রাজধানীতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে যানজট। অনিয়ন্ত্রিত গাড়ি পার্কিং, ফুটপাত দখল, ট্রাফিক সিগন্যাল না মানাসহ নানা কারণে এটি এখন লাগামহীন। বিভিন্ন সময় অনেক প্রযুক্তি প্রয়োগেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি যানজট। এবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই অধ্যাপক দেশীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে যানজট নিরসনে কাজ শুরু করেছেন। মোট পাঁচটি প্রক্রিয়ায় রাজধানীর যানজট নিরসন সম্ভব বলে জানান তারা। এ নিয়ে গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বুয়েটের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিশেষজ্ঞরা ঢাকার যানজট নিরসনে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন
এই প্রক্রিয়ার অংশ পাইলট প্রকল্প হিসেবে রাজধানীর ২২টি মোড়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ‘ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি তত্ত্বাবধান করবে বুয়েট। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিসেম্বরের শুরুতে প্রাথমিকভাবে চারটি মোড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে এই পাইলট প্রকল্প। প্রথম ধাপে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বাংলামোটর, কাওরান বাজার ও ফার্মগেট মোড়ে লাগানো হবে এই সিগন্যাল বাতি। পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ভবন মোড়, কদম ফোয়ারা ও মৎস্য ভবন মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মসজিদ মোড় হয়ে মিন্টো রোডের মোড়ে বসবে। পরে বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর হয়ে আবদুল্লাহপুর মোড় পর্যন্ত বসানো হবে।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার সড়কের সংযোগগুলোতে মোট ট্রাফিক সিগন্যাল আছে প্রায় ১১০টি। তবে এগুলোর কোনোটিই কাজ করছে না। ঢাকা শহরে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য গত ১৯ বছরে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন। এসব উদ্যোগের বেশির ভাগই সুফল বয়ে আনেনি। ফলে নগরীর সব জায়গায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা ম্যানুয়ালি যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এই প্রকল্প চালু হলে ‘অকাজে’ ব্যয় হওয়া কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এই সিগন্যাল বাতি দুইভাবে কাজ করবে। এটি ‘সেমি অটোমেটেড সিগন্যাল এইড’। একটা বাটনের (বোতাম) মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে ম্যানুয়াল আবার অটোমেটেড (স্বয়ংক্রিয়) করা যাবে। কম যানবাহন থাকলে নির্ধারিত সময়ের জন্য ‘অটোমেটেড মুডে’ চলবে। বেশি থাকলে ‘ম্যানুয়ালি’ সময় পরিবর্তন করে নেওয়া যাবে। এ ব্যবস্থা সনাতন (ম্যানুয়াল) পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে। অর্থাত্ সংকেত বাতি (লাল, সবুজ ও হলুদ) জ্বলা-নেভার বিষয় সনাতন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। পরে ধাপে ধাপে এ পদ্ধতিকে স্বয়ংক্রিয় (অটোমেশন) করা হবে।
পুলিশকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রাফিক পুলিশ যে ধরনের কাজ করে, সেই ধরনের সুবিধা এতে থাকবে। তাদের আর হাত দেখাতে হবে না। সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রাফিক বাতি দেখানো হবে। পুলিশ চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো সিগন্যালের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেখানে কিছু সতর্কতার ব্যবস্থা থাকবে। যেমন-কোনো সিগন্যালে বেশি সময় লাগলে সেটিও জানা যাবে। পথচারী পারাপারের জন্যও আলাদা সিগন্যাল থাকবে। এটা যে কোনো সময় আপডেট করা যাবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, নতুন এই প্রযুক্তি পরিচালনায় ট্রাফিক পুলিশকে কোনো ট্রেনিং নিতে হবে না। সিগন্যালগুলোতে একজন পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি বুয়েটের একজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। ফলে একজন আরেক জন থেকে শিখে নিতে পারবেন।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বুয়েট অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আগে যেসব পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করার ফলে খরচ ছিল অনেক বেশি। সেগুলো চালানোর জন্য লোকবলের অভাব, উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় সব বাজেট জলে গেছে। আবার এগুলো নষ্ট হলে পুনরায় আমদানি করতে হতো। সেটাও অনেক সময়সাপেক্ষ বিষয়। অনেক সময় দেখা যায়, এক বছর সময় লাগিয়ে নির্দিষ্ট যন্ত্রাংশ আমদানি করা হলেও পূর্বের যন্ত্রাংশগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে পুরো সিস্টেমই অচল হয়ে পড়ে। তবে বর্তমান ব্যবস্থাটি দেশীয় প্রযুক্তিতে বুয়েটেই তৈরি করা হবে। ফলে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজও এখান থেকে দেখা হবে। সিটি করপোরেশন মূলত বাজেট অ্যারেঞ্জড করবে আর সব টেকনিক্যাল সহায়তা আমরা প্রদান করছি।
তিনি বলেন, শুধু এই সিগন্যালের মাধ্যমেই যানজট কমে যাবে এমনটা নয়। আমাদের আরও পাঁচটি পাইলট প্রজেক্ট উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছি। সবগুলো ধীরে ধীরে চালু করতে পারলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে যাবে।