ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির সেক্স, অর্থাৎ, তিনি নারী নাকি পুরুষ- সেটি তাঁর জন্ম থেকেই নির্দিস্ট এবং স্পষ্ট প্রকাশিত। অর্থাৎ, বায়োলজিক্যালি তিনি পূর্ণ নারী অথবা পুরুষ। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ‘মনে মনে’ তাঁর বায়োলজিক্যাল সত্ত্বার বিপরীত জেন্ডার অনুভব করেন এবং সেই জেন্ডার আইডেন্টিটি প্রকাশ করতে চান।
অর্থাৎ, বায়োলজিক্যাল নারী মনে মনে পুরুষত্ব অনুভব ও প্রকাশ করেন এবং বায়োলজিক্যাল পুরুষ নারীত্ব অনুভব ও প্রকাশ করেন। অন্য কথায়, শরীর পুরুষের কিন্তু মন নারীর বা শরীর নারীর কিন্তু মন পুরুষের। এটি একটি মানসিক অবস্থা যা মেডিক্যাল পরিভাষায় ‘Gender Dysphoria’ হিসেবে গণ্য। এদের কেউ কেউ হরমোন ট্রিটমেন্ট বা সার্জারির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত জেন্ডারের কিছু আর্টিফিশিয়াল শারীরিক বৈশিষ্ট্য লাভ করে যদিও এসবের মাধ্যমে তাঁর বায়োলজিক্যাল সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমের মৌলিক কোন পরিবর্তন করতে পারার প্রমাণ পাওয়া যায় না।
অন্যদিকে, হিজড়া বলতে মূলত বুঝানো হয় hermaphrodite কে। অধুনা এটিকে ‘intersex’ নামে ডাকা হয়। এটি ট্রান্সজেন্ডারের বিপরীত। যাদের জন্মগতভাবে লিঙ্গ নির্দিষ্টভাবে প্রকাশিত নয়- হতে পারে সেটা ক্রোমোসোমাল কারণে কিংবা জন্মগত ত্রুটির কারণে- তারাই intersex বা হিজড়া।
অর্থাৎ, একজন ইন্টারসেক্স বা হিজড়া লৈঙ্গিক ত্রুটি নিয়ে জন্মলাভ করে। এটি প্রধানত একটি শারীরিক অবস্থা। তাঁর মধ্যে নারী এবং পুরুষ উভয় ধরণের জননাঙ্গ ও প্রজনন ব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ সহাবস্থান থাকতে পারে বা কোন নির্দিষ্ট লিঙ্গের প্রকাশিত বৈশিষ্ট্য না থাকতে পারে। ফলে, অনেক সময় তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্দিষ্ট করা মুশকিল হয়। হিজড়া বা ইন্টারসেক্স মানুষের লিঙ্গ পরিচয়ের আইনি স্বীকৃতি এবং তাদের প্রতি বৈষম্য রোধকল্পে তাই অনেক ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ- এই লিঙ্গ পরিচয়ের বাইরে ‘তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)’ এর অপশন রাখার বিধান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আইনি কাঠামো নারী ও পুরুষ এর বাইরে আর কোন লিঙ্গ পরিচয় কে স্বীকার করে কি না- এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ ও চিহ্নিতকরণ ব্যক্তির আইনগত অধিকারের সুরক্ষা ও প্রতিকারের জন্য একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ, বিশেষত পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে। বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, দেনমোহর, সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিচারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগণের লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ অত্যাবশ্যক যেহেতু নারী ও পুরুষ- লিঙ্গভেদে আইনের বিধান, অধিকার, কর্তব্য ও প্রতিকার আলাদা।
বাংলাদেশের প্রায় সব আইনই নারী ও পুরুষ এর বাইরে আর কোন লিঙ্গ পরিচয় কে স্বীকার করে না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। ২৮ অনুচ্ছেদের (১), (২) এবং (৩) উপ-অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র কর্তৃক কোন নাগরিকের প্রতি যেসব গ্রাউন্ডে বৈষম্য না করার কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে ‘নারী-পুরুষভেদ’ একটি গ্রাউন্ড। সংবিধানের ইংরেজি পাঠে “sex” শব্দকে কে বাংলা পাঠে “নারী- পুরুষভেদ” অর্থে অনুবাদ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে ট্রান্সজেন্ডার অথবা হিজড়া বা ইন্টারসেক্স বা থার্ড জেন্ডারের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি নেই। ২৮ (৪) অনুচ্ছেদে নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করতে পারবে বলা হয়েছে কিন্তু এখানেও অন্য লৈঙ্গিক পরিচয়ের কোন উল্লেখ নেই।
১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১০ ধারায় “Man” এবং “Woman” এর যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে যে কোন বয়সী ‘মানব’ এবং ‘মানবী’-র বাইরে আর কোন জেন্ডারের উল্লেখ বা স্বীকৃতি নেই। একই আইনের ৩৭৭ ধারানুযায়ী প্রকৃতি-বিরুদ্ধ উপায়ে নারী, পুরুষ অথবা পশুর সাথে যৌন ক্রিয়া- একটি ফৌজদারি অপরাধ যার শাস্তি যাবজ্জীবন অথবা দশ বছরের কারাদণ্ড, সাথে জরিমানা। বর্তমান ফৌজদারি ব্যবস্থায় “মনে মনে” নারী বা পুরুষ হয়ে উঠা কোন ব্যক্তি বায়োলজিক্যালি সমলিঙ্গ- এমন কাউকে আইনত বিয়ে করতে পারবে না, এবং এমন যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে সেটি আইনত প্রকৃতি বিরুদ্ধ এবং সেক্ষেত্রে উপরোক্ত শাস্তির বিধান প্রযোজ্য।
মুসলিম পারিবারিক আইন এবং হিন্দু পারিবারিক আইন এর আওতায় উত্তরাধিকারসহ অন্যান্য সব বিষয়ে আইনি বিধান নারী ও পুরুষ- শুধু এই দুই লিঙ্গভিত্তিক নির্ধারিত হয়েছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য উত্তরাধিকার আইন – Succession Act 1925 ও নারী ও পুরুষ লিঙ্গের বাইরে আর কোন লিঙ্গ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয় না।
তবে, সাম্প্রতিককালে কিছু সরকারি পলিসি ডকুমেন্ট, অফিসিয়াল পরিচয় চিহ্নিতকরণ কাজে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ফর্ম পূরণের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের বাইরে লিঙ্গ পরিচয় প্রকাশের অপশন হিসেবে “হিজড়া’, “তৃতীয় লিঙ্গ’ কিংবা “অন্যান্য” অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো “হিজড়া”-কে একটি আলাদা লিঙ্গ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি প্রদানের ঘোষণা দেয় যা পরের বছর সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে অনুমোদন করে। বাংলাদেশ সরকারের বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর ২০১৪ সাল হতে পাসপোর্টের আবেদন ফর্মে নারী ও পুরুষ পরিচয়ের বাইরে “অন্যান্য” অপশন অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের মাধ্যমে ‘হিজড়া’দের ঋণ লাভের অধিকারী হিসেবে ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে, অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বিভিন্ন আবেদন ফর্মে নারী ও পুরুষ এর বাইরে লিঙ্গ পরিচয় অপশন হিসেবে “তৃতীয় লিঙ্গ” অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা আইন ২০০৯ এবং ভোটার তালিকা বিধিমালা ২০১২ সংশোধনপূর্বক জাতীয় পরিচয়পত্রে লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে “হিজড়া” অপশন ব্যবহার অনুমোদন করে। জন্ম নিবন্ধন আবেদনপত্রে বর্তমানে “তৃতীয় লিঙ্গ’ অপশন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
২০২২ সালের এপ্রিলে সরকার সংসদে “বৈষম্য বিরোধী আইন ২০২২” উত্থাপন করেছে যা কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায়। এই আইনের ধারা ৩ এ যেসব গ্রাউন্ডের ভিত্তিতে কৃত কার্য কে “বৈষম্যমূলক কার্যাবলী” গণ্য করা হয়েছে তার মধ্যে “তৃতীয় লিঙ্গ” কে অন্তর্ভুক্ত করা আছে। অর্থাৎ, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না।
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আইনি কাঠামো মোটাদাগে বায়োলজিক্যাল নারী এবং পুরুষ এর বাইরে আর কোন লিঙ্গ পরিচয়ের আইনি স্বীকৃতি প্রদান করে না। বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর কোথাও ‘ট্রান্সজেন্ডার’ পরিভাষার অস্তিত্ব কিংবা আইনি স্বীকৃতি নেই। আইনের সীমিত পরিসরে ‘হিজড়া’ এবং ‘তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)’ পরিভাষার উপস্থিতি রয়েছে এবং সেসব ক্ষেত্রে এ দুটোকে সমার্থক অর্থে নির্দেশ করা হয়েছে। মুশকিল হচ্ছে, অনেকে ট্রান্সজেন্ডার- কে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ-র সাথে সমার্থক হিসেবে ধরে নিয়েছেন যা আইন এবং জেন্ডার টার্মিনলজি- উভয় দিক দিয়েই সমস্যাজনক এবং বিভ্রান্তিকর।
বাংলাদেশের আইনে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স সম্প্রদায়ের সুরক্ষার বিষয়টিই এখনো শক্ত ভিত্তি পায়নি এবং এখনো প্রাথমিক ও ফর্মেটিভ স্টেজে রয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার কে ইন্টারসেক্স বা তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়ার একই অর্থে সংজ্ঞায়ন তাই আইনগত দিক দিয়ে সমস্যাজনক।
আইনি সুরক্ষা, প্রতিকার এবং লিঙ্গ পরিচয় সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে অনেক হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তির শারীরিক ও প্রজনন বৈশিষ্ট্যের ডমিন্যান্স এর ভিত্তিতে মেডিক্যাল এক্সামিনাশনে তাঁর লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব। অর্থাৎ, মেডিকেল টেস্টে পুরুষের সেক্সুয়াল এবং রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম ডমিন্যান্ট হলে তিনি পুরুষ এবং ভাইস-ভার্সা। এছাড়া, ক্রমোসম এনালিসিস এর মাধ্যমে এদের বেশিরভাগের লিঙ্গ আরও ভালোভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব।
কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার- যিনি নিজের জন্মগত বায়োলজিক্যাল লিঙ্গের বিপরীতে “মনে মনে” ভিন্ন জেন্ডার আইডেন্টিটি ধারণ ও প্রকাশ করতে চান, তাঁর এই মানসিক দাবির সত্যতা যাচাই এর গ্লোবাল বিজ্ঞানসম্মত কোন টুলস বা বেঞ্চমার্ক আছে কি? আইনগত সুযোগ, সুবিধা এবং অধিকারের সুরক্ষা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মনে মনে ভিন্ন জেন্ডারের দাবিদারদের কারা কারা মিথ্যা দাবি করছে- জাতীয় পর্যায়ে সেটি কিভাবে চিহ্নিত ও নির্ধারিত হবে? যেখানে এদেশে আইন ফিজিক্যাল এভিডেন্সের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে সাইকোলজিক্যাল প্রেফারেন্সের ভিত্তিতে আইনের বিধান প্রয়োগ কীভাবে সম্ভব যে মানসিক অবস্থা এমনকি মেডিক্যালি প্রমাণ করারও সায়েন্টিফিক উপায় নাই।
দ্বিতীয়ত, হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের আইনগত অধিকারের স্বীকৃতিই এখনো পুরোপুরি মেলেনি। তারা এই সমাজে একটি প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী। তাদের সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, জীবিকার অধিকার ইত্যাদির আইনি স্বীকৃতি ও স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনা এখনো দূর অস্ত। ট্রান্সজেন্ডার কে হিজড়া বা ইন্টারসেক্স বা তৃতীয় লিঙ্গের সাথে গুলিয়ে ফেলা হলে এই প্রান্তিক গোষ্ঠী আরও ভালনারেবল হয়ে পড়বে। মনে মনে মিথ্যা জেন্ডার দাবিদারদের ভিড়ে সত্যিকার হিজড়াদের অধিকার হারিয়ে যাবে।
ট্রান্সজেন্ডারের মনে মনে ভিন্ন জেন্ডারের দাবি- অত্যন্ত সাবজেক্টিভ এবং পার্সপেক্টিভ নির্ভর যা আইনগতভাবে লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে বিশাল চ্যালেঞ্জ। এছাড়া, এটি আমাদের দেশের সংবিধান, আইন, ধর্মীয় মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স মানুষের সাথে এক মোড়কে ট্রান্সজেন্ডার-কে একই অর্থে সংজ্ঞায়ন করা তাই অন্যায্য এবং বিপদজনক।