বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার জায়গা বা পার টংজালের জায়গা বিক্রি করা হচ্ছে! দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রামের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সাগরে মাছ ধরার জন্য প্রতি বছর দখল-স্বত্ব বিক্রি করে আসছে। জাল ফেলার জায়গা বিক্রির মাধ্যমে তারা জেলেদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে দখল-স্বত্ব বিক্রি করা হচ্ছে। দখল-স্বত্ব না কিনে মাছ ধরতে গেলে মারধরসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে জেলেদের। তবে সব কিছু দেখেও অদৃশ্য কারণে নীরব ভূমিকা পালন করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। জাল কেটে নদীতে ফেলে দেয়া হচ্ছে। জোর করে মাছ ধরার বোট আটকে রাখা হচ্ছে। জেলেদের ওপর নির্যাতন বন্ধে একাধিকবার বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর, পুলিশ ও র্যাবের কাছে অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগীরা। তবে তাতেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। বরং অভিযোগকারীদের ঘরবাড়ি ছাড়া করছে সংঘবদ্ধ চক্রটি। চট্টগ্রামের নগরী ও উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় সংঘবদ্ধ চক্রটি তাদের রামরাজত্ব কায়েম করেছে।
এদিকে সাগরে মাছ ধরার জায়গা দখল নিয়ে বারবার ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনা। এসব ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল সালিশের মাধ্যমে সমাধান করা হচ্ছে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর আনোয়ারার উপকূলীয় এলাকায় দখল নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় এক জেলে নিহতের ঘটনা ঘটে।
অভিযোগ সূত্র জানায়, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর থেকে ফিশিংবোটের লাইসেন্স নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যান জেলেরা। লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সীমানার স্থলভাগে মৎস্য আহরণ করবেন জেলেরা।
কিন্তু নগরীর পতেঙ্গা থানাধীন উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে জেলেদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছেন সংঘবদ্ধ একটি চক্র। ইলিয়াছ সওদাগর, সেকান্দর সওদাগর, নুর মোহাম্মদ, সাহাবুদ্দিন ও তাজু নামের কয়েকজন ব্যক্তি মিলে সাগরে মাছ ধরার জন্য জেলেদের কাছে দখল-স্বত্ব বিক্রি করে যাচ্ছেন। জানা গেছে, এক বছরের জন্য ৫-১০ লাখ টাকায় এ দখল-স্বত্ব বিক্রি হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকাধীন সম্পত্তির মতো সাগরে পার টংজালের সীমানা বিক্রি হচ্ছে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে। ফলে নির্দিষ্ট সীমানায় মাছ ধরতে হচ্ছে বোট মালিদের। এর বাইরে গেলেই জেলেদের মাছ আটক নিয়ে যাচ্ছে সীমানা বিক্রয়কারীরা। আবার দখল-স্বত্ব না কিনে মাছ ধরতে গেলে জাল ও বোট আটক করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট জরিমানা আদায় করে ছাড়া হচ্ছে।
সংঘবদ্ধ চক্রের একটি বাহিনী মাঝ নদীতে বড় ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে এসব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ভুক্তভোগী মো. কামাল নামে বোট মালিক জানায়, দীর্ঘদিন ধরে দরিদ্র ও নিরীহ জেলেদের ওপর এমন অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে এলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ পর্যন্ত একাধিকবার প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর, পুলিশ ও র্যাবের সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। অভিযোগ দেয়ায় আমার জালসহ মাছ ধরার একটি বোট নিয়ে গেছে তারা (সংঘবদ্ধ চক্র)। ভুয়া স্ট্যাম্পের মাধ্যমে আমার ভোট কিনে নিয়েছে বলে দাবি করছে। পুলিশের কাছে অভিযোগ দেয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে এই বাহিনীর অত্যাচারে স্ত্রী সন্তান নিয়ে নিজ বাসায় পর্যন্ত থাকতে পারছি না।
সূত্র জানায়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর আনোয়ারার উপকূলীয় অঞ্চল রায়পুরের উত্তর পরুয়াপাড়া এলাকার ঈদগাঁ ঘাটে মাছ ধরতে যান মো. আবদুল কাদের নামে এক জেলে। মাঝ নদীতে মাছ ধরার স্থান দখল নিয়ে বোট মালিক রশিদ ও তাহেরের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষে বাধে। এতে উভয়পক্ষের কয়েকজন আহত হয়। পাড়ে এসে জেলে আবদুল কাদেরের (৪১) মৃত্যু হয়। জেলে আবদুল কাদের উত্তর পরুয়াপাড়া তাহের মাঝি বাড়ির মৃত বশির আহমদের ছেলে।
সূত্র আরও জানায়, ১৫০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পের মাধ্যমে পার টংজালের জায়গা বিক্রি রশিদপত্র নামক চুক্তি সম্পাদন করেছে মো. ইলিয়াছ সওদাগর নামে এক বিক্রেতা। চুক্তিতে উল্লেক করা হয়- বিক্রেতার দখলকৃত কর্ণফুলী মোহনা সোজা পাঁচটি নৌকার জন্য পাঁচ লাখ টাকায় পার টংজালের জায়গা বিক্রি করা হয়। এক বছরের জন্য মো. ইউছুপ নামে এক বোট মালিক সাগরের এমন দখল-স্বত্ব কিনে নেন।
জানতে চাইলে মেসার্স ইলিয়াছ এন্টারপ্রাইজের মালিক ইলিয়াছ সওদাগর বলেন, সাগরে জাল বসানোর খুঁটি দেয়া হয়। জেলেদের মাছ ধরার সুবিধার্থে এসব খুঁটি বসিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে- সরকার যেকোনো সময় উচ্ছেদ করলে বিক্রেতা দায়ী থাকবে না। এটা সবাই জেনে শুনেই নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সামুদ্রিক মৎস্য দফতর চট্টগ্রাম সহকারী পরিচালক সুমন বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, সাগরে মাছ ধরার জায়গা বেচা-বিক্রি হচ্ছে এমন একটি বিষয় শুনেছি। কিন্তু কোনো অভিযোগ পাইনি। নিয়ম অনুযায়ী মাছ ধরার জন্য সাগরে কেউ নামলে ফিশিং লাইসেন্স নিতে হবে। এর বাইরে জাল বসানোর জায়গা দখল কিংবা বিক্রি আইনবহির্ভূত।