সেই পুরান ঢাকা, বসতবাড়ির নিচে রাসায়নিকের সেই গুদাম-দোকান। ফের ভয়াবহ আগুন, ফের ঝরল প্রাণ, পোড়া মানুষের বোবা কান্নায় ভারী হলো হাসপাতালের বিছানা। এবার আরমানিটোলার মানুষ দেখল বিভীষিকার এক ভোর। গতকাল শুক্রবার ভোরে ওই এলাকায় বহুতল একটি আবাসিক ভবনের নিচে রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুনে প্রাণ হারিয়েছেন কলেজছাত্রীসহ চারজন। পুরান ঢাকা দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৫ জন। তাদের মধ্যে অন্তত চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
আরমানিটোলার আরমানিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত ‘হাজী মুসা ম্যানশন’ নামের আটতলা ওই ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের মার্কেট। সেখানে রয়েছে অন্তত ২০টি দোকান ও গুদাম। ভবনের দ্বিতীয় তলায় রাসায়নিকের গুদাম। ওপরের তলাগুলোর আবাসিক ফ্ল্যাটে লোকজনের বসবাস। ভবনটির মালিক হাজী মুসার ছেলে মোশতাক আহমেদ চিশতী ধানমন্ডি এলাকায় থাকেন। তবে সেখানে তার রাসায়নিক বিক্রির একটি দোকান ছিল। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, শুক্রবার ভোর সোয়া ৩টার দিকে ওই ভবনে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট টানা চেষ্টা চালিয়ে সকাল ৬টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এর আগে জানালার গ্রিল কেটে কাপড় বেয়ে, মই বেয়ে কয়েকশ বাসিন্দা ভবন থেকে নিচে নেমে আসেন।
এর আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুনে ১২৪ জন নিহত হন। ওই ঘটনার পর পুরান ঢাকার বসতবাড়িগুলো থেকে রাসায়নিকের ভয়ংকর গুদাম সরানোর দাবি জোরালো হয়। তখন এসব গুদাম সরাতে তোড়জোড়ও শুরু হয়েছিল। এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদামের আগুনে ৭১ জন প্রাণ হারান। ফের পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের অবৈধ গুদাম-দোকান উচ্ছেদে তোড়জোড় শুরু হলেও তা থেমে যায়। এর দুই বছর পর আবার সেই রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুন কেড়ে নিল প্রাণ।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, আরমানিটোলার ভবনটির বেশিরভাগ বাসিন্দা আতঙ্কে ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ধোঁয়ার কারণে অনেকে ফ্ল্যাটের ভেতরে আটকা পড়েন। আগুন নেভানোর পর কক্ষগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়। ওই সময়ে ভবনের চারতলার একটি ফ্ল্যাটে সুমাইয়া আক্তার নামে এক কলেজছাত্রীর লাশ পাওয়া যায়। দগ্ধ ও আহত অবস্থায় ওই ফ্ল্যাট থেকে সুমাইয়ার মা, বাবা, ভাই-বোন ও ভগ্নিপতিকে উদ্ধার করা হয়। নিচতলায় পাওয়া যায় ভবনটির তত্ত্বাবধায়ক মো. রাসেলের লাশ। সকালে সপ্তম তলার চিলেকোঠার একটি কক্ষ থেকে অলিউল্লাহ ও কবির হোসেন নামে আরও দু’জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবনটির তিন দিক খোলা এবং একদিকে নির্মাণাধীন একটি ভবন থাকায় আটকেপড়াদের দ্রুত উদ্ধার করা গেছে। অনেকে স্থানীয়দের সহায়তায় নিরাপদে বের হতে পেরেছেন। তা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারত।
অগ্নিকাণ্ডের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), বিস্ম্ফোরকদ্রব্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ঢাকা জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরা ভবনটি পরিদর্শন করেছেন। আগুন লাগার কারণ তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে ২৫ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন আশিকুজ্জামান খান (৩৩) ও তার স্ত্রী ইসরাত জাহান মুনা (৩০), শ্বশুর ইব্রাহীম সরকার (৬০), শাশুড়ি সুফিয়া বেগম (৫০), শ্যালক জুনায়েদ সরকার (২০)। তাদের মধ্যে আশিকুজ্জামান ও তার স্ত্রী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন। এ ছাড়া ভর্তি রয়েছেন মো. মোস্তফা (৪০), ইউনুস মোল্লা (৬০), সাকিব হোসেন (৩০), সাখাওয়াত হোসেন (২৭), সাফায়েত হোসেন (৩৫), চাসমেরা বেগম (৩৩), দেলোয়ার হোসেন (৫৮), আয়শা (২), খোরশেদ আলম (৫০), লায়লা বেগম (৫৫), মোহাম্মদ ফারুক (৫৫), মেহেরুন্নেসা (৫০), মিলি আক্তার (২২), পাবিহা (২৬), মো. আকাশ (২২) ও আসমা সিদ্দিকা (৪৫)।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন জানান, চিকিৎসাধীন চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। বাকি ১৬ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দিলেও সবারই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। একজনকে চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক তন্ময় প্রকাশ ঘোষ জানান, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দু’জনের শরীরে পোড়া ক্ষত থাকলেও বাকি সবার শ্বাসনালি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই চিকিৎসা শেষ না হলে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না। আশিকুজ্জামান খান, তার স্ত্রী ইসরাত জাহান মুনা এবং সাফায়েত হোসেন ও খোরশেদ আলম আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে আগুনের ভয়াবহতা :ভবনটির পঞ্চম তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী হেনা ইসলামসহ পরিবারে সদস্যরা। ঘটনার বিবরণ দিয়ে হেনা ইসলাম বলেন, ভোর ৩টার দিকে সেহরি খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে ওঠেন। তখনই ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন, রান্নাবান্নার কারণে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরই ভবনের তত্ত্বাবধায়ক রাসেল হঠাৎ দরজার বেল টিপে ডাকাডাকি করেন। তিনি দরজা খুলেই পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন দেখেন। সিঁড়িতে আগুনের ফুলকি। কিছু বুঝতে না পেরে ফের দরজা বন্ধ করে দিয়ে পশ্চিম পাশের বারান্দায় গিয়ে প্রতিবেশীদের কাছে বাঁচার আকুতি জানান। ততক্ষণে তিনি ও তার স্বামী মিলে বারান্দার গ্রিল ভেঙে ফেলেন। এরপর পাশের বাসার মালিক মই দিলে তা বেয়ে শিশু-নাতনিসহ পরিবারের ছয়জন নিরাপদে বেরিয়ে আসেন।
গতকাল সকালে হেনা ইসলাম ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময়ও তার চোখেমুখে আতঙ্ক দেখা গেছে। তিনি বলছিলেন, রাসেল সবাইকে বাঁচার জন্য সচেতন করল। সকালে জানতে পারেন, সেই রাসেলের লাশ নিচে পাওয়া গেছে।
তৃতীয় তলার এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা জেসমিন আক্তার বলছিলেন, দরজা খুলতেই ধোঁয়ায় সবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। পরে বারান্দার গ্রিল ভেঙে মোটা কাপড় দড়ির মতো করে নামিয়ে সবাই বের হয়েছেন।
আবদুস সালাম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, নতুন জীবন পেয়েছেন। পাশের একটি নির্মাণাধীন ভবন থাকায় কাঠ বেয়ে নামতে পেরেছেন। আগুনের চেয়ে ধোঁয়া বেশি ছিল।
আগুন লাগার খবর পাওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যেই সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা ঘটনাস্থলে যান। সদরঘাট স্টেশন অফিসার মাহমুদুল হাসান জানান, ধোঁয়া দেখে অনেকে আগেই নিরাপদে বের হতে পেরেছেন। তারা গিয়ে আগুন নেভানোর পাশাপাশি দরজা-জানালা ভেঙে আটকে পড়াদের উদ্ধার শুরু করেন। তিনি বলেন, ভবনটির নিচে একটা মৃত্যুকূপ ছিল। সোডিয়াম পার অক্সাইড, অ্যাসিটিক অ্যাসিড, সালফার ডাই অক্সাইড, অ্যামোনিয়াম ডাই অক্সাইড পাওয়া গেছে দোকান ও গুদামগুলোতে। এগুলো খুব ভয়ঙ্কর রাসায়নিক। যেভাবে মজুদ করার নিয়ম, সেভাবে রাখা হয়নি।
রাসায়নিক থেকে আগুনের সূত্রপাত :তদন্ত শেষে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার আগে আগুন লাগার কারণ বলতে চাচ্ছে না ফায়ার সার্ভিস। তবে পুলিশের বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শক করে জানিয়েছে, তারা ধারণা করছে, রাসায়নিকের গুদাম থেকে আগুন লাগতে পারে।
গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত উপকমিশনার কামরুল ইসলাম জানান, আবাসিক ভবনের নিচতলায় দোকানে রাসায়নিক পণ্য বিক্রি হতো। রাসায়নিক পণ্য বিক্রির কোনো দোকানের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে তারা মনে করছেন।
ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের উপ-পরিচালক (উন্নয়ন) নূর হাসান জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় তাকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কাজ শেষ হবে। এরপর আগুন লাগার কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছিল না রাসায়নিকের মার্কেটে :মুসা ম্যানশনে রাসায়নিকের গুদামের জন্য ফায়ার সার্ভিস কোনো লাইসেন্স দেয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক দেবাশীষ বর্ধন। তিনি জানান, সেখানে থাকা দোকানগুলো অবৈধ। তবে সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছিল কিনা তা তারা জানেন না।
এদিকে গতকাল বিকেল থেকে ঢাকা জেলা প্রশাসন ওই ভবনের গুদাম ও দোকানগুলো থেকে রাসায়নিক সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছে।
বংশাল থানার ওসি শাহীন ফকির জানান, ওই ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। ভবন মালিক, দোকান ও গুদাম মালিকরা আসামি হবেন। ক্ষতিগ্রস্ত কেউ মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।