খুবই গুরুগম্ভীর বিষয়, সরকারের বিবেচনার জোর দাবী রাখে।
সম্প্রতি সরকার করোনা উত্তর, (যদিও দ্বিতীয় ধাপ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে) সিনেমাহল খোলার প্রস্তাব করেছে, হয়ত এইসময়ে খোলা হয়েও গেছে এই সর্তে যে করোনার কারনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখন নৈতিক যে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে জাগে ইসলামী মাহফিলগুলোতে কেন এখনও সরকারের সুদৃষ্টি পড়ে নাই, মাহফিল বন্ধ রাখার আইন এখনও বলবত আছে। আশা করি সরকার মহোদয় অনতিবিলম্বে মাহফিল, হালাকা করার জন্য প্রয়োজনীয় আদেশ দান করবেন।
এই লেখার আরও একটি উদ্দেশ্য আছে, নৈতিকতার প্রশ্নে কাকে বেশী প্রাধান্য দিব, ইসলামী মাহফিল কে না সিনেমাহল কে? দুই জায়গায়ই মানুষের সমাগম হয়, আত্মিক সুখ ভোগ করে। মাহফিল বলতে বুঝায়, ওয়াজ, নসিহত, বয়ান, খুতবা, তাফসির, হালাকার স্থান। এই ভোগের মধ্যে বিরাট একটা ফারাক আছে, একটাতে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অন্যটাতে আল্লাহ্র গজব। এই গজবের সাথে আছে আর্থিক অপব্যয়, বিশৃঙ্খল মানসিকতা ও জঘন্য অপরাধগুলির সমষ্টি অন্যটাতে আছে দুনিয়াতেও রিজিক, উন্নতি আর পরকালে সরাসরি জান্নাত।
কোরআন কারিমের ৭৭টি নামের এক নাম হলো ‘ওয়াজ’ বা উপদেশ। মহান আল্লাহ হলেন প্রথম ওয়ায়েজ বা ওয়াজকারী। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন দ্বিতীয় ওয়ায়েজ—এই সূত্রে নবী করিম (সা.)-এর উত্তরাধিকারীরা ওয়ায়েজিন।
এবার দেখুন কোন সমাবেশকে বেছে নিবেন?
মাহফিলের উপকারগুলি যা সরাসরি আল্লাহ্ ও তার রাসুলের (সঃ) এর উক্তি থেকে এসেছে।
১) অনুসরণ করো তাঁদের যারা তোমাদের কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিকের সওয়াল করেন না, আর তাঁরা হচ্ছেন সৎপথে চালিত, (সুরা ইয়াসিন, আয়াত ২১)
২) ‘তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।’ [সুরা তাওবা আয়াত ১২২]
৩) হে ঈমানদারগণ, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ মান্য কর, যখন তোমাদের সে কাজের প্রতি আহবান করা হয়, যাতে রয়েছে তোমাদের জীবন। জেনে রেখো, আল্লাহ মানুষের এবং তার অন্তরের মাঝে বিরাজ করছেন। বস্তুতঃ তোমরা সবাই তাঁরই নিকট সমবেত হবে। (সুরা আনফাল, আয়াত ২৪)
৪) নসিহত অর্থাৎ সদুপদেশ বা কল্যাণ কামনাই দ্বীন বা ধর্মের মূল কথা।’ (বুখারি)।
‘
৫) হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা জান্নাতের উদ্যানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে, তখন তাতে চড়ে নিবে। তারা (সাহাবায়ে কেরাম) বললেন, জান্নাতের উদ্যান কি? তিনি বললেন: জিকিরের (কুরআন ও হাদিসের আলোচনার) মজলিসসমূহ।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি)
৬) হজরত আবু হুরায়রা ও আবু সাঈদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকটে উপস্থিত ছিলেন, তিনি বলেন: “যখন কোনো জাতি বসে আল্লাহর জিকির করে তখন ফেরেশতাগণ তাদেরকে ঘিরে ধরেন এবং তাদেরকে রহমতের ডানা দ্বারা ঢেকে নেন। আর তখন তাদের উপর প্রশান্তি নাজিল হয় এবং আল্লাহ তাআলা তাদের কথা যাঁরা তাঁর নিকটে আছেন তাদের (ফেরেশতাদের) কাছে উল্লেখ করেন।’ (মুসলিম)
৭) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, আমাদের মধ্যকার সর্বোত্তম মজলিস কার? তিনি বলেন, যে তার বর্ণনার মাধ্যমে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার বক্তব্যের মাধ্যমে তোমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, যার আমলের দ্বারা তোমাদের আখেরাতের স্মরণ বৃদ্ধিপায়। (মুসনাদে আবু ই’য়ালা, হাদিস নং ২৪০৮)
সামাজিক উপকারিতা
ক) নৈতিকতার মানদণ্ডে উন্নত, ফলে সার্বিক ভাবে উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়।
খ) বৈষয়িক বিষয়ে মিতব্যয়ী, ফলে অপব্যয়কারী হয় না। সর্বোপরি
গ) নিরবিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
সিনেমার উপকারিতাঃ-
ক) সাময়িক সুখ ভোগ করে ও ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে মূল্যবান সময়ের অপচয় করে থাকে।
খ) এই সুখের বিনিময়ে অন্যের (সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির) পকেট ভারী করা।
গ) সাময়িক ভাবে উম্মাতাল হয়।
ঘ) সরকারের খাজাঞ্চীকে মোটাতাজা করা।
সিনেমার অপকারীতা- কুরআন ও হাদিসের আলোকে
১) আর লোকদের মধ্যে কেউ-কেউ আছে যে খোশগল্পের বেচা-কেনা করে যেন সে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে কোনো জ্ঞান না রেখেই, আর যেন সে এগুলোকে ঠাট্টাবিদ্রূপ আকারে গ্রহণ করে। এরাই — এদেরই জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (সুরা লুকমান, আয়াত ৬)
২) আর যারা অসার ক্রিয়াকলাপ থেকে নিজেরাই সরে থাকে (সুরা মুমিনুন, আয়াত ৩)
৩) ‘আর তোমাদের অর্থ-সম্পদ অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে না। জেনে রেখো, যারা অপব্যয় করে তারা শয়তানের ভাই, আর শয়তান নিজ প্রতিপালকের ঘোর অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬-২৭)
৪) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কোন কওমের লোকেরা কোন সমাবেশে একত্রিত হওয়ার পর চলে যাবার সময় তাতে আল্লাহকে স্মরণ না করেই চলে গেলে তা যেন গাধার শবদেহ। তা তাদের জন্য পরিতাপের কারণ হবে।
৫) ইমরান ইবনু হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃঅচিরেই এই উম্মতের উপর ভূমিধস, চেহারা বিকৃতি এবং পাথর বর্ষণস্বরূপ আযাব ঘনিয়ে আসবে। জনৈক মুসলিম ব্যক্তি প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কখন এসব আযাব সংঘটিত হবে? তিনি বললেনঃ যখন (গায়ক) গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র বিস্তৃতি লাভ করবে এবং মদ্যপানের সয়লাব হবে। হাসান, সহীহাহ (১৬০৪)।
অনুরূপভাবে ইমাম তাবারিয়া বাইহাকী থেকে বর্ণিত আছে যে কেয়ামতের পূর্বে এই উম্মতের মধ্যে ব্যাপক ভাবে গায়ক গায়িকার উদ্ভব হবে। সকল প্রকার গান ও বাদ্যযন্ত্র কে হালাল মনে করা হবে। মদকে হালাল বা অন্য নামে নামকরণ করে পান করা হবে।
সিনেমার সামাজিক অপকারিতা
ক) ধীরলয়ে চরিত্রের অভাবনীয় অধঃপতন ঘটে। ফলে এক পর্যায়ে সে যা ইচ্ছা করে তাই করতে পিছপা হয় না।
খ) পরিবার, সমাজ ও দেশের পতন তরান্বিত করে। সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
গ) কষ্টার্জিত মুদ্রা সবপক্ষ থেকে বিলীন হয়ে যায়।
ঘ) সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি লোকগুলো অসামাজিক স্থানে টাকা নষ্ট করে।
উম্) দেশে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা দেখা দেয়।
এই কৃষ্টি থেকে উত্তরণের উপায়
১) আমাদেরকে ইসলামিক কৃষ্টি ও সভ্যতায় ফিরে যেতে হবে।
২) ইসলামের যথাযোগ্য শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে।
৩) বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪) সিনেমাহল গুলোকে রূপান্তর করে কাজে লাগাতে হবে।
৫) সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির লোকবলকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত করতে হবে।
৬) এই খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি
৭) মানুষকে আল্লাহ্ ভীতির বিষয়টা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।
বর্তমান পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রায় তিনের দুই অংশ লোক এখন আর সিনেমামুখী নয়। প্রায় সবার ঘরে টেলিভিশন নামক যন্ত্রটা সিনেমার ৯০% অংশ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় সিনেমাই প্রধান। প্রতিটা স্থানীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এখন লোকসানের মুখে আছে। নায়ক নায়িকাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রকোপ অধিক হারে দেখা যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির অচলাবস্থার কারনে এই পেশার লোকগুলো অপরাধ জগতের সাথে হাত মিলাতে বাধ্য হচ্ছে। এই খাতের বেশীরভাগ পুঁজির যোগান আসছে অপরাধ জগত, কালো টাকা, অপ্রদর্শিত আয় বা অনিয়ম করে ব্যাংক ঋণ থেকে প্রাপ্ত। সার্বিক ভাবে পরিবার, সমাজ ও দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আল্লাহ্র যে এর উপর লানত্ বা অসন্তুষ্টি তা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ হয়ে গেছে।
অতএব হে মুসলমানগণ, ঈমানদার হউন, মুমিন হউন, আল্লাহ্ তা’আলা সুরা মুমিনুনে বলেছেন, মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, (আয়াত ১)।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে আলোচ্য আলোচনার ভিত্তিতে অনর্থক কথা কাজ এবং দৃশ্য থেকে দূরে থাকার তৌফিক দান করুক।
সরকার কিছু ভুল করলে জনগণের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে ভুলটা স্বরন করে দেওয়া। আর সেটি যদি হয় ইসলাম কে কেন্দ্র করে তাহলে অবশ্যই মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে সেটার বিরুদ্ধে কথা বলা বা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া।
আর এ কাজটি প্রতিনিয়ত যে পত্রিকাগুলি করে যাচ্ছেন বা লিখছেন তার মধ্যে অন্যতম একটি পত্রিকা হল -” muslimummah.news ”
উক্ত পত্রিকাটির বিশ্বব্যাপী বিস্তার কামনা করছি আল্লাহ কবুল করুন।