আমদানি করা পেঁয়াজগুলোতে পচন ধরেছে। টিসিবির ট্রাকের পেঁয়াজের প্রায় অর্ধেকই এখন পচা। একই অবস্থা খোলাবাজার থেকে কেনা আমদানির পেঁয়াজেও। ফলে দাম অর্ধেক কমালেও এই পেঁয়াজ কেনায় ক্রেতাদের আগ্রহ নেই। এর কারণ, বাজারে পেঁয়াজের দাম কমে গেছে। সেই পচা পেঁয়াজগুলো কৌশলে নিম্ন আয়ের গরিব মানুষকে গছিয়ে দিচ্ছে সরকারি বিক্রয়কারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
এদিকে বন্দরে পেঁয়াজের স্তূপ বাড়ছে। এসব পেঁয়াজের ভবিষ্যৎ কী, কেউ বলতে পারছে না। ডিলাররা বলছেন, পচা পেঁয়াজ নিতে গড়িমসি করলে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে টিসিবি। ক্রেতারা বলছেন, দোকান থেকে কিনলে তাও ভালো-মন্দ দেখে কেনা যায়, কিন্তু ট্রাক থেকে সে সুযোগ নেই। আগে থেকে পলিব্যাগে ভরে রাখা পেঁয়াজ গছিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতারা। এর অর্ধেকই খাওয়ার অনুপযুক্ত। বাকিগুলোও স্বাদ-গন্ধহীন ঘাসপাতার মতো। বাজার থেকে কেনা পেঁয়াজগুলো ওপর থেকে দেখে ভালো মনে হলেও বেশির ভাগই ভেতরে পচন ধরেছে।
গতকাল রাজধানীর মুগদা, মালিবাগ, বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, টিসিবির পেঁয়াজবোঝাই ট্রাকগুলোতে বিক্রেতারা সময় কাটাচ্ছেন পলিব্যাগে পেঁয়াজ পোঁটলা তৈরি করে। অনেকে অবসর কাটাচ্ছেন ট্রাক থেকে নেমে কিছুটা দূরে। বেশির ভাগ ট্রাকে বিক্রি হচ্ছে দুই দিন আগে টিসিবির গুদাম থেকে ওঠানো পেঁয়াজ। নিম্ন আয়ের মানুষ ও হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোই এসব পেঁয়াজের মূল ক্রেতা এখন।
গতকাল দুপুর ২টায় মুদগা মেডিক্যালের গেটে গিয়ে দেখা যায়, টিসিবির ট্রাকে তিনজন বিক্রেতা। ডিলার আসেননি। দুজন মিলে ভালো-খারাপ সব পেঁয়াজ একই ব্যাগে ভরে মেপে পাঁচ কেজির প্যাকেট করছেন। মূল বিক্রেতা শাহিন ট্রাকের ছায়ায় বসে ঝিমাচ্ছিলেন। ওপরে স্যাঁতসেঁতে ও কালচে হয়ে গেছে ট্রাকের পেঁয়াজগুলো। যেগুলো বাদামি রং রয়েছে এখনো সেগুলো চাপ দিলে ভেতর থেকে পানি বের হচ্ছে। এসব পচন ধরা পেঁয়াজের সঙ্গে মিশে ভালোগুলোও পচা মনে হচ্ছিল।
জানতে চাইলে শাহিন বলেন, ‘আমরা তো চাই ভালো পেঁয়াজ বিক্রি করতে। সরকার আমাদের যা দেয় তা-ই বিক্রি করছি। ৪০ টাকার পেঁয়াজ এখন ২০ টাকা, তা-ও বিক্রি হয় না। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ছয় হাজার টাকার পেঁয়াজ বিক্রি করতে পেরেছি। তা-ও কয়েক জায়গায় বসে। এখন সব জায়গায় বসতেও দেয় না স্থানীয় ছেলেপেলেরা। তারা রাস্তার পাশে ভ্যান লাগিয়ে টাকা তোলে।’
একই অবস্থা মালিবাগসহ অন্যান্য এলাকার ট্রাকেও। তবে অনেককে ডাল কিনতে এসেও পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে। ট্রাকগুলোতে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ কিনলে এক কেজি ডাল পাওয়া যায়। মোট ১৫০ টাকার পণ্য। এসব ট্রাকে দুই হাজার ৫০০ কেজি পেঁয়াজ ও ২৪০ কেজি ডাল দেওয়া হচ্ছে টিসিবি থেকে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারগুলোতে আমদানির যে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে তার মধ্যেও পচন ধরা পেঁয়াজ গছিয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতারা।
জানতে চাইলে শ্যামবাজার পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মাজেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানির পেঁয়াজ কিনে অনেকে পুঁজি হারিয়েছেন। ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আগের কেনা অনেক পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। কী হবে, এগুলো কে নেবে?’
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। বাজার সামলাতে বিকল্প দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। টিসিবির মাধ্যমে ট্রাক সেলের জন্য সরকার নিজেও আমদানি করে। গত ২৮ ডিসেম্বর ভারত আবার রপ্তানির বাজার খুলে দিলে আমদানির পেঁয়াজের চাহিদা একেবারেই কমে যায়। তবে এর আগে থেকেই নতুন মৌসুমের দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসায় চাহিদা কমছিল। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে দামও কমে অর্ধেকে। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এসব পেঁয়াজ হিমায়িত কনটেইনার থেকে নামানোর পর বেশি দিন ভালো থাকে না, পচে যায়।
জানা যায়, বাজারে আমদানির পেঁয়াজের এমন অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস অস্বাভাবিক রকম কমে গেছে। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক পেঁয়াজ খালাসের পরিমাণ ৫০ টনের কাছাকাছি নেমেছে। অথচ ভারত রপ্তানির দুয়ার খোলার আগে দিনে গড়ে খালাস হতো এক থেকে দুই হাজার টন। খালাস কম হওয়ায় বন্দরে পেঁয়াজের স্তূপও কমছে না। সব মিলিয়ে ২৬ হাজার টন পেঁয়াজ এখন বন্দরে আছে পড়ে আছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। এসব পেঁয়াজের এখন কী হবে, তা বলতে পারছেন না আমদানিকারক, টিসিবি কিংবা বিক্রেতারা।