করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাবে জনশক্তি প্রেরণ খাত সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়ে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি বছর কমপক্ষে ৬-৭ লাখ শ্রমিক বৈধভাবে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, কুয়েতসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতেন। কিন্তু এ বছরের চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। উল্টো শ্রমবান্ধব দেশগুলো থেকেই দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার কর্মীকে।
আবার যারা নিঃস্ব হয়ে এবং কারাভোগ শেষে ফিরেছেন তাদের মধ্যে থেকেও অনেকেই ঘোরাঘুরি করার পরও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে কাক্সিক্ষত সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু যে বিদেশগামী অথবা ফেরত আসা শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা কিন্তু নয়, এসব শ্রমিকদের বৈধভাবে বিদেশে পাঠিয়ে যারা রেমিটেন্স প্রবাহ চাঙ্গা রাখছিলেন, সেই বায়রার সহ¯্রাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও তাদের কর্মচারীদেরও এখন কাজকর্ম না থাকায় তাদের অনেকেরই পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এজেন্সি মালিকরা অপেক্ষায় রয়েছেন, আবার কবে তাদের সেই সুদিন ফিরবে। চাঙ্গা হবে জনশক্তি প্রেরণ খাত।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থাণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ বিভাগ থেকে সোমবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তৈরি করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সৌদি আরব, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইরাক, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, রাশিয়া, জাপান লন্ডন, লিবিয়াসহ ২৯টিরও বেশি দেশ থেকে ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন শ্রমিক ফেরত এসেছেন। এরমধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৪ জন। নারী ফিরেছেন ৩৯ হাজার ২৭৪ জন। ফেরত আসা শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফিরেছেন সৌদি আরব থেকে। এই দেশটি থেকেই ৭৯ হাজার ৩৭১ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ৭৯ হাজার ১২৮ জনকে ফেরত পাঠিয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর ৩৩ হাজার ৮১ জনকে দেশে পাঠিয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে কাতার। কর্মহীন হয়ে কিংবা চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে অধিকাংশ কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন বলে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। অনেকে আবার ফিরেছেন কারাভোগ করে আউট পাসের মাধ্যমে অথবা ভিসার মেয়াদ না থাকায় সাধারণ ক্ষমায়।
গতকাল জনশক্তি প্রেরণের সাথে সম্পৃক্ত একজন মালিক নয়া দিগন্তকে হতাশার সুরে বলেন, ম্যানপাওয়ার ব্যবসাই তো এখন আর নেই। তাই আমাদের এখন কাজকর্মও নেই। কোনো দেশের ভিসা-ই নাই জানিয়ে তিনি বলেন, শুধু সৌদি আরব থেকে টুকটাক ভিসা আসা ছাড়া আর কোনো দেশ থেকেই তো ভিসা আসছে না। এরমধ্যে মালদ্বীপ, কাতার, কুয়েত ও দুবাই উল্লেখযোগ্য।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ফেরত যারা আসছেন তারা প্রণোদনার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন। শুনেছি মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত আসা শ্রমিকদের মধ্যে যারা লোন নিতে গেছেন তাদের কাছে ব্যাংক গ্যারান্টি চাওয়া হয়েছে। তারা এমনিতেই দেশে ফিরে নিঃস্ব, আবার গ্যারান্টার পাবেন কোথায়? তবে লোন নিতে চাইলে তো অবশ্যই গ্যারান্টার লাগবে। তবে অনুদান দিলে কোনো কিছু লাগবে না। এসব প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহিনের সাথে গত রাতে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি।
গতকাল বায়রার একজন দায়িত্বশীল নেতা নয়া দিগন্তকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে কয়েকদিন পরপর কত শ্রমিক দেশে ফিরেছেন তার পরিসংখ্যান দেশ ভেদে তৈরি করে জানানো হচ্ছে। কিন্তু দেশে ফেরাদের মধ্যে কতজন শ্রমিককে মন্ত্রণালয় থেকে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে সেটি কিন্তু পরিসংখ্যানের কোথাও উল্লেখ নেই। এটি অবশ্যই থাকা উচিত ছিল বলে তিনি মনে করেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে জনশক্তি প্রেরণের সাথে সম্পৃক্ত বায়রার সিনিয়র সভাপতি ও গ্রিনল্যান্ড ওভারসিসের স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী আব্দুল হাই নয়া দিগন্তকে বলেন, বিদেশ থেকে করোনার সময় যে ৩ লাখ ২৬ হাজার শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছে এরমধ্যে আমার একজন শ্রমিকও নাই। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি নেসমা, আল মারাইসহ বড় বড় কোম্পানিতে আমরা যারা শ্রমিক পাঠিয়েছিলাম তাদের কারো কর্মী-ই কিন্তু ফেরত আসেনি। তবে যারা সৌদিসহ অন্যান্য দেশের হায় হায় কোম্পানিতে অথবা ইনডিভিজুয়াল ভিসায় (একক) লোক পাঠিয়েছেন তাদের শ্রমিকরাই কিন্তু বেশি ফিরে এসেছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার লোক ফেরত আসেনি বরং বিমান চলাচল আবার চালু হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে নতুন করে আমার প্রতিষ্ঠানের নামে ভিসা ইস্যু হয়েছে। তবে মালয়েশিয়া, কাতার দুবাইসহ অন্যান্য দেশে এখনো শ্রমিক যাওয়া বন্ধ রয়েছে।