পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে লুটপাটের অন্যতম উৎস ছিল দেশের ব্যাংক খাত। এই খাত থেকে এ পর্যন্ত চার লাখ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে হাসিনার অন্যতম অর্থের জোগানদাতা ব্যাংকখেকো এস আলমই হাতিয়ে নিয়েছেন সোয়া দুই লাখ কোটি টাকা। লুণ্ঠিত এ অর্থের ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকাই দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের বিদায়ের পর অগ্রাধিকারভিত্তিতে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে হাসিনা, রেহানাসহ তাদের পরিবার এবং ১০ শিল্প গ্রুপকে। প্রাথমিক হিসাবে হাসিনা ও তার পরিবারের ১২৪টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গিয়েছে। যার বিপরীতে আটক করা হয়েছে ৬৩৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং ও কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে তাদের সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঢাকায় পাওয়া গেছে আটটি আলিশান ফ্ল্যাট ও রাজউকের ৬০ কাঠা জমি। শেখ হাসিনা পরিবার, ১০ শিল্প গ্রুপের সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ সংযুক্ত করেছে বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি ৪২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর জানিয়েছেন, লুটেরাদের অর্থ দিয়ে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হবে। যেখান থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকের আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হবে। বাকি অর্থ গরিব মানুষের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।
সরকার গঠিত ১১টি তদন্ত দলের অনুসন্ধানে ১০ শিল্পগোষ্ঠীসহ শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাংক ঋণে অনিয়ম, কর ফাঁকি ও অর্থপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও পাচার করা অর্থের খোঁজ মিলেছে এস আলম গ্রুপের। ইতোমধ্যে এসব ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সরকার একটি বিশেষ অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সাথে এই অর্থ উদ্ধারে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হবে তা নির্ধারণের কাজও চলছে। এ প্রক্রিয়ায় সহায়তা দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে গঠিত পাচার করা অর্থ উদ্ধারে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর গতকাল জানিয়েছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত ও প্রয়োজনে আইন সংশোধনের মাধ্যমে ফান্ড (লুটের টাকা ব্যবস্থাপনা তহবিল) গঠন করা হবে। ব্যাংক ক্ষতিপূরণ এবং জনহিতকর কাজে ব্যবহারের জন্য দুই ধরনের ফান্ড গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। গভর্নর বলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে একটা ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা। যেটার অর্থ দিয়ে আমরা ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারব। কারণ ব্যাংকগুলো বিশালভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের টাকা তো লুট করা হয়েছে। এ ছাড়া বাকি টাকা যেগুলো নন ব্যাংক রিলেটেড, যেগুলো দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে, সেগুলো সরকার আরেকটা ফান্ডে নিয়ে জনহিতকর কাজে ব্যয় করবে। সবই আইনগতভাবে করা হবে। কোনোটাই আইনের বাইরে হবে না। পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা কিভাবে ফেরত আনতে হয়, সেটার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা আমরা জানি।
বিশেষ তহবিল গঠনের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার : আওয়ামী লীগের আমলে লুট হওয়া টাকা দিয়ে একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই তহবিলের অর্থ আওয়ামী লীগের আমলে লুট হওয়ার ব্যাংকের ডিপোজিটরদের (আমানতকারী) ও গরিব মানুষদের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। গতকাল যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের অবহিত করার জন্য দুপুরে রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গভর্নর ও প্রেসসচিব ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট-বিএফআইইউর প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারক জানিয়েছেন, যারা তদন্তের আওতায় এসেছেন তাদের ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বিদেশে এবং ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর জানান, পাচারকারীদের লুটের জব্দকৃত টাকা ও শেয়ার দরিদ্রদের জন্য এবং জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হবে। আমরা ইতোমধ্যে যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের কিছু অর্থ জব্দ করেছি। এর সাথে এই সব পাচারকারীর দেশে থাকা শেয়ারও অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এ সব অর্থ আমরা ব্যাংকের ডিপোজিটরদের ফেরত দেবো। কিছু অর্থ আবার জনকল্যাণে ব্যয় করা হবে।
কিভাবে এটা সম্ভব হবে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, ব্যাংকে যে অর্থ আমানত হিসেবে জমা আছে, তা সহজেই পাওয়া পাবে। ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপের ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করা হয়েছে। এই শেয়ার একটি স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংক পাবে, যা আমানতকারীদের ফেরত দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, টাকা কিভাবে ফেরত আনতে হয়, সেটার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল এক্সপেরিয়েন্সটা আমরা জানি। সাধারণত এটি করতে চার থেকে পাঁচ বছর লাগে। কিন্তু এর মধ্যে ইমিডিয়েট কিছু ব্যবস্থা নেয়া যায়। বিদেশে তাদের যে সম্পদ আছে, সেটাকে ফ্রিজ করা যায়। সেটা আপেক্ষিকভাবে বছরখানেকের মধ্যেই করা সম্ভব। প্রথমে আইনের প্রক্রিয়াটা আমাদের দেশের সম্পন্ন করতে হবে, তারপর সঠিক প্রণালীতে বিদেশে রিকোয়েস্ট করতে হবে। যেটাকে বলা হয় মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ)। আমরা এখন এই প্রক্রিয়াতে আছি। আমরা রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি। তিনি উল্লেখ করেন- শিগগিরই প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্য যাচ্ছেন। সে সময় পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে একটি ভালো অগ্রগতি হতে পারে। কারণ সেই দেশের সরকার, মিডিয়া বিশেষ করে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের সহায়তা করছে।
গভর্নর বলেন, আমাদের তথ্য সংগ্রহ ও গুণগত মান এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বিদেশে যে রায় হবে, সেই রায়ের ক্ষেত্রে। এজন্য আমাদের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এই তথ্য তাদের সরবরাহ করতে হবে এবং আমাদের লিগ্যাল প্রসেস বিদেশে শুরু করতে হবে। সেদিকেই আমরা এগোচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে তাহলে দুদক সেটা তদন্ত করবে। তদন্ত করে যদি মনে করে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আনা যাবে, তাহলে সেটা তারা নিয়ে আসবে। এখানে দুদককে কেউ বাধা দিচ্ছে না। দুদক নিজস্ব প্রক্রিয়া এ কাজটি করছে। এখানে আমার মন্তব্য করাটা একেবারেই সমুচিত নয়।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে চার-পাঁচ বছর লেগে যাবে। তবে এক বছরের মধ্যে বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করা যাবে। যারা দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন, তারা শান্তিতে থাকতে পারবেন না, এ বক্তব্য প্রসঙ্গে গভর্নরকে প্রশ্ন করা হয়- আসলে কি তারা শান্তিতে নেই? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা শান্তিতে আছেন তা বিশ্বাস করি না। তারা বড় বড় আইনজীবী নিয়োগ দিচ্ছেন। আমরা শুনেছি, এস আলম তার আইনজীবীর পেছনে বছরে তিন কোটি ডলার ব্যয় করবেন। এটা তার শান্তিতে থাকার লক্ষণ নয়। টাকা ফেরত আনতে পারা ও শান্তিতে থাকা দু’টি ভিন্ন বিষয়। আমরা ঘুম নষ্ট করতে পেরেছি। টাকা ফেরত আনতে সময় লাগবে। কারণ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এটা এগোবে।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ‘তারা শান্তিতে যে নেই, এর আরো একটা প্রতিচ্ছবি হলো, মাঝারি আকারের আরো ১২৫টি অনিয়ম তদন্তের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। যারা কিনা ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লুট করেছেন। আমরা ২০টি বিদেশী আইনি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছি। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে কী কাজ হবে তার কার্যপরিধি ঠিক করা হচ্ছে।’
মোবাইলে আর্থিক লেনদেনকারী সংস্থা নগদ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে গভর্নর বলেন, আমাদের কথা সুস্পষ্ট, নগদের বোর্ডে যারা ছিলেন তারা দুর্নীতি করেছেন। এই দুর্নীতির মাধ্যমে তারা ৬৫০ কোটি ই-মানি সৃষ্টি করেছেন, যেখানে প্রকৃত কোনো অর্থ ছিল না। এ ছাড়া তারা সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির নামে দুই হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষায় ধরা পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের কাছেও ধরা পড়েছে। তাই আমরা মনে করি, তাদের হাতে আর কোনোক্রমে নগদের কার্যক্রম ফেরত যাওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোর্টের একটি রায় হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা আপিল করেছি, শিগগিরই আমাদের পক্ষে রায় পাব বলে মনে করি। কিন্তু আমরা শঙ্কিত যে এই সময়ের মধ্যে তারা টোটাল সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। ফলে তারা অনেক কিছু ডেটা বেইজ থেকে মুছে ফেলতে পারে।