সাধারণ মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে জর্জরিত, ঠিক সেই সময় দেশে আধালিটারের বোতলজাত পানির দাম একধাক্কায় পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়। ১৫ টাকা থেকে গায়ের মূল্য করা হয় ২০ টাকা। অথচ কম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের কাছে দাম রাখে ১০ টাকার আশপাশে। অর্থাৎ খুচরা বিক্রেতার ১০ টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা হয় ১০ টাকা।
ভোক্তাদের চাপে ফেলে খুচরা বিক্রেতাদের এমন মুনাফার সুযোগ করে দেয় বোতলজাত করা কম্পানিগুলো।
জানা গেছে, দাম বাড়ানোর পেছনে রয়েছে অ্যাকুয়াফিনা ও কিনলে ব্র্যান্ডের এক অনৈতিক বিপণননীতি। দেশের পানির বাজার দখলে নিতে তারা খুচরা বিক্রেতাদের প্রায় দিগুণ লাভের সুযোগ করে দেয়। যেসব কম্পানি এই লাভের সুযোগ দেয় না, তাদের পানি রাখেন না খুচরা বিক্রেতারা।
এতেই অন্য কম্পানিগুলো প্রায় বাধ্য হয়ে ৫০০ মিলিলিটারের বোতলে গায়ের দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করে। সঙ্গে অন্যান্য বোতলের পানির দামও বাড়ে যথানিয়মে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন বলছে, সবার আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথম পানির দাম বাড়িয়েছে অ্যাকুয়াফিনা ব্র্যান্ড। এরপর বাড়ায় কিনলে।
আরও পড়ুন
এতে ২০২০-২১ অর্থবছরে কিনলে ব্র্যান্ডের মার্কেট শেয়ার ছিল ২.৫১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩.৬ শতাংশে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোতলের গায়ের মূল্য বাড়ানোর পর মার্কেট শেয়ার বেড়ে দাঁড়ায় ৪.১৬ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে অ্যাকুয়াফিনা ব্র্যান্ডের পানির মার্কেট শেয়ার ছিল ১৩.৩৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে হয় ১৩.৮৪ শতাংশ। আর দাম বাড়ানোর পর ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৬.৮৮ শতাংশে।
২০২৩ সালের ৬ মার্চ পানির অস্বাভাবিক দাম ও মুনাফা নিয়ে ‘পানির আধালিটার বোতল ২০ টাকা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু গণমাধ্যম পানির দাম নিয়ে খবর প্রকাশ করে। এতে নড়েচড়ে বসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। শুরু করে অনুসন্ধান। এরপর তারা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাত কম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে।
কোন কম্পানির কত শতাংশ বাজার দখলে
জানা গেছে, দেশে পানি বোতলজাত করার অনুমতি দেয় বিএসটিআই। সরকারি এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে পানি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী ২৩২টি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৪.১৭ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল ‘ফ্রেশ’ পানির।
একইভাবে ১৭.৭৬ শতাংশ শেয়ার নিয়ে দ্বিতীয় ছিল ‘প্রাণ’ পানি, ১৬.৮৮ শতাংশ শেয়ার নিয়ে তৃতীয় ছিল ‘অ্যাকুয়াফিনা’, ১৬.৪৪ শতাংশ মার্কেট শেয়ার নিয়ে চতুর্থ ‘মাম’, ১৩.৮১ শতাংশ শেয়ার নিয়ে পঞ্চম ‘স্পা’, ৪.১৬ শতাংশ শেয়ার নিয়ে ষষ্ঠ অবস্থানে ছিল ‘কিনলে’ পানি, আর সপ্তম স্থানে ছিল ‘জীবন’ ব্র্যান্ডের পানি, এই কম্পানির মার্কেট শেয়ার ৪ শতাংশ। মূলত এই সাতটি কম্পানিই দেশের ৯৭ শতাংশ বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বা মার্কেট শেয়ার রয়েছে।
আরও পড়ুন
খুচরা বাজারে কোন কম্পানির পানির দাম কত
রাজধানীর গুলশান, বনানী, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকার অন্তত ১৫টি মুদি দোকান, রেস্টুরেন্ট ও চায়ের দোকানে সরেজমিনে খোঁজ নেন এই প্রতিবেদক। খুচরা বিক্রেতারা জানান, সাধারণ এক কেস ধরে বিক্রি করা হয় বোতলজাত পানি। এক কেসে ২৪টি বোতল থাকে। প্রতি কেস একেক কম্পানির দাম একেক রকম। খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি কেনেন।
এতে মাম পানি এক কেসের দাম ধরা হয় ২৭০ টাকা। ফ্রেশ পানির এক কেস ২৫০ টাকা, কিনলে ২৫০ টাকা, অ্যাকুয়াফিনার এক কেস ২৪০ টাকা, স্পা ২৩৫ টাকা, প্রাণ ২০০ টাকা, সিটি গ্রুপের ১২ পিসের কেস জীবন পানি ১১০ টাকা। অর্থাৎ খুচরা বিক্রেতাদের মাম পানির আধালিটার কিনতে হয় ১১ টাকা ২৫ পয়সায়। একইভাবে ফ্রেশ ও কিনলে ১০ টাকা ৪১ পয়সা, অ্যাকুয়াফিনা ১০ টাকা, স্পা ৯ টাকা ৭৯ পয়সা।
অথচ খুচরা বিক্রির জন্য বোতলের গায়ে দাম দেওয়া আছে ২০ টাকা। প্রাণ পানি কিনতে খরচ হয় ৮ টাকা ৩৩ পয়সা এবং জীবন ৯ টাকা ১৬ পয়সায়। কিন্তু এ দুই কম্পানি দাম বাড়ানোর পর এখন আবার কমিয়েছে। এখন বোতলের গায়ের মূল্য দেওয়া আছে ১৫ টাকা। পানির বাজার সম্পর্কে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, একই ইন্ডাস্ট্রিতে একটা প্রতিষ্ঠান যদি এটা করে (দাম বাড়ায়), বাকিদেরও ফলো করতে হয়।
আরও পড়ুন
প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলা
মামলার বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মামলাটি এখন শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। কমিশনে আগের চেয়ারপারসনের পদত্যাগ করার কারণে আমরা শুনানিতে পিছিয়ে যাই। সামনে শুনানি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’