- বেশী বেশী দো’য়া করাঃ
বাবা-মা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশী বেশী দো’য়া করবে। পবিত্র কোরানে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে দো’য়া করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দো’য়া করবো তা শিক্ষাও দিয়েছেন । পবিত্র কুরআনে এসেছে,
رَبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا
“হে আমার রব, আপনি তাদের উভয়ের প্রতি রহম করুন, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন”। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৪)
رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡحِسَابُ
“হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতের দিন আমাকে ও আমার পিতা-মাতা এবং সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন”। (সুরা ইবরাহীমঃ ৪১)
এছাড়াও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সৎ ও নেক সন্তানের কর্তব্য ও বৈশিষ্ট্য হলো বাবা মায়ের জন্য দোয়া করা।
আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন,
إِذَا مَاتَ ابنُ آدم انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثٍ: صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ، أو عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ، أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তিনটি আমল ব্যতিত তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায় -১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে”। (সহিহ মুসলিম: ৪৩১০)
- ক্ষমা প্রার্থনা করাঃ
বাবা মার জন্য আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। সন্তান মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা’আলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “মৃত্যুর পর যখন কোন বান্দাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়, তখন সে বলে হে আমার রব! আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কীভাবে এ আমল আসলো ? তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় তুমি এ মর্যাদা পেয়েছ”। (আল-আদাবুল মুফরাদ:৩৬)
এছাড়াও আনাস ইবনে মালিক রাঃ হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে :- “মৃত্যুর পরবর্তীতেও সাত ব্যক্তির প্রতিদান তার কবরে পৌছতে থাকে,তাদের মধ্যে একজন হলো ঐ পিতার সন্তান যে তার পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে”। (সহীহ আল জামী ৩৬০২)
- দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সাদাকায় জারিয়াহ প্রদান করাঃ
বাবা মার মৃত্যুর পর তাদের পক্ষ থেকে সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদীসে এসেছে,
আয়শা (রাঃ) বলেনঃ “জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে এসে বললো; হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃত্যু বরণ করেছেন। তাই কোন অসিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে সাদাকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন ? রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন: “হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন”। (সহীহ মুসলিম: ২৩৭৩০)
তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদাকা জারিয়া বা প্রবাহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা ইত্যাদি।
- বাবা মায়ের ঋণ পরিশোধ, ওসিয়ত এবং ওয়াদা পূর্ণ করাঃ
বাবা-মার কোন ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধের ব্যবস্হ্যা করা সন্তানদের উপর বিশেষভাবে কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঋণ পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।
আবু হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন,
نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهِ حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ
“মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়, যতক্ষণ না তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। (সুনান ইবনে মাজাহ: ২৪১৩)
ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয়।
হাদীসে আরো এসেছে:-“যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না”। (সুনানে আন-নাসায়ী ৭/৩১৪)
মা-বাবা শরীয়ত সম্মত কোন ওসিয়াত করে গেলে তা পূর্ণ করাও সন্তানদের উপর দায়িত্ব। কেননা পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ১১ ও ১২ নং আয়াতে মৃত ব্যাক্তির সম্পদ বন্টনের পূর্বে তার ওসিয়ত পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে;-
وَأَوۡفُواْ بِٱلۡعَهۡدِۖ إِنَّ ٱلۡعَهۡدَ كَانَ مَسُۡٔولٗ
“আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে”। [সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৪]
- বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ পালনঃ
বাবা ও মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং ইহাতে তারা উপকৃত হবে।
ইবনে আববাস (রা:) হতে বর্ণিত: “জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে আগমণ করে বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সঃ), আমার মা হজ্জ করার মা’নত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায করতে পারি? রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেন, “তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ করে নাও। তোমার কি মনে করো, যদি তোমার মায়ের উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী”। (সহীহ বুখারী: ১৮৫২)
তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ্জ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ্জ-উমরাহ করতে হবে।
- বাবা-মায়ের আত্নীয়দের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা এবং বন্ধুদের সম্মান করাঃ
বাবা-মায়ের আত্নীয়দের সাথে সু-সম্পর্ক রাখা এবং তাদের বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া,তাদের জন্য হাদিয়া বা উপটেৌকন নিয়ে যাওয়া সন্তানের কর্তব্য।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার (পিতার) ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে”। (সহীহ ইবনে হিববান: ৪৩২)
মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর আমলও আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আয়শা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: “রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখনই কোন বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজা (রাঃ) বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও”। (সহীহ মুসলিম: ৬৪৩১)
তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন:
“ إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ ”
“পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ”। (সহীহ মুসলিম: ৬৪০৭)
- বাবা মায়ের কবর যিয়ারত করাঃ
সন্তান তার মা-বাবার কবর যিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম,অতপর মুহাম্মাদের মায়ের কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা কবর যিযারাত করতে পারো, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয়”। (সুনানে আত- তিরমিজী : ১০৫৪)
এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কবর যিয়ারতের জন্য কোন দিন বা ক্ষণকে নির্দিষ্ট করা যাবে না।
- বাবা মায়ের নেক আমলগুলোকে অব্যাহত রেখে অসৎ কাজ সমূহ বন্ধ করার ব্যবস্হ্যা করাঃ
বাবা-মা যেসব নেক কাজ সমূহ অর্থাৎ মসজিদ, মাদরাসা তৈরী করা, সাদাকা জারিয়া সমূহ এবং জনকল্যাণ মূলক কাজ সমূহ করে গিয়েছেন সেগুলো যেন অব্যাহত তাকে সন্তান হিসাবে তার ব্যবস্থা করা। কেননা, এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদীস শরীফে এসেছে:-
” إِنَّ الدَّالَّ عَلَى الْخَيْرِ كَفَاعِلِهِ “
“ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সওয়াব পাবে”। (সুনান আত-তিরমিজী: ২৬৭০)
আর পক্ষান্তরে মন্দ কাজের ব্যপারে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন:- “যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোন কমতি হবে না”। (সহীহ মুসলিম: ৬৯৮০)
তাই প্রত্যেক সন্তানের উচিত বাবা-মা জীবিত থাকা কালীন কোন মন্দ করে থাকলে সেটার জন্য অন্যের নিকট ক্ষমা চেয়ে নেওয়া, এবং সেই মন্দ কাজকে স্হায়ী ভাবে বন্ধ করার ব্যবস্হ্যা করা।
মহান অল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে বাবা ও মায়ের জন্য উপরোক্ত আমলগুলো করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
কে.এম.আব্দুল্লাহ আল-জায়েদ মাদানী
ইমাম ও খতিব: মাসজিদ বিলাল (রাঃ)
রামপুরা,বনশ্রী,ঢাকা।
মাশাআল্লাহ মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই উপকারী পোস্ট
মুসলিমউম্মাহ ডট নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক মুবারকবাদ। সম্পাদক