সেদিন অফিসে এক কলিগ বেশ মন খারাপ করেই তার পরিবারের কথা বললেন। সংসারে ঝামেলা যাচ্ছে, স্ত্রীর সাথে নিত্য-নৈমিত্তিক ঝগড়া-ঝাটি হচ্ছে। সংসারের টানাপোড়েনের দরুন ঘরে ঢুকলেই অস্থির অস্থির লাগছে তার। কাজে মন বসে না, ইবাদাতে মনোযোগ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাকে বললাম, ‘এক কাজ করুন ভাই, ফযরের ওয়াক্ত হবার ঠিক বিশ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠার চেষ্টা করুন। দুই রাক’আত তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করে, বাকিটা সময় জায়নামাজে বসে অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করুন। ইস্তিগফার কেবল যে গুনাহ মাফ করায় তা নয়, জীবনের অনেক সমস্যার, অনেক ঝুট-ঝামেলার সমাধান ইস্তিগফারের মাধ্যমে হয়ে যায়। ইস্তিগফারের দূর্দান্ত এক শক্তি আছে। আর, এই শক্তির প্রয়োগ রাতের শেষ অংশে করা গেলে দেখবেন জীবনের অন্ধকারগুলো কিভাবে ঝলমলে আলোয় পরিণত হয়ে যায়’।
এক বন্ধুর কাছে বেশ অনেকদিন হলো কিছু টাকা পাই। কয়েকদিন আগে তাকে বললাম যদি সম্ভব হয় টাকাগুলো দেওয়ার জন্যে। সে বেশ আপসোস নিয়েই বললো, ‘এখন যদি আমাকে কেটে দুই ভাগও করিস, তারপরও একটা টাকাও আমি তোকে দিতে পারবো না। বউ আর বাচ্চাকে অনেকদিন হয় তার বাপের বাড়ি রেখে এসেছি। যে কাজেই হাত দিচ্ছি, মনে হচ্ছে সব ছাঁই হয়ে যাচ্ছে। জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা জন্মে যাচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে এর পরের ধাপে আমাকে আত্মহত্যাই করতে হবে’।
বেশ ধমকের সুরেই তাকে বললাম, ‘গাধা!’
তাকেও উপরের আমলটার ব্যাপারে বললাম। শেষ রাতে, ফযরের ওয়াক্ত হবার বিশ বা ত্রিশ মিনিট আগে উঠে দুই রাক’আত তাহাজ্জুদ পড়ে, অধিক পরিমাণে ইস্তিগফার করে আল্লাহর কাছে রিযিকের জন্য ফরিয়াদ করতে বললাম। কেনো জানি না, আজকাল কেউ সমস্যার কথা শোনালেই তাকে এই কাজটা করার জন্যে বলতে ইচ্ছে করে।
সংসারে অশান্তি, স্ত্রীর সাথে মন কষাকষি, ব্যবসায়ে লাগাতর ক্ষতি কিংবা চাকুরির জন্যে মাথাকুটে মরা- এসবগুলো কেনো হয় আমাদের জীবনে? কারণ বারাকাহ নেই। জীবন থেকে বারাকাহ কমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আমরা মনে করি বারাকাহ মানে কেবল কাড়ি কাড়ি টাকা। বিপুল সম্পদের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। বাড়ি হওয়া, গাড়ি হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু বারাকাহ সবসময় সম্পদের সাথেই সম্পর্কিত নয়। জীবনের সুখ, অন্তরের প্রশান্তি আর সন্তুষ্টির সাথেও বারাকাহ সম্পর্কিত।
অনেক টাকা-পয়সার মালিক, কিন্তু ঘরের স্ত্রীর সাথে দা-কুমড়ো সম্পর্ক। টাকা আছে কিন্তু জীবনে বারাকাহ নেই।
অফিসের মস্তবড় বস যার কথায় অফিসের সকলে উঠে আর বসে। কিন্তু সেই বসের একমাত্র ছেলে দিন-রাত মেয়ে আর মদ নিয়ে পড়ে থাকে। কারণ কি? সম্পদ আছে কিন্তু জীবনে বারাকাহ নেই।
আবার, ওই অফিসের এক কেরানী, যে পাঁচটায় অফিস শেষ করে যাওয়ার পথে স্ত্রীর জন্যে পাঁচ টাকা দামের একটা গোলাপ ফুল নিয়ে ফেরে এবং তা পেয়ে স্ত্রী বিলকুল খুশি হয়ে যায়। কারণ কি? জীবনে হয়তো সম্পদ নেই, কিন্তু ভরপুর বারাকাহ আছে।
আমাদের জীবনে আসলে সমস্যা নামে না, ঝামেলা তৈরি হয় না, যা হয় তা হলো বারাকাহর ঘাটতি। বারাকাহ কমে গেলে আমরা নানাবিধ শূন্যতা টের পেতে থাকি। সেগুলোকে কখনো সমস্যা, কখনো ঝামেলা আর কখনো-বা পরীক্ষা বলে অবহিত করি।
জীবনের এই সমস্ত সমস্যা, ঝুট-ঝামেলার সমাধান সহজেই সম্ভব যদি আমরা জীবন থেকে বারাকাহ কমে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে পারি। এরজন্যে আমাদের একবার নিজের জীবনের দিকে গভীরভাবে তাকাতে হবে। এমন কোন পাপ কি নিয়মিত করে যাচ্ছি কি না যা জীবন থেকে বারাকাহ নষ্ট করে দিচ্ছে? এমন কোন অবাধ্যতা আমার দ্বারা হচ্ছে কি না যা আমার জীবন থেকে বারাকাহ কমিয়ে দিচ্ছে? মানুষের হকের ব্যাপারে, বাবা-মায়ের ব্যাপারে, স্ত্রী-সন্তানের হকের ব্যাপারে আমি অতোখানি সচেতন কি না যতোখানি না হলে জীবন থেকে বারাকাহ লুপ্ত হয়?
বারাকাহর ‘মিসিং পয়েন্ট’ খোঁজার জন্যে নিরন্তর চেষ্টা চালাতে হবে, এবং সাথে সঙ্গী বানাতে হবে অবিরত ইস্তিগফারকে। আর, ইস্তিগফারের জন্য ফযরের ঠিক আগ মুহূর্তে, দুই রাক’আত তাহাজ্জুদ সালাত আদায়ের পরের সময়টুকুর চাইতে উত্তম সময় আর হয় না। কারণ, তখন আসমানের মালিক একেবারে নিকটতম আসমানে এসে অপেক্ষায় থাকেন আপনার আকুতি-ভরা দুয়া শ্রবণের জন্যে।