমা দেওয়া সনদটির কোনো নিবন্ধন তাদের কাছে নেই। এটি ভুয়া সনদ। শুধু তাই নয়, সনদে যার স্বাক্ষর রয়েছে, সেই সফুরা বেগম দাবি করেছেন- এটি তার স্বাক্ষর নয়। উল্লেখ্য, কুমিল্লা থেকে লাকিংমেকে বিয়ে করার জন্য আতাউল্লাহর ব্যবহৃত জাল সনদ সংগ্রহের পর তথ্যানুসন্ধান দলটি গত ২৮ ডিসেম্বর সরেজমিনে গিয়েছিল বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এবং যোগাযোগ করে সফুরা বেগমের সঙ্গে। এসব জানার পর আতাউল্লাহ বলেন, ‘লাকি বাড়ি থেকে কোনো কিছু নিয়ে আসতে না পারায় এটা করেছি। তবে আমি নিজে কিছুই করিনি। আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে সবকিছু করে দিয়েছেন কুমিল্লার দিদার উকিল।’
সমকালের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, শিক্ষানবিশ আইনজীবী দিদারুল ইসলাম দিদার এই জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বিয়েটি সম্পন্ন করে দেওয়ার জন্য দায়ী। তবে দিদার দাবি করেছেন, লাকিংমে চাকমা অপহরণের বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। আতাউল্লাহ নিজেই ওই জন্মসনদ নিয়ে এসে লাকিংমেকে প্রাপ্তবয়স্ক দাবি করেন। এরপর কাগজপত্র পেয়ে যাবতীয় কাজ করেছেন তারা। আতাউল্লাহ নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যাচার করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাকিংমে চাকমাকে কুমিল্লায় নিয়ে এসে গত বছরের ২১ জানুয়ারি ধর্মান্তর ও কথিত বিয়ে করেন আতাউল্লাহ। কুমিল্লা আদালতের আইনজীবী সিদ্দিকুর রহমান যে হলফনামা নোটারি করার মাধ্যমে লাকিংমে চাকমাকে ধর্মান্তরিত করেন, সেটিতে শনাক্তকারী ছিলেন অ্যাডভোকেট কাজী এনায়েত উল্লা। নোটারি পাবলিক অ্যাডভোকেট সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এনায়েত উল্লা শনাক্তকারী ছিলেন বলেই সরল বিশ্বাসে আমি এগুলো নোটারি করে দিয়েছি। এর বেশি আমার কিছুই জানা নেই।’
যে জন্মসনদ দিয়ে তারা ধর্মান্তর করে বিয়ে দিয়েছেন, সেটি জাল ছিল- এ তথ্য জানানোর পর ওই বাল্যবিয়ের কাজি ও আইনজীবীরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। তারা একে অপরের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন এখন। ধর্মান্তর এবং কথিত বিয়েটি সম্পন্ন হয়েছে যে জন্মসনদ দিয়ে, সেটি সত্য কিনা, কাজি ও আইনজীবী কেউই যাচাই করেননি বলে স্বীকার করেছেন।
কাজি নূরুল ইসলাম দাবি করেন, গত বছরের ২১ জানুয়ারি ওই বিয়েটি হয়েছে কুমিল্লা আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তায়েফুর রহমানের চেম্বারে। তার সহকারী অ্যাডভোকেট কাজী এনায়েত উল্লা ও অ্যাডভোকেট দিদার ওই বিয়ের আয়োজন করে তাকে খবর দিয়েছেন। এরপর তিনি ওই চেম্বারে গিয়ে জন্মসনদ ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হলফনামা পেয়ে নিকাহ নিবন্ধন করেছেন। তবে তিনি অ্যাডভোকেটদের কাছ থেকে হলফনামা পাওয়ায় জন্মসনদটি যাচাই করেননি। যাচাই করার প্রক্রিয়াও তিনি জানেন না বলে অকপটে স্বীকার করেছেন।
অ্যাডভোকেট কাজী এনায়েত উল্লা বলেন, ‘আমি দুটি হলফনামায় শনাক্তকারী ছিলাম। কিন্তু বিয়েটি আমাদের এখানে পড়ানো হয়নি। বিয়েটি কাজি অন্য কোথাও সম্পন্ন করেছেন। আর এটা বাল্যবিয়ে কিনা, সেটা যাচাই করার দায়িত্ব কাজির। আমরা জন্মসনদে প্রাপ্তবয়স্ক দেখে হলফনামা নোটারির মাধ্যমে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের (ধর্মান্তর) কাজটি করেছি।’ নোটারির আগে তারও সনদ যাচাই করা উচিত ছিল কিনা জিজ্ঞেস করা হলে এনায়েত উল্লা বলেন, ‘আমাদের কাছে জন্মসনদ যাচাই করার সুযোগ নেই। যদি জন্মসনদ ভুয়া হয়, সে ক্ষেত্রে আতাউল্লাহ আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন কুমিল্লা সংবাদদাতা আবদুর রহমান]