ব্রিটিশ চিকিৎসাকেন্দ্রে নারীদের বিতর্কিত ‘কুমারীত্ব পরীক্ষা’ করা হচ্ছে বলে বিবিসির এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ নারীর শরীরের ভেতর এ ধরনের পরীক্ষা চালানোকে মানবাধিকার লংঘন বলে মনে করছে এবং এই পরীক্ষা ব্যবস্থা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, এই পরীক্ষা পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক এবং একজন মেয়ে কুমারী কি না, এই পরীক্ষা তা নিশ্চিত করতে পারে না। এই পরীক্ষা নির্যাতনের একটা হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করা হতে পারে। এতে যোনিপথ পরীক্ষা করে দেখা হয়, নারীর হাইমেন বা যোনিমুখের সূক্ষ্ম পর্দা অক্ষত আছে কি না।
বিবিসির ১০০ নারী ও নিউজবিট বিভাগের সাংবাদিকরা তাদের অনুসন্ধানে জেনেছেন, ব্রিটেনে বেশ কিছু বেসরকারি ক্লিনিক এই ব্যবসায় জড়িত। তারা ‘কুমারীত্ব পুনরুদ্ধার’ করার বিজ্ঞাপন দেয় এবং যোগাযোগ করায় তারা জানায়, তথাকথিত কুমারীত্ব পরীক্ষা করার জন্য খরচ পড়বে ১৫০ থেকে ৩০০ পাউন্ডের মধ্যে।
বিবিসি এ ধরনের ২১টি ক্লিনিক চিহ্ণিত করে। এর মধ্যে ১৬টি ক্লিনিকের সাথে বিবিসির সাংবাদিকরা যোগাযোগ করতে সক্ষম হন, যাদের মধ্যে সাতটি ক্লিনিক নিশ্চিত করে যে তারা ‘কুমারীত্ব পরীক্ষা’ করে থাকে। বাকিগুলো কী করে, তা তারা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেনি।
তবে প্রত্যেকটি চিকিৎসা কেন্দ্র বলেছে, তারা ছিঁড়ে যাওয়া হাইমেন ঠিক করে দেবার জন্য অস্ত্রোপচার করবে, যার জন্য খরচ লাগবে ১,৫০০ থেকে ৩,০০০ পাউন্ডের মধ্যে। ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এনএইচএস ইংল্যান্ডের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে হাইমেন-মেরামতের জন্য অস্ত্রোপচার হয়েছে ৬৯টি।
নিউজবিট একজন নারীর সাথে কথা বলেছে, যিনি তার সমস্যা নিয়ে কর্ম নির্ভানা নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। এই সংস্থা তথাকথিত পারিবারিক সম্মান রক্ষার কারণে এবং জোরপূর্বক বিয়ে দেবার জন্য নির্যাতনের শিকার নারীদের সাহায্য করে থাকে।
“আমার বাবা-মায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা ছিল খুবই মানসিকভাবে নির্যাতনের একটা সম্পর্ক। তারা চেয়েছেন আমি তাদের ঠিক করে দেয়া ছেলেকে বিয়ে করব,” তিনি বলেন।
‘পালানোই আমার একমাত্র উপায়’
“একদিন আমাদের সম্প্রদায়ের একজন বয়স্ক বক্তি আমাকে বন্ধুদের সাথে দেখতে পান এবং আমার মাকে গিয়ে বলেন যে এদের মধ্যে একটি ছেলে আমার বয়ফ্রেন্ড। আমাদের পরিচিত মহলে এ নিয়ে নানা কানাঘুষা এবং গুজব চলতে থাকে।”
তার বাবামা হুমকি দেন তার কুমারীত্ব পরীক্ষা করানো হবে।”আমার বাবা-মা এবং তারা যে ছেলেটির সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেই ছেলের পরিবার বলে বিয়ের আগে আমাকে কুমারীত্ব পরীক্ষা করাতে হবে।”
“আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমি তখন বুঝতে পারিনি- সেটার মানে কী। ওরা কী করতে চাইছেন। আমার মনে হল পালানোই আমার একমাত্র উপায়- আমি সেটাই করলাম।”
কর্ম নির্ভানা সংঠনের পক্ষে সাহায্য লাইন পরিচালনা করেন প্রিয়া মানোতা।
“এ নিয়ে উদ্বিগ্ন মেয়েরা আমাদের ফোন করেছেন। কারোর ক্ষেত্রে তাদের কোন পুরুষ-বন্ধুর সাথে সম্পর্ক আছে, যেকথা পরিবার জেনে ফেলেছে, অথবা কারো ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্কের দিক দিয়ে সে আর কুমারী নেই। পরিবার হয়ত কুমারীত্ব পরীক্ষা করানোর জন্য চাপ দিচ্ছে এবং কী ফল আসতে পারে সেটা নিয়ে তার চিন্তিত।
“কারো যদি প্রেম থাকে, বা কেউ নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে চায় অথবা কারো হয়ত কোন ছেলের সাথে যৌন সম্পর্ক আছে, সেসব ক্ষেত্রে পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য বা জোর করে বিয়ে দেবার ব্যাপারে এই পরীক্ষা একটা নির্যাতনের হাতিয়ার। আমাদের সংস্থার কাজের সূত্রে আমরা জানি অনেক ঘটনার কীভাবে চরম দুঃখজনক পরিণতি হয়েছে- যেখানে মেয়েদের হত্যা করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার মেয়েদের ত্যাজ্য করে দিয়েছে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, বিশ্বে অন্তত বিশটি দেশে মেয়েদের কুমারীত্ব পরীক্ষার চল রয়েছে। হু বলছে, কোন মেয়ে যৌন সম্পর্ক করেছে কি না তা এই পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করা যায় এমন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। এর কারণ হাইমেন নামের এই সূক্ষ্ম ঝিল্লির মত পর্দা নানা কারণে ছিঁড়ে যেতে পারে। ট্যাম্পন ব্যবহারে ছিঁড়তে পারে আবার খেলাধুলা করতে গিয়ে ছিঁড়তে পারে।
গত বছর আমেরিকার র্যাপ সঙ্গীত শিল্পী স্বীকার করেছিলেন তিনি তার মেয়েকে প্রতি বছর কুমারীত্ব পরীক্ষা করান দেখতে যে তার হাইমেন অটুট আছে কি না। তার ওই স্বীকারোক্তিতে তুমুল বিতর্ক ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
টু্ইজারস (চিমটা) আর ভুয়া রক্ত
বিবিসির অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে যে হাইমেন মেরামতের সামগ্রী অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ৫০ পাউন্ড মূল্যে। দাবি করা হচ্ছে এতে ছেঁড়া হাইমেন ঠিক করা যাবে এবং কুমারীত্ব ফেরানো যাবে।
এধরনের একটি কিট জার্মানিতে বিক্রি করা হয়েছে ১০৪ পাউন্ডে। এর মধ্যে রয়েছে যোনিপথ আঁটোসাঁটো করার উপযোগী ৬০ মিলিলিটার পরিমাণ জেল, প্লাস্টিকের সন্না, রক্ত ভরা একটি ক্যাপসুল এবং তিনটি স্যাশে যার মধ্যে দেখে মনে হচ্ছে ভুয়া রক্ত ভরা আছে। কিন্তু এসব সামগ্রী কীভাবে ব্যবহার করতে হবে কিটে সে বিষয়ে কোন নির্দেশাবলী দেয়া নেই।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আশফাক খান নিয়মিতভাবে কুমারীত্ব পরীক্ষার এবং ছেঁড়া হাইমেন মেরামত করার অনুরোধ পান রোগীদের কাছ থেকে।
“এটা যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ কেন করা হয়নি সেটা আমার বোধগম্য নয়। এটা অবৈধ ঘোষণা করা উচিত,” তিনি বলছেন।
“প্রথমত কোন মেয়ের হাইমেনের অংশবিশেষ যদি না থাকে বা সেটা যদি অক্ষত না থাকে তার মানে সেই মেয়ের কুমারীত্ব নষ্ট হয়ে গেছে এটা পুরো ভুল। এই পর্দা অনেক কারণে ছিঁড়ে যেতে পারে। এখন আমি যদি বলি ‘হ্যাঁ এটা ছিঁড়ে গেছে, আমি মেরামত করে দিয়েছি’ এবং এই মর্মে আমি একটা সার্টিফিকেট দিই, তার অর্থ হবে আমি ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছি।”
‘মানুষকে শেখাতে হবে’
ড. খান মনে করেন এই প্রথার বিরুদ্ধে আরও বেশি সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। “মেয়েদের খতনার (ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন) বিরুদ্ধে যেভাবে জোরেসোরে কথা বলা হয়েছে ঠিক একইভাবে। মেয়েদের খতনার সমস্যা বিশ্ব নেতারা যেভাবে তুলে ধরেছেন, সেই ভাবে,” নিউজবিটকে বলেন ড. খান।
“আমার মতে এটা আরেকটা অপরাধ। এবং আমরা এখন একটা অপরাধের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করছি যেটা নৈতিকভাবে ভুল।”
এবছরের গোড়ার দিকে মিডল ইস্টার্ন উইমেন অ্যান্ড সোসাইটি অর্গানাইজেশন “কুমারীত্ব পরীক্ষা” বন্ধের দাবিতে প্রচার শুরু করে এবং এ বিষয়ে মানুষকে আরও শেখানো ও সচেতন করার আহ্বান জানায়।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা হালালেহ তাহেরি বলেন: “আমরা চাই ছেঁড়া হাইমেন মেরামতের পদ্ধতি নিিষদ্ধ করা হোক্, কিন্তু যথাযথ শিক্ষা বা সচেতনতা ছাড়া এই প্রথা নিষিদ্ধ করতে গেলে তাতে ভালর চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি। এই বিষয়টা নিয়ে যে ব্যবসা করা হচ্ছে, তার কারণই হল কুমারীত্ব নিয়ে সনাতন মানসিকতা।
“আমরা যদি আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষদের শেখাতে পারি, এবং তাদের বদ্ধমূল বিশ্বাসে পরিবর্তন আনতে পারি, তাহলে অস্ত্রোপচার করে হাইমেন পুর্নস্থাপন বা মেরামত করার আর কোন প্রয়োজন হবে না। এই ব্যবসা সময়ে আপনিই গুটিয়ে যাবে।”
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ