পেশেন্ট জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরেকটা বাচ্চা নেওয়া যাবে? আগে দুইটা সিজার।’
আমি মেশিনের স্ক্রিনে চোখ রেখে বললাম, ‘অবশ্যই যাবে। আপনার যে আগে সিজার আছে সেটা বোঝাও যাচ্ছে না। ১০০% পারফেক্ট সবকিছু।
স্কার (জরায়ুতে অপারেশনের কাটাস্থান) ভালো থাকলে ৪/৫টার বেশি বাচ্চা নিতেও তো কোনো সমস্যা নাই। শুধু প্রত্যেকবার স্কার ফলোআপ করলেই হলো যে ঠিক আছে কি না।
স্রোতের বিপরীতে এই কথাটা বলতে মনের সুবিশাল জোর লাগে। তবে কথা সত্য। সত্য কথা বলতে আজকাল লোকেদের প্রচুর দ্বিধা।
পেশেন্ট বললেন, ‘ম্যাডাম আমার আরও বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছা, সিজারের কারণে সাহস পাই না।’
আমার পর্যবেক্ষণ হলো যে, পেশেন্ট একজন ইসলাম প্রাকটিসিং সচেতন মহিলা। আমি উনাকে বললাম, ‘যেসব মা বাচ্চাকে একজন পারফেক্ট মুসলিম হিসেবে ইসলামিক বুঝ দিয়ে বড় করার সক্ষমতা আছে, তাদের অবশ্যই উচিত বেশি সন্তান নেওয়া। কারণ এখান থেকে প্রডাক্টিভ মুসলিম উম্মাহ তৈরি হবে।’
যাদের ইসলামের বুঝ নাই, জন্ম নেওয়ার পর বাচ্চা পিটপিট করে চেয়ে দেখে ঘরে টিভিতে নাচ-গান-সিনেমা চলছে, একবছর গেলে কোমর দোলাতে শিখে যায় বাচ্চাও। আমি কখনোই মনে করি না এই মুসলিম পরিবার নসীহার উপযুক্ত। অধিক সন্তান নেওয়ায় উৎসাহিত করার প্রয়োজন ও নাই। সমুদ্রের ফেনার সমান সংখ্যক মুসলিম হয়েও মুসলিমরা মার খাবে/খাচ্ছে কারণ তাদের মধ্যে ইসলামি জীবনবোধ নাই।
যে বাবা-মা সন্তানকে শৈশব থেকে আল্লাহর অবাধ্যতা হারামে অভ্যস্ত করবে, তার জন্য সেকুলার চিন্তাভাবনার একটা-দুইটা বাচ্চা হলেও তা-ও বেশি। দুইটা মিসগাইডেড বাচ্চা দুনিয়ায় রেখে গেলে আখিরাতে যে পরিমাণ পস্তাতে হবে, পাঁচটা রেখে গেলে পস্তানি আড়াইগুণ বেশি।
কিন্তু যে মায়ের এতটুকু প্রশস্ত অন্তর আছে যে জন্ম থেকে ভালো-মন্দের মাপকাঠি হবে ইসলাম, বাচ্চাকে হারাম-হালাল কোনটা কী স্পষ্ট করে শেখানোর, একটা ঈমানি ভিত তৈরির বুঝ আল্লাহ যাকে দিয়েছেন, সেই মা অবশ্যই সন্তান নেওয়ার অধিক উপযুক্ত।
সিজারের ভয়, বাচ্চা পালার ভয় তো একজন দ্বীনদার নারীকে কাবু করার কথা নয়!
একদিকে মুসলিম উম্মাহ মার খাচ্ছে, প্রতিদিন সন্তানের লাশ উঁচু করে বুক ফুলিয়ে বলছে—আল্লাহ আপনি আমার উপর খুশি তো?
সেখানে আমরা পাঁচ-সাতটা উমার, আলী, আবু বকর, উসমান, আবু উবাইদা তৈরি করতে পারি না?
কষ্ট তো হবেই? পেটে রাখতে, জন্ম দিতে, একগাদা ছোট ছোট ছানা পুষতে কষ্ট অনেক হবে। কিন্তু এক কষ্টের বিনিময়েই তো জান্নাতের সুসংবাদ। জান্নাতের মত বড় জিনিস বিনা কষ্টে পাওয়া যায়?
একটা বাচ্চাকে পাঁচ/দশ বছর পর্যন্ত মখমলের মধ্যে তুলতুল করে পাললে এই বাচ্চা ৪০ বছরেও বাবুই থেকে যাবে। আর তিন-চারটা বাচ্চা একসাথে পেলে দেখেন, দেড়/দুই বছরের বাচ্চা ছোটজনকে পেটের উপর করে ছেঁচড়ে কোলে তুলে পালবে। তিন বছরের বাচ্চা ছোটটাকে খাবার খাওয়াবে, গোসল করানো শিখে যাবে। মারামারি-ফাটাফাটি করতে করতে এক-একটা পাথরের টুকরার মত শক্ত হতে শিখবে। পাহাড়ের মতো শক্ত দায়িত্বশীল হতে শিখবে।
অনেক সন্তান যে পরিবারে, দেখবেন পাঁচ বছরের বাচ্চার যে ম্যাচ্যুরিটি, একটা সন্তানওয়ালা ঘরে ১৫ বছরের বাচ্চার ওইটুকু ম্যাচ্যুরিটি/স্ট্রেন্থ নাই।
এখন বুঝদার মুসলিম পরিবারগুলো ‘বাচ্চা পালতে কষ্ট’ এই দোহাই দিয়ে ইচ্ছা করে কম বাচ্চা নেয়। এদেরকে বোঝানোর উপায় নাই যে, একটা পালতে যে কষ্ট, তিনটা পালতে তার চেয়ে অনেক কম কষ্ট। পাঁচটা পালতে আরো কম। এটা আমার কথা না,একজন বিধর্মী ভিনদেশি পাঁচ বাচ্চার মায়ের কথা, যিনি পেশায় একজন নার্স।
আমি কথাটার সত্যায়ন করছি।
এখানে জয়েন্ট ফ্যামিলি, সিঙ্গেল ফ্যামিলি কোনো ইস্যুই না। দুইখানেই এক। শুধু সংগ্রামের ধরণ আলাদা।
বুকে জোর থাকলে সবখানেই সব সম্ভব। সংগ্রাম ছাড়া পৃথিবী টিকবে না।
অমুসলিমদের আট-দশটা সন্তানওয়ালা ভিডিও, ভ্লগ দেখে ব্যাপক খুশিতে শেয়ার দেন, কিন্তু নিজের বেলায় এই-সেই দোহাই দিলে ওরা মারবে, মুসলিমরা মার খাবে, এটা তো ঘটবেই। ওরা ওদের পেট থেকে শক্তসমর্থ পাক্কা কাফের বের করে, আপনার পাক্কা মুসলিম বের করতে এত খুঁতখুঁত কেন?
ওদিকে ধ্বংসস্তূপের মাঝ থেকেও আবু উবাইদাহ বের হয়, আমরা তো হাজারগুণ নিরাপদে আছি। ওরা ব্যথানাশক ছাড়াই সিজার করছে, আর আমাদের পেটে রাখতেও এত ভয়! লেবার পেইনের ভয়! বাচ্চা পালার ভয়!
বাচ্চারা তো মায়ের কোল থেকেই দুনিয়া দেখে, দুনিয়া মা যেভাবে শেখায় সেভাবে শেখে।
মায়ের যদি এত দুর্বল বুক হয়,তাহলে
জেতার জন্য স্ট্রং একটা মুসলিম উম্মাহ কই থেকে আসবে?
|| বাচ্চা পালতে ভয়! ||
খাদিজা তাহিরা