শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণ ও পরিমার্জনে ১১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা খরচ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বিগত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে বিভিন্ন খাত উপখাতে এই টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। তবে গত ৫ আগস্টের পর পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালের আর্থিক খাতের বিভিন্ন অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার। আর্থিক অনিয়ম তদন্তে যে শ্বেতপত্র কমিটি গঠন করা হয়েছে এই কমিটি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই নিয়ন্ত্রণ বা মনিটরিং করছে।
অপর দিকে আওয়ামী লীগের লিস্টেড বুদ্ধিজীবী খ্যাত যেসব লেখক বা সম্পাদক এনসিটিবির বিভিন্ন শ্রেণীর বই লিখে বা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করেছেন তাদের বিষয়ে পৃথক তদন্ত করার বিষয়ে দাবি উঠেছে। এই লেখক বা সম্পাদকরা কে কিভাবে সরকারি অর্থ লোপাট করেছেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি এই কমিটি এনসিটিবির খাতভিত্তিক খরচের হিসাব তলব করেছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে পতিত আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরে পাঠ্যবই মুদ্রণ, পরিমার্জন, মূল্যায়ন এবং পরিবহনে ১১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। শ্বেতপত্র কমিটির চাহিদার আলোকে এনসিটিবির আর্থিক খরচের যে বিবরণী জমা দিয়েছে সেখানে খাতভিত্তিক বিভিন্ন সেক্টরের খরচ দেখানো হয়েছে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত এবং ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের কাজে গত ৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত যেসব খাত উপখাতে টাকা খরচ হয়েছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রস্তুত করে শ্বেতপত্র কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। গত শুক্রবার ছুটির দিনেই জরুরি তলবে আর্থিক এই বিররণী প্রস্তুত করে জমা দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায় আর্থিক অনিয়ম সংক্রান্ত শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মূল কমিটিতে থাকলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দফতর-পরিদফতরের আর্থিক অনিয়ম তদন্তে একাধিক উপ-কমিটি বা সাব কমিটিও কাজ করছে। সেন্ট্রাল কমিটির নির্দেশনার আলোকে এনসিটিবিতেও পাঁচ সদস্যের আর্থিক অনিয়ম তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সূত্র জানায় এনসিটিবির আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের কমিটিতে রয়েছেন প্রফেসর মো: নজরুল ইসলাম (হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা), প্রফেসর আবু নাসের টুকু (উৎপাদক নিয়ন্ত্রক), মো: আব্দুল মুমিন মোছাব্বির (ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ) মো: হাফিজুর রহমান (বিতরণ নিয়ন্ত্রক), মীর রাহাত মাসুম (বিশেষজ্ঞ)। যদিও পাঁচ সদস্যের এই কমিটির কাজকে আরো দ্রুত ও সহজ করতে এনসিটিবির আরো বেশ কয়েকজনকে কমিটিতে কোঅপ্ট করা হয়েছে। সূত্র জানায় কোঅপ্ট করা সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ড. প্রবীর চন্দ্র রায়, সাইফা সুলতানা, মাসুম হোসেন, শাহ মো: জুলফিকার রহমান প্রমুখ।
এ দিকে এনসিটিবি থেকে শ্বেতপত্র কমিটিতে পাঠানো আর্থিক খাতভিত্তিক বিবরণী থকে জানা যায়, শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন মূল্যায়ন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত (২০২০-২০২১) থেকে (২০২৩-২০২৪) পর্যন্ত চার বছরের ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৬ কোটি ৬৩ লাখ ৮ হাজার ৪৫৯ টাকা। আবার প্রাথমিক স্তরের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যপুস্তক উন্নয়ন সংক্রান্ত খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে এক কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮৬ টাকা। অপর দিকে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ সংক্রান্ত বিগত ১৫ বছরের অর্থাৎ ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত শুধু মুদ্রণ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮ হাজার ৪২৯ কোটি ৭৩ লাখ ৪০ হাজার ৪৩১ টাকা। একই সাথে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ সংক্রান্ত ব্যয় (২০১২-২০১৩) থেকে (২০২৩-২০২৪) পর্যন্ত দেখানো হয়েছে তিন হাজার ২৩১ কোটি ৫২ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৬ টাকা।
কমিটি এক সদস্য নয়া দিগন্তকে জানান, এই হিসাববিবরণী শ্বেতপত্র কমিটির কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে প্রয়োজনে পুনরায় অডিট করার নির্দেশনাও দিতে পারবেন তারা। এ দিকে এনসিটিবির লিস্টেট যেসব আওয়ামী বুদ্ধিজীবী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন শ্রেণীর বই লিখে কিংবা পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে নগদে বা চেকের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করেছেন সেই অর্থ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে সম্প্রতি এনসিটিবির কালো তালিকাভুক্ত বিতর্কিত লেখক জাফর ইকবালকে লেখক তালিকা থেকে বাদ এবং তার লেখা বিভিন্ন গল্প প্রবন্ধ বাতিল করার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন এইসব লেখকরা এনসিটিবি থেকে যে অর্থ লোপাট করেছেন তারই একটি হিসাব এনসিটিবিতে অবশ্যই দিতে হবে।
এ সব বিষয়ে গতকাল বুধবার এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রিয়াজুল হাসান নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদককে বলেন, এনসিটিবিতে কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে তার একটি হিসাব বিবরণী আমরা প্রস্তুত করে উপদেষ্টা দফতরে পাঠিয়েছি। তবে বিতর্কিত লেখক যারা ছিলেন তারা কে কোন খাতে কত টাকা এনসিটিবিতে থেকে নিয়েছেন সেটি বের করা একটু দুরূহ কাজ। তবে এ বিষয়েও আমরা কাজ শুরু করেছি। কোনো ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে এনসিটিবির তথা সরকারি অর্থের লোপাট করে থাকেন নিশ্চয়ই তারও একটি তদন্ত হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, আমি এনসিটিবিতে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বিগত দিনে এখানকার আর্থিক অনিয়মের বিষয়াদি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছি। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও চাইছে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত হোক। আমরাও সেইভাবেই আমাদের কাজকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করছি।