বিদ্যুৎ নেই। রাতে চারদিকে ভুতুড়ে অন্ধকার। দিনের বেলাতেই আলোর দেখা মেলে কম। গহীন জঙ্গল। দীর্ঘপথ হেঁটে যেতে হয় লোকালয়ে। কাজ করতে হয় স্বল্প মজুরিতে। থাকতে হয় পালিয়ে পালিয়ে। সারাক্ষণ পুলিশ আতঙ্ক। এমন মানবেতর জীবনযাপন করছেন অবৈধভাবে ব্রুনাইয়ে থাকা বাংলাদেশিরা। খেয়ে না খেয়ে থাকছেন অনেকে। কেউ কেউ ভিক্ষাও করছেন। দুর্বিষহ তাদের জীবনযাপন। বিদেশের কারাগারে কাটছে অনেকের দিন-রাত। দুর্বিষহ এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে কেউ কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। বেশির ভাগেরই পাসপোর্ট, ভিসা নেই। অনেকে ভুয়া ভিসা নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে। অনেকের ভিসার মেয়াদ চলে গেছে। বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই গহীন জঙ্গলে পরিত্যক্ত ভাঙা ছাপড়া ঘরে, কোথাও কাঠ-টিন দিয়ে মাথাগোঁজার মতো কোনো রকম একটা ব্যবস্থা করেছেন। জঙ্গলের অজগর থেকে শুরু করে বিষাক্ত নানা সাপ, জীব-জন্তুর ভয় উপেক্ষা করেই সেখানে বাস করছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-২০১৯ সালে দেশ থেকে ৩৪ হাজার কর্মী ব্রুনাইয়ে যান। তাদের মধ্যে বৈধপথে গিয়েছেন মাত্র আট হাজার। অবৈধপথে যাওয়া ২৬ হাজারের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি কর্মহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। এরমধ্যেই প্রায়ই অভিযান চালায় পুলিশ। গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করে ব্রুনাই ইমিগ্রেশন পুলিশ। এরমধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশি। পরবর্তীতে স্পেশাল পাস দিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার শর্তে ছেড়ে দেয়া হয় তাদের। দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে থানায় হাজিরা দিতে হয় তাদের। স্পেশাল পাসপ্রাপ্তরা সাধারণত কোথাও কাজ পান না। স্পেশাল পাস পাওয়ার পরও বেশির ভাগই দেশে না ফিরে পালিয়ে বেড়ান। আতঙ্কে লোকালয় ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। জঙ্গল পরিদর্শনের সুবিধাতে সেখানে কিছু ঘর রয়েছে। এসব ঘরে কেউ থাকে না। পরিত্যক্ত এসব ভাঙা ঘরে এবং নিজেরা টিন-কাঠ দিয়ে আবাস তৈরি করে সেখানে থাকছেন তারা। ব্রুনাইয়ের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, তাদের সংখ্যা হবে সহস্রাধিক। দালালদের খপ্পরে পড়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
নামকাওয়াস্তে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে ব্রুনাইয়ের স্থানীয় দালালদের যোগসাজশে লেবার ডিপার্টমেন্ট থেকে ভিসা নেয় দালালরা। ভালো চাকরি, বেতনের স্বপ্ন দেখিয়ে শ্রমিকদের সেখানে নেয়া হলেও প্রকৃতপক্ষে এসব কোম্পানির কোনো প্রকল্প বা কর্মসংস্থান নেই। এসব কোম্পানি মালয়েশিয়ায় ভিসা দালালি ও মানব পাচারের উদ্দেশ্যে উৎকোচের বিনিময়ে ভিসা পেয়ে থাকে। ব্রুনাইয়ে পৌঁছার পরই শ্রমিকদের পাসপোর্ট নিয়ে যায় দালালরা। ব্রুনাইয়ের শ্রমিকদের ভিসার মেয়াদ থাকে সাধারণত এক মাস। এক মাস পর এর মেয়াদ বাড়াতে আবেদন করতে হয়। ব্রুনাইয়ে পৌঁছার পর কাজ না পেয়ে এমনিতেই দুর্বিষহ জীবনযাপন করেন শ্রমিকরা। তার মধ্যে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে গেলে দালাল দাবি করে ১শ’ ডলার। তখন বাধ্য হয়ে পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াই মানবেতর জীবনের দিকে পা বাড়ান শ্রমিকরা। হতাশাগ্রস্ত এসব শ্রমিকদের অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১১ বাংলাদেশি। এরমধ্যে দালালদের প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন দুইজন। অনেকের মৃত্যু হচ্ছে চিকিৎসা না পেয়ে। অবৈধভাবে বসবাস করার কারণে ঠিকমতো চিকিৎসাও নিতে পারছেন না তারা। ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সেখানকার হাসপাতালে পড়ে আছে আট বাংলাদেশির লাশ। মিথ্যা তথ্য দিয়ে, লোভনীয় স্বপ্ন দেখিয়ে ব্রুনাইয়ে আনা হয় বাংলাদেশি শ্রমিকদের। তাদেরই একজন পাবনা জেলার আতাইকুলার লক্ষ্মীপুরের রফিকুল ইসলাম। ব্রুনাই স্কোয়ার এসডিএস বিএইচডি কোম্পানিতে কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন তিনি। ঢাকার দৈনিক বাংলা মোড়ের মঞ্জিল ট্র্যাভেলসে চার লাখ টাকা গ্রহণ করে দালালরা। পরে রফিকুল ইসলাম গত বছর ব্রুনাই পৌঁছালেও কোনো কাজ জুটেনি। সেখানে পৌঁছার দু’দিন পর রফিকুলের পাসপোর্ট কেড়ে নেয় দালাল আব্দুর রহিম। রহিমের সহযোগী কামরুল ইসলাম ব্রুনাইয়ের লাভি নামক স্থানে জঙ্গলের ভেতরে একটি ছাপড়া ঘরে আটকে রাখে রফিকুলকে। প্রতিবাদ করলেই নির্যাতন করা হয়। না খাইয়ে রাখা হয়। দিনের পর দিন নির্যাতন করে কৃষিক্ষেতে কাজ করতে বাধ্য করে রফিকুলকে। দেশে ফিরে প্রতারিতদের অনেকেই দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অনেকে গ্রেপ্তার হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে প্রায় ২০ মামলার আসামি মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরের পিরোজপুর গ্রামের মেহেদি হাসান বিজন। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ব্রুনাইয়ের দালাল চক্রের মূলহোতা হচ্ছে এই বিজন। ২০১৬ সালে গাড়িচালক হিসেবে ব্রুনাই যায় বিজন। মাত্র তিন বছরেই প্রায় ১৫টি কোম্পানির মালিক বনে যান এই গাড়ি চালক। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে মেহেদি হাসান বিজনের পাসপোর্ট বাতিল করে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করে দেশে পাঠানো হয়। ব্রুনাইয়ে তার ঘনিষ্ঠরা এখন তার হয়ে কাজ করছে। মূলত দালাল চক্রের প্রতারণার কারণেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন বাংলাদেশিরা। সূত্রমতে, সম্প্রতি অসহায় বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়িয়েছে দূতাবাস। এই করোনার সময়ে প্রায় অর্ধশত কর্মহীন বাংলাদেশিকে কাজ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশিদের এই সময়ে গ্রেপ্তার না করতে ব্রুনাইয়ের সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়েছে দূতাবাসের তরফ থেকে। ব্রনাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত নাহিদা রহমান সুমনা বলেন, বাংলাদেশিদের যেকোনো সমস্যায় বৈধ সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। অভিযোগ অনুসারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে দেশ থেকে যারা ব্রুনাইয়ে যান তাদের সচেতনভাবে জেনেবুঝে যেতে অনুরোধ করেছেন তিনি।