কর্মক্ষেত্রে মানুষ জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করে। ফলে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সুস্থ না হলে মানুষের জীবনেও সেই প্রভাব পড়ে। বর্তমান সময়ে কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা, কাজের চাপ, সময়ের সংকট এবং ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, সহযোগিতামূলক কর্মপরিবেশ, কাজের উদ্দেশ্য ও দৃঢ়তা থাকলে কাজের গতি বাড়ে। কিন্তু কর্মীর মধ্যে হতাশা এবং উদ্বেগ থাকলে কর্মক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে কর্মে নিয়োজিতদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ কাজের পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথ্য মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৩ কোটিরও বেশি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের মতো আজ ১০ অক্টোবর দেশে পালিত হচ্ছে—বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২৪। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য, অগ্রাধিকার দেওয়ার সময় এখনই।’ প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য এবং সহায়ক কাজের পরিবেশ গড়ে তোলার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপকে বুঝতে এবং তা মোকাবিলা করার জন্য ব্যবস্থাপকদের প্রশিক্ষণ দরকার। কর্মক্ষেত্রে সুস্থ কর্মপরিবেশ তৈরি করা, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা, পর্যাপ্ত বিরতি ও বিশ্রাম নিশ্চিত করা, অফিস সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার চর্চা করা, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা এবং মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট প্রোগ্রাম চালু করার মাধ্যমে মনের যত্ন নেওয়া যেতে পারে।
দেশে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৮-১৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি জরিপ চালায়। ঐ জরিপ বলছে, দেশে লঘু থেকে গুরুতর মাত্রার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রাপ্তবয়স্ক ১৭ শতাংশ (নারী ১৯ শতাংশ পুরুষ ১৫ শতাংশ)। ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠী ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে সব বয়সীদের মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর (মনোচিকিত্সক, মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী) সংখ্যা ১ হাজারের কম। সমস্যাগ্রস্ত ৯০ শতাংশের বেশি ব্যক্তি চিকিৎসার বাইরে থাকছে।
কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ‘সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট’ (এসএইচআরএম) চলতি বছর একটি গবেষণা চালায়। গবেষকরা ১ হাজার ৪০৫ জন মার্কিন কর্মীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখাতে পান—৪৪ শতাংশ কর্মক্ষেত্রে অস্বস্তি বোধ করছেন। ৪৫ শতাংশ তাদের কাজ থেকে আবেগগত নিঃস্ব বোধ এবং ৫১ শতাংশ কর্মদিবস শেষে শোষিত হয়েছে মনে করেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা না হলে উদ্বেগজনক অর্থনৈতিক খরচ নিয়ে ভাবতে হয়।
আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাউন্সেলর ফাতেমা তাশরিন মিতু বলেন, যারা মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র, রিহ্যাব সেন্টার, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেন তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এজন্য কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারলে কাজের মান বৃদ্ধি পাবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার ইত্তেফাককে বলেন, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথ বিশ্বব্যাপী ১৯৯২ সাল থেকে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে যে নেতিবাচক ধারণা আছে সেটি ভাঙতেই এই দিবস পালন হয়ে থাকে। সুস্থ মন ও সুস্থ দেহের সঙ্গে নির্ধারিত হয় উৎপাদনশীলতা। যে ব্যক্তি মানসিকভাবে ভালো থাকবে সে ততবেশি উৎপাদনশীল থাকতে পারবে। ফলে উৎপাদনশীলতার সঙ্গে মানসিক সুস্থ থাকা প্রয়োজন। আমাদের নানা ধরনের মানসিক সমস্যা থাকে, সেসব উৎপাদনশীলতায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একজন ব্যক্তির মধ্যে যে সম্ভাবনার জায়গাগুলো থাকে, সেই সম্ভাবনার জায়গাগুলো নানাভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যদি মানসিকভাবে কোনো সমস্যা থাকে। কর্মক্ষেত্রের যে পরিবেশ সেই পরিবেশও কিন্তু আমাদের কর্মটা কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয়। একজন ব্যক্তি আট ঘণ্টা কর্মক্ষেত্রে কাটায়, এই আট ঘণ্টা কীভাবে সে কাটায়, সেটি বড় বিষয়। পরিবেশ বলতে বোঝায়—আমাদের কাজের ধরন, কাজের পরিবেশ কীরকম, আমাদের সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের গঠন কীরকম, সে কর্মক্ষেত্রে নিজেকে কতখানি সম্মানিত বোধ করেন, কতখানি তার গ্রহণযোগ্যতা আছে—এসবই তার কর্মের সম্পর্কিত পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। মানসিক স্বাস্থ্য যদি কোনোভাবে হুমকি হয় সেটা একক ফ্যাক্টরের সঙ্গে রিলেটেড না বরং সেটা বলা হয় মালটি ফ্যাক্টরিয়াল।
দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। শনিবার বিএসএমএমইউতে সায়েন্টিফিক সেমিনার এবং আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। বুধবার রাজধানীর শ্যামলীতে ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সভাকক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।