|| মুয়ালাত ও তাওয়াল্লির মধ্যকার পার্থক্য ||
- Tanvir Ahmed হাফিজাহুল্লাহ্
মুসলিম মাত্রই কাফিরদের সাথে ‘মুয়ালাত’ আর ‘তাওয়াল্লি’র মধ্যকার পার্থক্যও জানা থাকা ওয়াজিব। কেননা এটি ঈমানের সাথে সম্পর্কিত। অথচ দাওয়াহর জোশে আজকে অধিকাংশই দ্বীনের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো ভুলে যান।
.
শাইখ আব্দুল্লাহ বিন হুমাইদ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “নিজের ব্যাপারে আন্তরিক প্রতিটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হলো তাওয়াল্লি এবং মুয়ালাতের ব্যাপারে উলামায়ে কিরামগণ কীরূপ পার্থক্য করেছেন, তা জেনে নেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, মুয়ালাত হচ্ছে কাফিরদের সাথে নমনিয়তার সাথে কথা বলা, তাদের সাথে হাসি-ঠাট্টা করা, তাদের ময়লা-আবর্জনা সাফ করা এবং অনুরূপ সেসব জিনিস, যা সাধারণভাবে করা হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তি যদি কাফিরদের ধর্মকে খোলাখুলি অস্বীকার করেও থাকে, তবুও সে গুনাহে কাবায়েরে (কবিরাহ গুনাহ) লিপ্ত এবং সে খুবই বড় বিপদে আছে।
আর তাওয়াল্লি হচ্ছে, ওদেরকে (কাফিরদের) সম্মান করা বা তাদের চাটুকারিতা করা বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করা, তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, তাদের প্রকাশ্যে ত্যাগ না করা; আর এ সবকিছুই হচ্ছে রিদ্দাহ [1]। আর যে এগুলো করে, তার উপর মুরতাদের বিধান আরোপ করা আবশ্যক, যা কিতাব (কুর’আনুল কারিম), সুন্নাহ এবং উম্মাহর ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত।” [2]
.
শাইখ নাসির বিন হামাদ আল-ফাহাদ (ফাকাল্লহু আসরহ) বলেন,
.
“কাফিরদের সাথে মেলামেশা তিন প্রকারের হতে পারে:
প্রথম প্রকার: এমন মেলামেশা, যা কুফরে লিপ্ত করে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়। আর কিছু উলামায়ে কিরাম এই প্রকারকে ‘তাওয়াল্লি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুতরাং, যে ধরনের মেলামেশা কুফর এবং রিদ্দাহ হিসেবে প্রমাণিত, সেগুলো এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। আর এটি হচ্ছে কাফিরদের ধর্মকে ভালোবাসার মতো অথবা (ইসলামের উপর) তাদের বিজয়ী রূপে দেখার আকাঙ্ক্ষা করা ইত্যাদির মতো। আমাদের বর্তমান সমস্যাটি এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত, আর সেটা হলো মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের সহযোগিতা (মুসাহারাহ) করা।
.
দ্বিতীয় প্রকার: হারাম মেলামেশা, যেগুলো কুফর নয়। আর কিছু উলামায়ে এই প্রকারকে ‘মুয়ালাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অতএব, যেসব কাজ হারাম হিসেবে প্রমাণিত কিন্তু কুফর নয়, সেগুলো এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, তাদের (কাফিরদের) যেকোনো সভায় সামনে বসতে দেওয়া, তাদের প্রথমে অভিবাদন জানানো, তাদের প্রতি কোনোরূপ ভালোবাসা প্রদর্শন – যা তাওয়াল্লির পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায় না ইত্যাদি। (এগুলো হারাম এবং এসবে লিপ্ত হওয়াও কাবায়ের তথা কবিরাহ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত)
.
তৃতীয় প্রকার: জায়িয মেলামেশা। এটি মুয়ালাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। জায়িয হিসেবে প্রমাণিত সকল কাজ এই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে যেসব কাফির যুদ্ধ করে না, তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করা, তাদের প্রতি ইনসাফ করা [3] এবং কাফির আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা [4] ইত্যাদি।
শাইখ নাসির আল ফাহাদের (ফাকাল্লহু আসরহ) বক্তব্য সমাপ্ত। [5]
.
আর এই শেষ প্রকারের মেলামেশার অনেক ধরন রয়েছে, যেমনটা ফিকহের বইসমূহে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন কাফিরদের সাথে লেনদেন কিংবা বেচাকেনা – যা শরীয়াহর দৃষ্টিতে জায়িজ, সে ব্যাপারে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করা হল।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “সাধারণ বিধান হচ্ছে, যা কিতাব ও সুন্নাহতে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া অন্য কোনো প্রকারের ব্যবসায়ী লেনদেন হারাম নয় । ঠিক তেমনি, যতটুকু কিতাব ও সুন্নাহতে আদেশ করা হয়েছে, তার বাইরে কোনো প্রকারের ইবাদাত নেই।
সুতরাং, দ্বীন হচ্ছে তা-ই, যা আল্লাহ করার আদেশ দিয়েছেন এবং যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, অর্থাৎ হারাম। আর এর বিপরীত হলো আল্লাহ্ যা হারাম করেননি, তা হারাম করার মাধ্যমে শির্ক করা এবং আল্লাহর অনুমোদনহীন কোনো শরীয়াহ প্রণয়ন করা।” [6]
.
তিনি আরো বলেন, “মুসলিমদের জন্য কাফিরদের সম্পত্তি ও ঘোড়া ক্রয় করা জায়িয; যেমনটা বেদুইন, কুর্দি, তুর্কিদের থেকেও ক্রয় করাও জায়িয। আর ওদের কাছে খাদ্য, বস্ত্র এবং তদ্রূপ জিনিস বিক্রয় করাও জায়িয। কিন্তু সেসব বস্তু তাদের কাছে বিক্রয় করা হারাম, যা তাদের হারাম কাজে লিপ্ত হতে সহায়তা করবে। যেমনঃ ওদের কাছে ঘোড়া বা অস্ত্র বিক্রয় করা, যার ফলে ওরা আমাদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে এবং বিভিন্ন হারামে লিপ্ত হতে পারে। আল্লাহ আদেশ করেন, “সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যকে সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা। ” [7] [8]
.
তিনি আরো বলেন, “কাফিরদের কাছে কোনো অস্ত্র বিক্রয় করা জায়িয নেই, যা দিয়ে সে একজন মুসলিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।” [9]
.
হাফিজ ইবনু হাজার আসক্বলানী (রহিমাহুল্লাহ) সালাফগণের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “কাফিরদের সাথে লেনদেন করা জায়িয; শুধু তাদের কাছে এমন কোনো কিছু বিক্রয় ব্যতীত, যা দিয়ে তারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতে পারে।” [10]
.
তিনি আরও বলেন, “কাফিরদের সাথে লেনদেন করার কিছু শর্ত রয়েছে।
(১) লেনদেন এমন জিনিসের হতে হবে, যা হালাল। (২) জিনিসগুলো এমন হতে হবে যা, কাফিররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। (৩) লেনদেন এমন কিছুর হওয়া যাবে না, যা একজন মুসলিমকে হেয় প্রতিপন্ন করে।” [11]
.
হাফিয ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন, “কাফিরদের সাথে সাক্ষাৎ করা শুধুমাত্র তখনই বিধিবদ্ধ, যখন আশা করা যায় যে সে ইসলাম কবুল করতে চায়।” [12] অতঃপর আরও বলেন, এটা স্পষ্ট যে, কুফফারদের সাথে সাক্ষাৎ করাটা নিয়াত এবং তা থেকে কীরূপ উপকার পাওয়া যাবে, তার উপর নির্ভরশীল।”
.
অতএব, এটি সর্বাবস্থায় হারাম নয়, আবার সর্বাবস্থায় জায়িযও নয়, বরং তা অবস্থার উপর নির্ভরশীল।
ফিকহের কিতাবাদি ঘাটলে এই ব্যাপারগুলোর আরও উদাহরণ পাওয়া যায়, ইমামদের আরও বক্তব্য পাওয়া যায়। তবে লক্ষণীয় ইমামগণ এই ব্যাপারগুলো উল্লেখ করেছেন জায়িজ নাজায়িজ প্রসঙ্গে। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে খুবই প্রয়োজন ছাড়া ক্রয় বিক্রয়ের মতো জায়িজ ক্ষেত্রগুলোতেও মুসলিমদের উপর কাফিরদেরকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) ইমাম আহমাদ (রহিমাহুল্লাহ) থেকে এই ব্যাপারে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন,
.
আবু মূসা আল-আশআরি (রদিআল্লাহু আনহু) বলেন, আমি উমার (রদিআল্লাহু আনহু)-কে বললাম, ‘আমার একজন লেখক আছে, যে কিনা খ্রিস্টান।”
.
উমার (রাঃ) বললেন, “তোমার কী হয়েছে? তোমার উপর আল্লাহর অভিশাপ! তুমি কি শুনো নি আল্লাহ বলেছেন, “ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা ইহুদি আর খ্রিস্টানদেরকে আউলিয়া হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের আউলিয়া। তোমাদের মধ্যে যেই ওদের সাথে তাওয়াল্লি করবে, সে হয়ে যাবে ওদেরই অন্তর্ভুক্ত।” [৫ : ৫১]
.
তাহলে (এই কাজে) কেন তুমি একজন মুসলিমকে নিচ্ছো না?” অতঃপর আবু মুসা (রদিআল্লাহু আনহু) বললেন, “হে আমিরুল মুমিনিন! তাকে শুধু আমার দরকার কিছু লিখালিখির জন্য। আর তার দ্বীন তো তার কাছে (সেটি আমার বিষয় না)।”
.
তখন উমার (রদিআল্লাহু আনহু) বললেন, ‘আল্লাহ ওদেরকে অপমানিত করেছেন, তাই আমিও ওদের সম্মান করি না। আমি ওদের মর্যাদা দিই না, কেননা আল্লাহই তাদের নীচ করেছেন। আমি ওদেরকে আমার কাছে আসতে দিই না, কারণ আল্লাহই ওদেরকে আমাদের থেকে সর্বাধিক দূরে সরিয়ে দিয়েছেন।” [13]
.
আশা করা যায়, আল্লাহর ইচ্ছায় তাওয়াল্লি এবং মুয়ালাত নিয়ে একটা পর্যায়ের ধারণা দেওয়া সম্ভব হয়েছে।
.
.
টিকা ও রেফারেন্স :
.
[1] দ্বীন থেকে বের করে দেয় এমন আমল। সমার্থকঃ ইরতিদাদ, নাওয়াকিদুল ইসলাম, কুফরে আকবার (অনেকক্ষেত্রে কেবল কুফর বলেই বোঝানো হয়)
[2] আদ-দুরারুস সানিয়্যাহ, ১৫ / ৪৭৯
[3] এটি আসলে একটি ফারজিয়্যাত। কারণ আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের সাথে শত্রুতার কারণে কখনও আদল (ন্যায়বিচার) পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর; এটাই তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে পরিজ্ঞাত।” [সূরাহ মায়িদাহ, ৮]
[4] যাদের অভিভাবক কাফির, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা বলেন,
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ
“পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই; তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে” [সূরা লুকমান, ১৫]
[5] আত-তিবইয়ান ফি কুফরি মান আ’আন আল-আম্রিকান
[6] আস-সিয়াসাহ আশ-শারিয়াহ, ১৫৫
[7] সূরাহ মায়িদাহ, ২
[8] আল মাসাইলুল মারদিনিয়াহ, ১৩২-১৩৩
[9] ইকতিদাহ আস-সিরতল মুসতাকিম, ২৯৯
[10] ফাতহুল বারি, ৪ / ৪১০
[11] ফাতহুল বারি, ৪ / ৪৮২
[12] ফাতহুল বারি, ১০ / ১১৯
[13] ইকতিদাহ আস-সিরতল মুসতাকিম, ৫০; ইবনু তাইমিয়্যাহ (রহিমাহুল্লাহ) এই ঘটনাটিকে সহিহ বলেছেন। আর ইমাম বাইহাকি (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর সুনানুল কুবরা (১০ / ১২৭)–তেও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।