ছিলেন পানবাজারের শ্রমিক। পরে হয়ে ওঠেন শ্রমিকনেতা নামধারী দুর্ধর্ষ চাঁদাবাজ। চাঁদাবাজির টাকা দিয়েই নির্বাচিত হয়েছিলেন টেকনাফ সদর উপজেলার সদস্য। তারপর কৌশলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে নির্বাচিত হন টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সময়ের পরিক্রমায় নিজেকে নানা রূপে আবির্ভূত করে হয়ে ওঠেন আলোচিত-সমালোচিত ‘ইয়াবা ডন’ আবদুর রহমান বদির বিশ্বস্ত সহযোগী। বদির সঙ্গে মিলে মাদক সাম্রাজ্য বাড়িয়ে হয়ে ওঠেন অঢেল সম্পদের মালিক। ব্যক্তিটি হলেন কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফের জাফর আহমদ, যিনি একসময় জাফর চেয়ারম্যান নামেই বেশি পরিচিতি পান।
আরো পড়ুন
ওয়ান-ইলেভেনের সময় আবদুর রহমান বদির হাত ধরে বিএনপির রাজনীতি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন জাফর আহমদ। আর এই জাফর পরিবারের হাত ধরেই টেকনাফ তথা কক্সবাজার জনপদে ইয়াবা সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলে জনরব রয়েছে।
২০১৮ সালে সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় মাদক কারবারি ও গডফাদার হিসেবে দুই নম্বরে নাম ছিল জাফর আহমদের। সেই তালিকায় এক নম্বর নামটি ছিল কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক আলোচিত-সমালোচিত সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির।
অথচ টানা ছয় বছর অধরাই ছিলেন এই জাফর আহমদ।
আরো পড়ুন
অবশেষে গত ৩১ অক্টোবর মধ্যরাতে রাজধানীর বাসাবো এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন সদ্য অপসারিত টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদ। টেকনাফের একটি হত্যাচেষ্টা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। র্যাব-১৫ তাঁকে গ্রেপ্তার করে কক্সবাজারে নিয়ে আসে।
জাফর আহমদের মাদক সাম্রাজ্যের সহযোগী তাঁর চার ছেলেও।তাঁদের মধ্যে মাদকের তালিকায় নাম ওঠা মোস্তাক আহমদ কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ। ইলিয়াছ নামের এক ছেলে কারাগারে। আর বাবা জাফর আহমদ হয়ে ওঠেন ইয়াবা ডন আবদুর রহমান বদির ক্যাশিয়ার!
আরো পড়ুন
সূত্র মতে, ইয়াবা কারবারে আসার আগে জাফর আহমদ বন বিভাগের গাছ লুট করতেন। তখন তিনি ছিলেন টেকনাফ পৌর বিএনপির সভাপতি। ২০০৮ সালে ‘পল্টি মেরে’ তাঁর পুরো পরিবার যোগ দেয় আওয়ামী লীগে। তাঁর ছেলে শাজাহান মিয়া টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা শ্রমিক লীগের নেতা। অন্য দুই ছেলে দিদার ও ইলিয়াসের বিরুদ্ধেও রয়েছে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ।
র্যাব ও স্থানীয়দের মতে, উখিয়া-টেকনাফের সংসদ সদস্য থাকাকালে আবদুর রহমান বদি নিজের নির্বাচনী এলাকা টেকনাফকে পরিণত করেছিলেন মাদক, চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যার স্বর্গরাজ্যে। আর সেই স্বর্গরাজ্য কার্যক্রমের ‘বিশ্বস্ত সহচর’ ছিলেন জাফর আহমদ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এক হাজার ২৭৫ জন মাদক কারবারিকে তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে আবদুর রহমান বদি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর জাফর আহমদকে ইয়াবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আরো পড়ুন
হাসিনা সরকারের পতন হলে ১৯ আগস্ট দুই মাসের মাথায় উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় ২০১৯ সালের দিকে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি ও জাফর আহমদকে ঢাকায় র্যাব সদর দপ্তরে ডেকে এনে ইয়াবা কারবারের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এরপর এলাকায় ফিরে বদি ও জাফর ইয়াবাবিরোধী বক্তব্যও দিয়েছিলেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয়ের দিন ৫ আগস্ট রাতে টেকনাফে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে জাফর আহমদ এবং তাঁর তিন ছেলের নেতৃত্বে টেকনাফের আলো শপিং কমপ্লেক্স, হোটেল নাফ কুইন ও আব্দুল্লাহ ব্রাদার্স ফিলিং স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এসব ঘটনায় পৃথকভাবে তিনটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, যার সব কটিতেই জাফর আহমদকে আসামি করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, জাফর আহমদের বিরুদ্ধে মাদক, অস্ত্র, দুদকের মামলাসহ অন্তত এক ডজন মামলা রয়েছে। কয়েকটি মামলায় তিনি জামিনে থাকলেও বেশির ভাগ মামলাই বিচারাধীন।